গিগ ইকোনমি ও জিরো বেকারত্ব : ‘থ্রি জিরো’ ধারণার নতুন দিগন্ত
ড. তৌহিদ হোসেন খান [সূত্র : দেশ রূপান্তর, ২৪ মে ২০২৫]

পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে মানুষ, জীবনধারণের জন্য ভিন্ন ভিন্ন উপায় আবিষ্কার করেছে। সময়ের পরিবর্তনে এই উপায়গুলো ধীরে ধীরে আধুনিক হয়েছে। এক সময় মানুষ দিনরাত পরিশ্রম করত নিজের, পরিবার বা গোত্রের খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য। যখন মানুষ পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করতে শিখল, তখন এলো খাবার জমানো এবং অন্যদের কাছে বিক্রি করার প্রথা। পরবর্তী সময়ে শিল্পবিপ্লবের পর মানুষের কাজের জগতে এলো ব্যাপক পরিবর্তন। এভাবে পরিবর্তনের ধারায় বর্তমানে মানুষ তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে এমন এক শ্রমবাজারে প্রবেশ করেছে, যেখানে ঘরে বসেই সমগ্র পৃথিবীতে বিচরণ করা যায়। বর্তমান বিশ্বে ইচ্ছে করলেই প্রথাগত অফিসের নিয়মের বাইরে নিজের সুবিধামতো কাজ করে আয় করা যায়। এক্ষেত্রে আপনাকে ৯-৫টা অফিসে যেতে হবে না, প্রতিদিন কাজও করতে হবে না।
বরং শ্রমিকরা ইচ্ছে করলে যেকোনো দিন ছুটি নিতে পারেন বা যতক্ষণ খুশি কাজ করতে পারেন। তথ্যপ্রযুক্তি-নির্ভর এই শ্রমব্যবস্থাকে বলা হয় গিগ ইকোনমি। গিগ-ভিত্তিক কাজগুলো হলো এমন এক ধরনের কাজ, যেখানে শ্রমিকরা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত থেকে স্থায়ী চাকরির বদলে স্বল্পমেয়াদি, চুক্তিভিত্তিক বা নির্দিষ্ট প্রকল্পভিত্তিক কাজ করে থাকেন। এই ধরনের কাজে সাধারণত নির্দিষ্ট সময় বা কাজ অনুযায়ী পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। গিগ ওয়ার্ক সাধারণত অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বা অ্যাপভিত্তিক হয়। এ কাজে স্থায়ী নিয়োগ থাকে না, কাজ শেষ হওয়ার পর কাস্টমার বা সেবা গ্রহীতার সঙ্গে সম্পর্ক থাকে না, কাজের সময় ও ধরনে শ্রমিকের স্বাধীনতা থাকে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে শ্রমিককে নিজের মোবাইল, বাইক বা কম্পিউটার ব্যবহার করে কাজ করতে হয়।
বিশ্বজুড়ে বেকারত্বের সংকট মোকাবিলায় গিগ ইকোনমি একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে, যা ড. ইউনূসের ‘জিরো বেকারত্ব’ তত্ত্বের সঙ্গে সরাসরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (WEF) ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রায় ৮৫ মিলিয়ন প্রথাগত চাকরি হারিয়ে যাবে, তবে ৯৭ মিলিয়ন নতুন ধরনের চাকরি তৈরি হবে, যার বেশিরভাগই হবে ডিজিটাল ও গিগ-ভিত্তিক। এ ধরনের অর্থনৈতিক কাঠামোতে ব্যক্তি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে যেমন: ফ্রিল্যান্সিং, অনলাইন মার্কেটপ্লেসে ডিজিটাল সেবা, রাইড শেয়ারিং, হোম ডেলিভারি, ইত্যাদি যা চাকরির জন্য অপেক্ষা না করে কাজের সৃষ্টি করে, অর্থাৎ বেকার না থেকে মানুষ নিজেই উপার্জনের পথ খুঁজে নেয়। বাংলাদেশ এই পরিবর্তনের স্পষ্ট একটি উদাহরণ; আইসিটি ডিভিশন ও বিসিসি-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে প্রায় ৬৫০,০০০ ফ্রিল্যান্সার কাজ করছেন, যাদের মধ্যে অনেকেই আন্তর্জাতিক মার্কেটপ্লেস যেমন আপওয়ার্ক, ফাইভার, ফ্রিল্যান্সার.কম, টপট্যাল ইত্যাদির মাধ্যমে মাসে গড়ে ২০,০০০-৩০,০০০ টাকা বা তারও বেশি আয় করছেন।
