গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনীতির অর্থনৈতিক কর্মসূচি
আলাউদ্দীন মোহাম্মদ । সূত্র : বণিক বার্তা, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলন ও সামাজিক পরিবর্তনের মূল ভিত্তি ছিল সাম্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলন ও সামাজিক পরিবর্তনের মূল ভিত্তি ছিল সাম্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানও ছিল সেই ধারাবাহিকতার অংশ, যেখানে তরুণ প্রজন্ম রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে একটি ন্যায্য সমাজ গঠনের আহ্বান জানিয়েছে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ব্রিটিশ শাসন থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমল, এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য রয়ে গেছে। বৈষম্যের এ দুষ্টচক্র ভাঙতে গেলে গণ-আন্দোলনের পাশাপাশি প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত পরিবর্তন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসে দেখা যায়, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, অসম উন্নয়ন এবং রাজস্ব বণ্টনের অসংগতি বৈষম্যকে আরো তীব্র করেছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অযোগ্যতা ও দুর্নীতির কারণে সাধারণ জনগণ কাঙ্ক্ষিত সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ বাস্তবতায় এক নতুন অর্থনৈতিক রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তা আজ আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
জুলাই অভ্যুত্থান সেই আকাঙ্ক্ষারই বহিঃপ্রকাশ, যা তরুণদের নেতৃত্বে একটি সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখিয়েছে। এ প্রবন্ধে, আমরা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে বৈষম্যহীন রূপান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক নীতি ও করণীয় বিশ্লেষণ করব, যা বাংলাদেশকে একটি অধিকতর অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায্য সমাজের পথে এগিয়ে নিতে পারে।
বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক রূপান্তরের পথ অনুসন্ধান করতে হলে আমাদের যেতে হবে বেশকিছুটা পেছনে। ইতিহাসের পরতে পরতে যে বৈষম্যের চিত্র আঁকা রয়েছে, তার নিরসন কেবল বর্তমান বাস্তবতায় নয়, বরং অতীতের ঘটনাপ্রবাহের ধারাবাহিকতায় নিহিত। ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলা ছিল এক সমৃদ্ধ জনপদ। কলকাতায় রাজধানী স্থাপনের পর এখানকার ধনসম্পদ লুণ্ঠন করে তারা নিয়ে যায় ব্রিটেনে। কলকাতা যখন এক অবক্ষয়িত শহরে পরিণত হতে থাকে, তখন ব্রিটিশ শাসকরা রাজধানী স্থানান্তর করেন দিল্লিতে এবং বাংলাকে বিভক্ত করেন। পূর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে গঠন হয় নতুন প্রশাসনিক অঞ্চল, যা একদিকে কেন্দ্র ও প্রান্তিক অঞ্চলের বৈষম্য কমানোর প্রচেষ্টা হলেও অন্যদিকে তা ছিল একটি কৌশলগত বিভাজন। তবে তৎকালীন পশ্চিম বাংলার হিন্দু জমিদারদের বিরোধিতার কারণে এ বিভক্তি স্থায়ী হয়নি।
১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার মুসলমানরা আবারো নতুন এক স্বপ্নের মুখোমুখি হন, যেখানে তারা আশা করেছিলেন এক বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার, যেখানে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হবে। পাকিস্তানের অংশ হিসেবে পূর্ব বাংলার মানুষ ভেবেছিল তারা পাবে ন্যায্য অধিকার, কিন্তু বাস্তবে তারা নতুন এক শোষণ ব্যবস্থার শিকার হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলাকে শোষণের নীতিতে অটল থাকে, যার ফলে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য আরো প্রকট হয়। সেই বৈষম্যের প্রতিক্রিয়ায় ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। তবে স্বাধীনতার পর পরই নতুন এক চ্যালেঞ্জ সামনে আসে—ধনতন্ত্র বনাম সমাজতন্ত্রের আদর্শিক দ্বন্দ্ব। রক্তাক্ত প্রক্রিয়ায় সে দ্বন্দ্বের একতরফা নিরসন হলেও নীতি ও বাস্তবতার পার্থক্যের ফলে এখনো সমাজে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য বিদ্যমান।
২০২৪ সালের কোটা সংস্কার কেন্দ্র করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে যে গণ-অভ্যুত্থানের সূত্রপাত, তার মূল লক্ষ্য ছিল সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা। শিক্ষা ব্যবস্থা, কর্মসংস্থান, আয়, প্রশাসনিক কাঠামোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। আন্দোলনরত তরুণরা বিশ্বাস করেছিল, বিদ্যমান কাঠামো ভেঙে নতুন এক ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন, যা সব শ্রেণীর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করবে। এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক কাঠামো পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজনীয়তা সামনে আসে।
সম্প্রতি গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী তরুণরা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি রাজনৈতিক দল গঠনে উদ্যোগ নিয়েছে। নতুন রাজনৈতিক দলের প্রধান লক্ষ্য হতে হবে একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেয়া। বৈষম্যহীন সমাজ রূপান্তরের জন্য যে অর্থনৈতিক কর্মসূচি প্রয়োজন তার কিছুটা নিচে আলোকপাত করা হলো।
প্রথমত, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইগালিটারিয়ান বা সমতাবাদী করার উদ্যোগ নিতে হবে। জনক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে, যাতে সর্বক্ষেত্রে জনগণের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়। কেবল আইন ও নীতির পরিবর্তন নয়, বরং প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে এমন প্রতিষ্ঠান গঠন করতে হবে যাতে জনসাধারণের অংশগ্রহণমূলক শাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
