গণতান্ত্রিক উত্তরণে উভয় সংকটে বাংলাদেশ
সূত্র : যুগান্তর, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫

গণতান্ত্রিক উত্তরণের যাত্রায় বাংলাদেশ এক উভয় সংকটে রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি)। ‘বাংলাদেশ : দি ডিলেমাস অব অ্যা ডেমোক্রেটিক ট্রানজিশন’ শিরোনামের প্রতিবেদনে আইসিজি বলছে, জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় যত এগোচ্ছে, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার তার প্রতিশ্রুত সংস্কারকাজ শেষ করতে তত চাপের মুখে পড়ছে। রাজনৈতিক দলগুলো ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ সংস্কার নিয়ে দরকষাকষি এবং নির্বাচনের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠায় এ বছর বাংলাদেশে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ বাড়তে পারে বলে মনে করে আইসিজি।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং এর সদস্য দেশগুলো কোথায় শান্তির সম্ভাবনা বাড়াতে পারে, তা চিহ্নিত করে প্রতি বছর ক্রাইসিস গ্রুপ একটি ‘ইইউ ওয়াচলিস্ট’ বা ‘ইইউ পর্যবেক্ষণ তালিকা’ প্রকাশ করে থাকে। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এ বছরের তালিকায় মলদোভা, কলম্বিয়া, উত্তর কোরিয়া, সুদান, গ্রেট লেকস, ইউক্রেন, সিরিয়া, ইসরাইল-ফিলিস্তিন এবং ইরানের পাশাপাশি বাংলাদেশও রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘শেখ হাসিনার পতনের পরপর অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন পক্ষের যে অকুণ্ঠ সমর্থন পাচ্ছিল তাতে ভাটা পড়তে শুরু করেছে। এই অবস্থায়, উপযুক্ত ফলাফল দেওয়ার চাপের মধ্যে আছেন ড. ইউনূস। সরকার রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যকার বিভেদ নিরসনে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। আবার সরকার পরিচালনার দৈনন্দিন নানা বিষয়েও সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছে।’
প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের টানাপোড়েনের বিষয়টিও তুলে ধরেছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ। আইসিজি বলেছে, শেখ হাসিনার সরকার পতনের আগ পর্যন্ত তাকে কট্টরভাবে সমর্থন দিয়েছে ভারত। বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা রক্ষায় যা আরেকটি বাধা। এদিকে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে সহায়তার ব্যবস্থাপনার ভার নিতে হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারকে, একই সঙ্গে যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্তে অস্থিতিশীলতাকেও মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমার ও বাংলাদেশ-বিষয়ক সিনিয়র কনসালট্যান্ট থমাস কিয়ান বলেন, ‘জিনিসপত্রের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির কারণেও অন্তর্বর্তী সরকার চাপে রয়েছে, যা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অব্যবস্থাপনার উত্তরাধিকার হিসাবে তারা পেয়েছে। আর অর্থনীতিকে আবার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চলমান প্রচেষ্টার সুফল বাংলাদেশের জনগণের বাস্তবে পেতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে এখনো টানাপোড়েন রয়েছে, আর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অদূর ভবিষ্যতে যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ।’
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার প্রচেষ্টার বিষয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করেন কিয়ান। তিনি বলেন, ‘এরপরও আগামী বছর বাংলাদেশের সামনে জাতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন এবং একে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জবাবদিহিমূলক করার একটি বিরল সুযোগ রয়েছে। এই লক্ষ্যে সংস্কার কমিশনগুলো কয়েকশ প্রস্তাব সংবলিত প্রতিবেদন জমা দিতে শুরু করেছে।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচনি রাজনীতিতে বাংলাদেশের জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কার প্রক্রিয়ায় সমর্থন ও অন্তর্বর্তী সরকার যাতে দেশকে একটি জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়, সেটা নিশ্চিত করতে আলাপ-আলোচনা, কারিগরি ও আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে বিদেশি অংশীদারদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।’
এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক উত্তরণে সমর্থন দেওয়ার ও অত্যন্ত গুরুত্বের ভূ-রাজনৈতিক একটি অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদারের (বাংলাদেশ) সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে ইইউর সামনে বিরল সুযোগ এনে দিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে সমর্থন দেওয়ার জন্য ইইউ ও এর সদস্য দেশগুলোর জন্য বেশ কিছু সুপারিশ করেছে আইসিজি। এর মধ্যে রয়েছে-
সম্পদ পুনরুদ্ধার : হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠদের অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করা। এসব সম্পদের বেশিরভাগই ইউরোপে।
কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা : আ.লীগ শাসন আমলে নিজের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করে এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন করার জন্য নয়াদিল্লিকে উদ্বুদ্ধ করে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে সহয়তা করা। ভারতের এই পরিবর্তন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান ভারতবিরোধী মনোভাব প্রশমিত করতে সহায়ত করবে।
মানবিক সহায়তা : রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটে মানবিক সহায়তার জন্য জোরালো সমর্থন বজায় রাখা। আন্তর্জাতিক সহায়তা তহবিল হ্রাস পেলেও, ইইউ সেখানে এখনো উল্লেখযোগ্য দাতা হিসাবে রয়েছে। সদস্য দেশগুলোকে তাদের অবদান বাড়াতে এবং আরও শরণার্থীদের পুনর্বাসন করতে উৎসাহিত করতে হবে।
শরণার্থী নীতি : শরণার্থীদের স্বনির্ভরতা বৃদ্ধির নীতি গ্রহণ করতে এবং প্রয়োজনীয় পরিষেবা সরবরাহের ব্যয় হ্রাসে ঢাকার সঙ্গে কাজ করতে হবে। ২০২৫ সালের পরে একটি উচ্চ-পর্যায়ের রোহিঙ্গা সম্মেলন আহ্বানে বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করতে হবে এবং যেকোনো প্রত্যাবাসন পরিকল্পনার জন্য আরাকান সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ত করার জন্য উৎসাহিত করতে হবে।
আইসিজি বিশ্বে বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবের কথাও উল্লেখ করেছে, বিশেষ করে মার্কিন সাহায্য বাজেটে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রত্যাশিত কাটছাঁটের সম্ভাব্য প্রভাবের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘মার্কিন সহায়তা হ্রাসের কারণে ইউরোপীয় তহবিল আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।’