কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

গণঅভ্যুত্থান জুলাই ঘোষণাপত্রে জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে?

যোবায়ের আল মাহমুদ [সূত্র : সমকাল, ০৩ আগস্ট ২০২৫ ]

গণঅভ্যুত্থান জুলাই ঘোষণাপত্রে জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে?

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে জুলাই প্রোক্লেমেশন (ঘোষণাপত্র) ঘোষণার কথা জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ইতোমধ্যে তা নিশ্চিত করা হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজে। কিন্তু জুলাই প্রোক্লেমেশনের খসড়াটি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের জনআকাঙ্ক্ষা কতটুকু ধারণ করতে পারছে?

 

 

খসড়াতে পরিষ্কার দিকনির্দেশনা ও ভবিষ্যৎ রূপরেখার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রোক্লেমেশনটিতে কী করা হবে, কীভাবে করা হবে কিংবা ভবিষ্যৎ কোন পথ অনুসরণ করবে– সে বিষয়ে তেমন কিছু নেই। মনে হচ্ছে এটি একটি প্রোক্লেমেশন নয়, বরং একটি ঘটনাপঞ্জির বিবরণ মাত্র। প্রোক্লেমেশন মানেই ঘোষণা। এই খসড়ায় কোনো স্পষ্ট ঘোষণা নেই। যেমন গণসার্বভৌমত্ব ও ক্ষমতা কাঠামোর প্রশ্নে এই ড্রাফটে কোনো বৈপ্লবিক ঘোষণা নেই। এটি মূলত পুরোনো ডিক্লারেশনের পুনরাবৃত্তি মাত্র। তাহলে নতুন করে জুলাই প্রোক্লেমেশনের কী প্রয়োজন? 

 

 


১৯৭২-এর সংবিধানে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার কথা লিখিত থাকলেও একই সংবিধানের অন্য ধারায় ঔপনিবেশিক পুরোনা সব আইন বজায় রেখে, ঔপনিবেশিক ক্ষমতাবলয়-প্রশাসন বজায় রেখে মূলত সার্বভৌম ক্ষমতা রাষ্ট্র বা সরকারের এলিট অথরিটির কাছে তুলে দেওয়া হয়েছে সাংবিধানিকভাবে। ১৯৭৫-এর সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান বাকশাল দূর করে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ধারায় উত্তরণে সাহায্য করলেও ঔপনিবেশিক আইন-কাঠামো-প্রশাসন যেমন অক্ষত রয়ে যায়, একই সঙ্গে ’৭২-এর সংবিধানের নির্বাহী বিভাগকেন্দ্রিক স্বৈরতন্ত্র দূর করতেও তা ব্যর্থ হয়। 

 

 

’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর তিন জোটের যে সংস্কার প্রস্তাব ছিল, সেখানেও গণসার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার কোনো রূপরেখা ছিল না। বরং স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল ফেয়ার ইলেকশনের মাধ্যমে সার্বভৌম সংসদ গড়তে হবে। অর্থাৎ ’৭২-এর সংবিধানের সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্রকে অক্ষত রেখে পার্লামেন্টকে সার্বভৌম ঘোষণা করে দেশে পার্লামেন্টারি স্বৈরতন্ত্র এবং পার্লামেন্টারি ক্লেপ্টোক্রেসির পথ সুগম করা হয়। তাই গণসার্বভৌমত্বভিত্তিক একটি রিপাবলিক গড়তে হলে জুলাই ঘোষণাপত্রে ঘোষণা দিতে হবে, বিদ্যমান ঔপনিবেশিক এবং ফ্যাসিস্ট সংবিধান বাংলাদেশের নাগরিকদের মানবাধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, মর্যাদা এবং বিকাশের নিশ্চয়তা এবং সুরক্ষা দিতে শুধু ব্যর্থই হয়নি; বরং সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র ও সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদের আইনি-রাজনৈতিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে জননিপীড়নকে রাষ্ট্রের রুটিন ওয়ার্কে পরিণত করেছে বিধায় এই সংবিধান বাতিল করে একটি নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন অপরিহার্য। অথচ জুলাই প্রোক্লেমেশনের ২৫তম দফায় শুধু সংবিধান সংস্কারের কথা বলা হয়ছে।

 

 

জুলাই প্রোক্লেমেশনে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করতে হবে যে– ১. রাষ্ট্র, সরকার, পার্লামেন্ট নয়, সার্বভৌমত্ব হবে জনগণের ও ব্যক্তির এবং ২. রাষ্ট্র, সরকার, পার্লামেন্ট, প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের সব আইনি, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কাজের কেন্দ্র হবে নাগরিক অধিকার, মর্যাদা ও বিকাশের জন্য কাজ করা এবং ৩. ১ ও ২ প্রতিষ্ঠার জন্য ঔপনিবেশিক আইন-কাঠামো বাতিল, সংসদীয় নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র এবং প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র উভয়কেই স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। রাষ্ট্র, সরকার বা পার্লামেন্টের হাতে সার্বভৌমত্ব রেখে গণসার্বভৌমত্বভিত্তিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা যে সম্ভব না, তা যদি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরও আমরা বুঝতে না পারি এবং জুলাই প্রোক্লেমেশনে যদি গণসার্বভৌমত্বভিত্তিক নতুন গঠনতন্ত্র তৈরির ঘোষণা না দেওয়া যায়, তাহলে এই প্রোক্লেমেশনের কোনো জরুরত বা উপযোগিতা আছে বলে আমি মনে করি না। 

 

 