আন্তর্জাতিকভাবে, ভারত ২০২৩ সালে গিগ ইকোনমিতে প্রায় ৭৭ মিলিয়ন কর্মী নিযুক্ত করেছে এবং তাদের ধারণা অনুসারে ২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ২৩০ মিলিয়ন ছাড়াবে। কেনিয়ার মতো আফ্রিকার দেশগুলোতেও গিগ কর্মীরা ডিজিটাল কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছেন। বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে গুগলের ‘Digitize Afric’ প্রকল্পের মাধ্যমে লাখো তরুণকে অনলাইন কর্মসংস্থানে যুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশে ও একইভাবে, ‘Her Power Project, Learning and Earning Program’, এবং ‘Skills for Employment Investment Program (SEIP)’ এর মাধ্যমে হাজার হাজার যুবক ও যুবতী গিগ ইকোনমির উপযোগী স্কিল শিখে কাজ শুরু করেছেন, যার ফলে তারা আর বেকার নেই। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো, গিগ ইকোনমি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য এক নতুন দিগন্ত তৈরি করেছে যেখানে একজন ব্যক্তি কেবল একটি স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে নিজের ঘর থেকেই বিশ্ববাজারে কাজ করতে পারছে।
উদাহরণস্বরূপ, খুলনার পাইকগাছা উপজেলার মো. রাসেল হোসেন, যিনি দশম শ্রেণি পাস করে ঢাকায় না গিয়ে নিজ গ্রাম থেকেই ফ্রিল্যান্সিং করে মাসে গড়ে ২৫,০০০ টাকা আয় করছেন। এমনকি এখন নিজে অনলাইন কোর্স চালিয়ে অন্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। আবার নারীদের ক্ষেত্রে, ঘরে বসে অনলাইন বিজনেস চালানো, ডিজিটাল মার্কেটিং করা কিংবা কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হওয়ার সুযোগ গিগ ইকোনমি তৈরি করেছে, যা তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে। যেমন ময়মনসিংহের ‘শবনম ডিজাইনস’-এর মালিক ফেসবুক মার্কেটপ্লেস ও ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে ডিজাইনার পোশাক বিক্রি করে মাসে ৪০ হাজার টাকার অধিক আয় করছেন। গিগ ইকোনমি শুধু আর্থিক উপার্জনের সুযোগই দেয় না, বরং আত্মনির্ভরশীলতা ও উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতাও তৈরি করে, যার ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। ২০২২ সালের এক গবেষণায় Oxford Internet Institute দেখায়, গিগ প্ল্যাটফর্মগুলো দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে দ্রুত বিকাশমান, যেখানে বাংলাদেশ অন্যতম গন্তব্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
এই পরিবর্তনশীল কর্মজগৎ বেকারত্বের সংজ্ঞাকেই বদলে দিচ্ছে। যেখানে চাকরি মানেই আগে ছিল সরকারি/প্রাইভেট অফিসে ৯-৫ কাজ, সেখানে এখন একজন তরুণ ৩টি গিগ প্ল্যাটফর্মে একসঙ্গে কাজ করে তার দক্ষতা অনুযায়ী উপার্জন করছেন, এমনকি অন্যদের শেখাচ্ছেন এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে পরিণত হচ্ছেন। সরকারের পক্ষ থেকেও আইসিটি বিভাগ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’পরিকল্পনার আওতায় ২০২৫ সালের মধ্যে ২০ লাখ তরুণ-তরুণীকে আইটি এবং গিগ-ভিত্তিক দক্ষতা প্রশিক্ষণ দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে, যা একটি বিশাল পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। তাছাড়া, বৈশ্বিক গিগ প্লাটফর্মগুলো যেমন উবার, পাঠাও, ফুডপান্ডা, ইয়ার টাস্কার, টাস্ক রাবিট ইত্যাদি শহুরে তরুণদের জন্য ছোট ছোট জব তৈরি করছে, যেখানে একঘণ্টা বা একদিনের জন্য কাজ করলেও নির্দিষ্ট উপার্জন নিশ্চিত হচ্ছে। এসব কাজের ক্ষেত্রে কোনো প্রথাগত ডিগ্রি বা চাকরির আবেদন প্রয়োজন হয় না। শুধুমাত্র নির্ভরযোগ্যতা, দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান থাকলেই যথেষ্ট।
