কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

গণতান্ত্রিক কাঠামো কর্তৃত্ববাদ প্রতিরোধে সহায়ক

প্রতীক্ষিত জুলাই ঘোষণার পর প্রস্তাবিত সনদের ওপর সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর ঈপ্সিত সমঝোতা বাংলাদেশের সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনীর সম্ভাবনা জাগায়। এ সনদ আগত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অনুঘটক। ড. আল মাসুদ হাসানউজ্জামান [সূত্র : বণিকবার্তা, ২০ আগস্ট ২০২৫]

গণতান্ত্রিক কাঠামো কর্তৃত্ববাদ প্রতিরোধে সহায়ক

প্রতীক্ষিত জুলাই ঘোষণার পর প্রস্তাবিত সনদের ওপর সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর ঈপ্সিত সমঝোতা বাংলাদেশের সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনীর সম্ভাবনা জাগায়। এ সনদ আগত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অনুঘটক। এটি এ দেশের রাজনীতিচর্চায় প্রভাব বিস্তারের ইঙ্গিতবাহী। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্র নির্মিত হলে তা কর্তৃত্ববাদী কাঠামোর অবসান ও গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা বা অবদান রাখতে পারে।

গণতান্ত্রিক কাঠামোয় রাষ্ট্রের প্রধান তিনটি অঙ্গ যেমন নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগের পারস্পরিক ক্ষমতা সম্পর্কের সমন্বয় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বস্তুত অভিজ্ঞতা হলো যে প্রায় সব রাষ্ট্রে নির্বাহীর কর্তৃত্ব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে। প্রকৃত নির্বাহীকে নিয়ন্ত্রণে আনা বা জবাবদিহির আওতায় আনা সমস্যাসংকুল হয়েছে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে। কারণ নির্বাহী ক্ষমতা বাড়ছে। এ চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশেও ব্যাপকভাবে প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। এখন কর্তৃত্ববাদী সরকার বিদায়ের পর যে নতুন কাঠামো নির্মাণের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে তা আশাব্যঞ্জক। তবে তার কার্যকর বাস্তবায়ন অবস্থাদৃষ্টে রীতিমতো চ্যালেঞ্জিং। প্রত্যাশা হলো নির্বাচন-পরবর্তী যে রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করবে তাদের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে জনআকাঙ্ক্ষার প্রেক্ষাপটে। জুলাই সনদ কাঠামোগত পরিবর্তনের কথা তুলতে যাচ্ছে বা জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটাতে পারে। জুলাই ঘোষণাপত্র সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো মিশ্র প্রতিক্রিয়াসহ স্বাগত জানিয়েছে এবং কয়েকটি বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি দাবি করেছে। প্রস্তাবিত জুলাই সনদে যে কাঠামোগত সংস্কারের উল্লেখ রয়েছে তা নিয়ে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক মতবিরোধ দৃশ্যমান। সম্মতি এবং ক্ষেত্রবিশেষে ‘‌নোট অব ডিসেন্ট’ পরিলক্ষিত হয়েছে। বিরোধ বা মতপার্থক্য নিরসন করে সমঝোতা নির্মাণ দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং রাজনীতির স্বার্থে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নয়তো আগামীর রাজনীতি সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। দেশে কীভাবে এবং কোন প্রক্রিয়ায় রাজনীতি চর্চিত হবে তাও দলিলভুক্ত হলে মঙ্গল। রাজনীতি চর্চায় সহনশীলতার বিকল্প নেই। রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরকে শত্রু হিসেবে গণ্য না করে তারা প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে থাকবে। দেশের জাতীয় স্বার্থে এবং রাষ্ট্রের মৌল বিষয়ে একমত পোষণ করবে। তবে অন্যান্য প্রসঙ্গে মতানৈক্য থেকে যাবে, যা খুবই স্বাভাবিক। বলাবাহুল্য যে জাতীয় নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সর্বদলীয় ঐকমত্য একান্তভাবে বাঞ্ছনীয়। এর সঙ্গে দেশের সার্বভৌমত্ব অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আমাদের দেশে ঐকমত্যে পৌঁছার বিষয়টি রীতিমতো কঠিন। কারণ এতদিন ধরে যে রাজনীতি চর্চা করা হয়েছে তাতে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সংকীর্ণতা প্রকাশ পেয়েছে। সংকীর্ণ ও দ্বান্দ্বিক বা সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি সুষ্ঠু রাজনীতির প্রতি প্রত্যক্ষ হুমকি। সুষ্ঠু ও কার্যকর রাজনৈতিক সংস্কৃতির অনুঘটক হচ্ছে সহনশীল পরিবেশ ও পারস্পরিক আস্থা।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অবাধ ও সুষ্ঠুতার ওপর গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা, সুষ্ঠু প্রতিনিধিত্বশীলতা এবং কার্যকর সংসদ নির্মাণ নির্ভরশীল। ১৯৯১-পরবর্তী সময়ে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল, যারা পরম্পরায় সরকার গঠন করেছিল, তাদের মধ্যকার সাংঘর্ষিক সম্পর্কের প্রভাব দেশের রাজনীতি, সংসদের কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হয়েছে। সংসদে কাদা ছোড়াছুড়ি ও অতীতের বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব সংসদীয় কর্মঘণ্টাকে বিনষ্ট করার পর্যায়ে নিয়ে যায়। সংসদে আইন প্রণয়ন, বাজেট ঘোষণা ও সংসদীয় তদারকি সরকারি দলের করায়ত্ত থাকে। বিরোধী দলের ওয়াকআউট একপর্যায়ে বয়কটে রূপ নেয়। প্রধান বিরোধী পক্ষকে কথা বলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ ওঠে। সংসদের স্পিকারের পক্ষপাতমূলক আচরণও দৃষ্টিগোচর হয়। সংসদীয় কমিটি ব্যবস্থায়ও সরকারি দলের প্রাধান্য একইভাবে দৃশ্যমান হয় এবং কমিটি চেয়ার হিসেবে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ খুবই সীমিত পর্যায়ে থেকে যায়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী কৃত একদলীয় সংসদেও কোরাম সংকট দেখা দেয়। নির্বাহীর কর্মকাণ্ডের সুষ্ঠু তদারকি এবং জন আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো দুষ্কর হয়ে ওঠে। কাজেই অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। আগত সুষ্ঠু নির্বাচন, সুষ্ঠু প্রতিনিধিত্ব এবং সুষ্ঠু পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা যে গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