দ্বিতীয়ত, সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার প্রসার ও স্বাস্থ্যসেবার সমতা না থাকলে সামাজিক বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয়। বিশেষত গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ও শহরের সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণীর জন্য উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার। উচ্চশিক্ষায় প্রবেশাধিকারকে আরো গণতান্ত্রিক করা প্রয়োজন, যাতে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে না পড়ে। একই সঙ্গে মৌলিক স্বাস্থ্যসেবাকে মানুষের অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে শ্রেণীভেদ দূর হয়।
তৃতীয়ত, রাজস্ব আহরণের কাঠামোতে বৈষম্য দূর করতে হবে। ধনীদের ওপর আনুপাতিক হারে কর আরোপ এবং গরিবদের জন্য কর রেয়াত সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থনীতির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। রাজস্ব ব্যবস্থায় বৈষম্য থাকলে সমাজে আয়বৈষম্য বাড়বে এবং ধনী-গরিবের ব্যবধান আরো গভীর হবে। নতুন রাজনৈতিক দলকে রাষ্ট্র পরিচালনায় তার রাজস্ব নীতিকে বৈষম্য নিরসনের হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
চতুর্থত, অঞ্চলভিত্তিক বৈষম্য দূরীকরণ অপরিহার্য। বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় (এডিপি) সব অঞ্চলের জন্য ন্যায্য বরাদ্দ নিশ্চিত করা না গেলে সামগ্রিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলোর জন্য বিশেষ উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে, যাতে সমগ্র দেশ সমভাবে অগ্রসর হতে পারে। রাজধানীকেন্দ্রিক উন্নয়ন মডেল বদলে বিকেন্দ্রীকৃত উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়ে নীতিনির্ধারণ করতে হবে।
পঞ্চমত, স্থানীয় সরকারের ব্যাপক ক্ষমতায়ন করা প্রয়োজন। কারণ গ্রামীণ ও প্রান্তিক মানুষের দৈনন্দিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে স্থানীয় সরকারের কাঠামো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শক্তিশালী স্থানীয় সরকারের অনুপস্থিতিতে ও জাতীয় সরকারের প্রাধান্যের কারণে বিভিন্ন অঞ্চলের উন্নয়ন অসমভাবে ঘটে। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করলে স্থানীয় জনগণের চাহিদা ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হবে। নতুন রাজনৈতিক দলকে বাজেট বরাদ্দ থেকে শুরু করে নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা বৃদ্ধি করার নীতি প্রণয়ন করতে হবে।
ষষ্ঠত, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয়েছে কর্মসংস্থানকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশের বৃহত্তর যুবসমাজের জন্য যথাযথ ও মানসম্মত কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা ব্যতীত বাংলাদেশ সামনে এগোবে না। নতুন অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে শিল্পায়ন, কৃষি ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে বিকশিত করে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বেকারত্ব দূর না হলে সামাজিক বৈষম্য আরো প্রকট হবে। এক্ষেত্রে বৃহৎ শিল্পে অর্থায়নের পলিসি পরিবর্তন করে দেশে স্বল্প মূলধনি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতে অর্থায়নের মাধ্যমে শিল্প সম্প্রসারণ করে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে।
সপ্তমত, শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করতে হবে। শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা ন্যায্য পারিশ্রমিক পায়। স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক সুরক্ষা ও বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত করতে হবে।
অষ্টমত, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করা জরুরি। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রান্তিক মানুষ ও বিশেষত নারী ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত ও নাজুক হয়। টেকসই উন্নয়নের জন্য পরিবেশবান্ধব নীতি গ্রহণ করতে হবে। জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের পাশাপাশি পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির উৎস ব্যবহার বাড়াতে পলিসি গ্রহণ করতে হবে।
নবমত, কৃষি খাত আধুনিকায়ন ও তরুণ প্রজন্মকে কৃষি উৎপাদনে উৎসাহী করার পলিসি গ্রহণ করতে হবে। দশমত, নতুন উদ্যোক্তাদের উৎপাদন পরিচালনার জন্য সাংগঠনিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সাংগঠনিক সক্ষমতার জন্য তাদের উন্নত ও দক্ষ শিল্পায়িত দেশগুলোয় প্রয়োজন হলে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বশেষ নতুন অর্থনৈতিক কর্মসূচি গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিত করা ভিন্ন বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দলের অর্থায়নে স্বচ্ছতা, অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র এবং নাগরিক অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত হলে সুশাসনে সহায়ক হবে।
বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের জন্য কেবল রাজনৈতিক সংকল্পই যথেষ্ট নয় বরং কার্যকর নীতিমালা ও পরিকল্পনা প্রয়োজন। রাষ্ট্রযন্ত্রের কাঠামোগত পরিবর্তন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্বিন্যাস এবং জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া এ রূপান্তর সম্ভব নয়। বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য সব শ্রেণীর মানুষের সমান সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি। গণতান্ত্রিক চেতনা, ন্যায্য নীতি ও নৈতিকতার ভিত্তিতে সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনই হবে আগামী দিনের সঠিক পথ।
আলাউদ্দীন মোহাম্মদ: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনীতি সম্পাদক, জাতীয় নাগরিক কমিটি