গিগ ইকোনমি বিশেষভাবে উদীয়মান অর্থনীতিতে কর্মসংস্থানের কমতি পূরণ করতে সাহায্য করে। যেখানে সরকার বা প্রাইভেট সেক্টর সবাইকে নিয়োগ দিতে পারে না, সেখানে গিগ প্ল্যাটফর্মে মানুষ নিজের কাজ নিজেই তৈরি করে নেয়। তবে, এই অর্থনীতির একটি চ্যালেঞ্জ হলো এখনো অধিকাংশ গিগ-কর্মী সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা বা শ্রম আইনের আওতার বাইরে থাকেন। ফলে নীতিগত সহায়তা ও গিগ ওয়ার্কারদের স্বীকৃতি প্রদান আবশ্যক। তবুও বলা যায়, দক্ষতা ও ইন্টারনেট অ্যাক্সেস থাকলে গিগ ইকোনমি এমন এক প্ল্যাটফর্ম, যেখানে একজন মানুষ জীবনের যেকোনো পর্যায়ে কর্মক্ষম হতে পারেন তা তিনি ছাত্র, গৃহিণী, অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা শারীরিকভাবে অক্ষম যেই হোন না কেন। ড. ইউনূস যেমন বলেন, ‘চাকরির জন্য বসে থেকো না, নিজে একটা কাজ তৈরি করো’, গিগ ইকোনমি সেই সুযোগটিই দিয়েছে এবং সে কারণেই এটি জিরো বেকারত্ব অর্জনের এক অত্যন্ত সম্ভাবনাময় পথ।
গিগ প্লাটফর্মগুলো বাংলাদেশে বেকারত্ব দূর করে ‘জিরো বেকারত্ব’ ধারণা সফল করতে এক আশার প্রদীপ জ্বেলে হাজির হলেও, এই সেক্টরের শ্রমিকরা বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। প্রথমত, বাংলাদেশে এই শ্রমিকদের জন্য কোনো আইন-কানুন বা নিয়ম নেই। তাছাড়া শ্রমিকদের জন্য দেশে যেসব আইন আছে, যেমন বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬, জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি নীতিমালা ২০১৩, তা গিগ ওয়ার্কারদের অন্তর্ভুক্ত করে না। ফলে তারা প্ল্যাটফর্ম থেকে কেমন পেমেন্ট পাবেন বা কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা তাদের পাওয়া উচিত, তা একেবারেই অস্পষ্ট। এমনকি তারা অসুস্থ বা কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও কোনো ক্ষতিপূরণ বা সুবিধা পান না। একদিকে এই শ্রমিকদের বেতন, সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত নয় অন্যদিকে তাদের সমস্যার ক্ষেত্রেও কোনো ক্ষতিপূরণ নেই। দ্বিতীয়ত, আমাদের সমাজব্যবস্থা এই সেক্টরের শ্রমিকদের যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে দেখে না যা তাদের নিরুৎসাহিত করে। তারা সৎ উপায়ে বেকারত্বের বোঝা কমিয়ে সমাজের জন্য কাজ করে গেলেও সমাজ থেকে পর্যাপ্ত গ্রহণযোগ্যতা ও সম্মান পান না। অনেকে তাদের বিভিন্নভাবে হেয়প্রতিপন্ন করে। যার ফলে অনেক শ্রমিক এই সেক্টর থেকে চলে যান।
আবার এ পেশায় যুক্ত হলেও অনেক শ্রমিক তাদের বন্ধু, আত্মীয়-স্বজনদের কাছে নিজেকে গিগ-ভিত্তিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হিসেবে পরিচয় দিতে পারেন না। তৃতীয়ত, দেশের পাঠ্যপুস্তকে এই সেক্টরের পেশাগুলো নিয়ে এখনো তেমন আলোকপাত করা হয় না। ফলে দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী এখনো জানেন না, তাদের জন্য কর্মসংস্থানের বিশাল দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। বিশেষত গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এই পেশা সম্পর্কে এখনো যথেষ্ট অবগত নন। ফলে অনেকে সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে, বেকারত্বের বোঝা ভারী করছেন। এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য সবার আগে সরকারকে শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য আইন প্রণয়ন করা উচিত, যেন গিগ-ওয়ার্ক শ্রমিকদের জন্য একটা নিরাপদ প্ল্যাটফর্ম হয়। অন্যদিকে এসব কাজের প্রতি সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি। যদি এই কাজকে যথাযোগ্য সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হয়, তাহলে অনেক শিক্ষিত তরুণ এ পেশায় যুক্ত হতে আগ্রহী হবেন। সমাজের সবার মধ্যে এ পেশাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া এবং এ পেশার সুবিধা সম্পর্কে সবাইকে অবগত করার জন্য পাঠ্যপুস্তকে এ বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। সর্বোপরি সব অসুবিধা দূরীভূত করে গিগ ইকোনমির মাধ্যমে বেকারত্বের অবসান হয়ে ‘জিরো বেকারত্ব’ ধারণার সফলতা আসবে এমনটাই প্রত্যাশা।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়