 

 

 

বস্তুত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং দৈনন্দিন সিদ্ধান্ত নির্বাহীনির্ভর। দেশের প্রকৃত নির্বাহী যেন একাধিক পদ আঁকড়ে ধরে না রাখেন সেদিকে নজর রাখা জরুরি। তিনি একাধিক পদে থাকলে স্বেচ্ছাচারমূলক সিদ্ধান্ত আসতে পারে। কাজেই শাসন বিভাগ ও সরকারের অন্যান্য বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য এবং চেক অ্যান্ড ব্যালান্স থাকা দরকার। আমরা জানি যে সংসদীয় গণতন্ত্রে নির্বাহী ও সংসদ একই সূত্রে গাঁথা। কারণ সংসদের বর্ধিত অংশই হচ্ছে নির্বাহী বিভাগ। প্রধানমন্ত্রী বা তার মন্ত্রীমণ্ডলী সবাই কিন্তু একেকজন সংসদ সদস্য। একইভাবে সরকারে থাকলেও তারা সংসদে জবাবদিহি করতে বাধ্য। জাতীয় সংসদ তার তদারকি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ ও প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রয়াস পায়। সংসদীয় তদারকি ক্ষমতার ভারসাম্য নির্মাণে নিঃসন্দেহে ভূমিকা রাখে।

 

অন্যদিকে স্বাধীন বিচার বিভাগ হলো গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অন্যতম ভূমিকা পালনকারী। তবে এ দেশে অতীতে সুষ্ঠু জুডিশিয়াল গভর্ন্যান্সের ঘাটতি লক্ষণীয় হয়েছে। বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহীর নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ ওঠানো হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কাম্য নয়। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ পৃথক্‌করণ জরুরি। এ বিভাগের ওপর কোনো রকম হস্তক্ষেপ না করাসহ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত হবে।

 

 

গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান স্টেকহোল্ডার হচ্ছে রাজনৈতিক দল। বর্তমানে যেসব রাষ্ট্রীয় সংস্কারের পদক্ষেপ বাস্তবে ঘটানোর প্রচেষ্টা চলছে তা কোনোভাবেই সফল হবে না, যদি না রাজনৈতিক দলগুলো একক এবং যৌথভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র এবং অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্তগ্রহণ দলীয় সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক। প্রতিটি দলের কর্মকাণ্ড যেন দেশের সংবিধান ও দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চলে তার নিশ্চয়তা বিধান আবশ্যক। বিগত সময়ে নির্বাচনে দলে মনোনয়ন বাণিজ্য এবং নেতানির্ভর মনোনয়ন দান ঘটে। দলীয় কাঠামোর প্রতিটি স্তরে নির্বাচনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ঠিকমতো দলীয় কনভেনশন হয়নি। দলে টপ-ডাউন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। দলের অর্থায়নও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে হওয়া বাঞ্ছনীয়। দলে অর্থের ও পেশি শক্তির বিনিময়ে মনোনয়ন দান বন্ধ করতে হবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে আন্তঃদলীয় সম্পর্ক, যা বরাবর সংঘাতপূর্ণ ছিল। নতুন প্রেক্ষাপটে সহনশীল আন্তঃদলীয় সম্পর্ক বিশেষভাবে প্রয়োজন। নির্বাচনী মাঠে সমসুযোগ বা সমতা আনা খুবই জরুরি।

 

 

আগত নিবার্চনকে সামনে রেখে আরপিও তথা গণপ্রতিনিধিত্বশীল আদেশে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও তার পূর্ণ প্রয়োগ ও বাধ্যবাধকতা গুরুত্ববাহী। দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারীর রাজনীতিতে ও প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানে যথাযথ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা দরকার। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে মনোনয়ন দানে নারীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। রাজনীতি ও গভর্ন্যান্সে নারী অংশগ্রহণের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের পথ বের করতে হবে এবং নারীর ক্ষমতায়ন ঘটাতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীসহ দেশের সামাজিক বৈচিত্র্যের প্রকাশ ঘটাতে হবে।

 

 

আরেকটি বিষয় হলো নিরপেক্ষ সিভিল সোসাইটির দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন। নব প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রচর্চায় সিভিল সোসাইটির সুষ্ঠু ও কার্যকরভাবে জনগণের দাবিদাওয়া ও চাহিদার প্রকাশ ঘটাতে সহায়ক হওয়ার বিকল্প নেই। অতীতে দেখা গেছে যে সিভিল সোসাইটি বড় দলগুলোর পক্ষ নিয়েছে, যা নিন্দনীয়। এভাবে যদি কোনো দলের হয়ে পক্ষপাতিত্ব করে তবে তাকে কোনোভাবেই সিভিল সোসাইটি বলা যাবে না। প্রকৃতপক্ষে সিভিল সোসাইটির নিরপেক্ষতা এবং সুষ্ঠু রাজনীতিচর্চায় ইনপুট প্রদান এবং থিংক ট্যাংকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয়।

 

 

একইভাবে গণমাধ্যম হচ্ছে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। তাই গণমাধ্যমের সঙ্গে গণতন্ত্রচর্চা, নির্মাণ ও সুষ্ঠু রাজনীতির ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। সংবাদপত্র এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া সত্যকে বের করে আনবে, গণতন্ত্রের কাঠামোগত সমস্যা ইত্যাদি ব্যাপারে অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি রচনা জরুরি। জন ইচ্ছার বা চাহিদার প্রকাশ সংবাদমাধ্যম নিত্যদিন ব্যক্ত করবে। বস্তুত নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সর্বত্র বিচরণশীল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনমতের প্রতিফলন ঘটানো দরকার। তবে একই সঙ্গে গণমাধ্যমের নেতিবাচক ব্যবহার পরিহার করা আবশ্যক।

 

 

রাষ্ট্রকে সুপথে পরিচালনা করার জন্য আমাদের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ রয়েছে। মতৈক্যের মাধ্যমে যেসব কাঠামোগত সংশোধনী রচিত হবে তার কার্যকর বাস্তবায়ন জরুরি। ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জগুলো সম্মিলিতভাবে মোকাবেলা করতে হবে। চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে তরুণ সমাজের ব্যাপক অংশগ্রহণ রয়েছে। তরুণরা সমাজের বিশাল অংশ। আগামীর বাংলাদেশের হাল ধরবে তারাই। গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় তরুণদের যথাযথ সামাজিকীকরণসহ তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটানো দরকার। সব মিলিয়ে সর্ব-অন্তর্ভুক্তিমূলক কাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা যেন ভবিষ্যতের কর্মনির্ধারক হয়ে ওঠে এবং তদনুযায়ী আশু পদক্ষেপ গ্রহণের দিকে দেশবাসীর দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে।

 

 

ড. আল মাসুদ হাসানউজ্জামান: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়