এই ঘোষণাপত্রের পাঁচটি ধাপে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কার করে আইনের শাসন, মানবাধিকার, দুর্নীতি, শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা থাকলেও তা কীভাবে করা হবে, এর কোনো সুস্পষ্ট ঘোষণা নেই। যেমন ড্রাফটে স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো উচ্ছেদের স্পষ্ট কার্যকর নির্দেশনা নেই। প্রোক্লেমেশনটিতে কোথাও বলা হয়নি যে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান, আইন ও প্রশাসন থেকে ফ্যাসিবাদী উপাদান ও কাঠামো সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা হবে। এটির ঘোষণা না থাকলে মুক্তির কথা শুধুই মুখের বুলি। যেই আইন ও ক্ষমতা কাঠামোর ভিত্তিতে স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো পুষ্ট হয়েছে, তা দূর করার স্পেসিফিক কিছু নেই এখানে। জুলাই ঘোষণাপত্রে (দফা ২৪) গুম-খুন-আয়নাঘর-নির্বিচার গুলি-হত্যাযজ্ঞের বিচারের কথা উল্লেখ থাকলেও এসব বন্ধ করার জন্য জবরদস্তিমূলক বলপ্রয়োগের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রযন্ত্রকে খোলনলচে উপড়ে ফেলে পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা, নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর আমূল সংস্কারের ব্যাপারে স্পষ্ট ঘোষণা নেই।

 

 

ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রযন্ত্র ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা এবং জনগণের অধিকারকেন্দ্রিক প্রশাসনিক কাঠামো তৈরির ব্যাপারে কিছুই নেই জুলাই ঘোষণাপত্রে। যেমন  র‍্যাব ও এনটিএমসির মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত, ডিজিএফআইর কর্মকাণ্ড সীমিত, সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ, সামরিক ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর গণতান্ত্রিক জবাবদিহি নিশ্চিত করার ব্যাপারে কোনো কিছুই নেই জুলাই ঘোষণাতে। ঔপনিবেশিক কাঠামো উচ্ছেদ নিয়ে নীরবতা এই ঘোষণাপত্রকে দুর্বল করে দিয়েছে। ১৯৪৮, ১৯৭২ ও ১৯৯১ সালে আমরা ঔপনিবেশিক প্রশাসন, আমলাতন্ত্র ও দমনমূলক আইন উচ্ছেদ বা বাতিল করতে ব্যর্থ হয়েছি। ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন, ১৮৮৯ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৯৭৪ সালের স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট, ২০০৩ সালের র‍্যাব আইন– এগুলোসহ সব ধরনের দমনমূলক আইন অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। এই আইনগুলো বিলুপ্ত না করে কোনো রিপাবলিক গঠন সম্ভব নয়। অথচ খসড়ায় এ নিয়ে একটি কথাও নেই। এর অর্থ হলো, জবরদস্তিমূলক বলপ্রয়োগের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রযন্ত্র অক্ষত রয়ে যাচ্ছে।

 

 

 

ঘোষণাপত্রে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে গণভোটের ঘোষণা নেই। সংসদীয় কাজের ওপর জনগণের সার্বভৌমত্বের নজরদারি থাকতে হবে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোয় গণভোটের মাধ্যমে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া গণতন্ত্র অসম্পূর্ণ। এই খসড়াতে স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণের রূপরেখা নেই। বিকেন্দ্রীভূত, ক্ষমতায়নকৃত ও জনগণের অংশগ্রহণভিত্তিক স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে কিছুই নেই জুলাই ঘোষণাপত্রে। ঘোষণাপত্রে উল্লেখ থাকা দরকার, উন্নয়নমূলক কাজ পরিচালনা করবে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার; সংসদ সদস্যরা নন। সংসদ সদস্যরা শুধু আইন প্রণয়ন ও নির্বাহী সংস্থার কার্যক্রমের নজরদারি করবেন। এই ক্ষমতার বিভাজন গণতান্ত্রিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

 

শোষণ-জুলুম জারি রাখার ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র, মাফিয়া বিজনেস অলিগার্ক-নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক কাঠামো, মাফিয়া গোয়েন্দা সংস্থা, পার্লামেন্টারি স্বৈরতন্ত্র, পার্লামেন্টারি ক্লেপ্টোক্রেসি, নিবর্তনমূলক আইনকানুন, গণনিপীড়নের হাতিয়ার পুলিশ আইন, গণসার্বভৌমত্ব বিবর্জিত এলিট শাসন প্রণালির সংবিধান, নাগরিক অধিকারহীন রাষ্ট্রকাঠামো বাতিল করে একটি গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র তৈরির রূপরেখা দরকার ছিল; যেন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাম্য, ব্যক্তির অধিকার, মর্যাদা ও বিকাশকে নিশ্চিত করা প্রশাসন-রাষ্ট্র-রাজনীতির প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায়; অর্থাৎ একটি বুর্জোয়া রিপাবলিক গঠনের রূপরেখা জুলাই প্রোক্লেমেশন হিসেবে ঘোষণা করা দরকার ছিল। যদি জুলাই প্রোক্লেমেশন ইতিহাসে কোনো গুরুত্ব পেতে চায় কিংবা বৈপ্লবিক বৈধতা দাবি করতে চায়, তাহলে এটি পুরোনো ডিক্লারেশনের পুনরাবৃত্তি হতে পারে না। এটি স্পষ্টভাবে ঘোষণা দিতে হবে যে ঔপনিবেশিক, ফ্যাসিবাদী ও লুটেরা শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে চূড়ান্ত বিচ্ছেদ ঘটেছে এবং জনগণের সার্বভৌমত্ব, নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর ভিত্তিতে একটি রিপাবলিক গঠনের দিকেই জাতি অগ্রসর হচ্ছে।

 

 

যোবায়ের আল মাহমুদ: সহযোগী অধ্যাপক, ফার্মাসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়