কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জসমূহ

মিজানুর রহমান মিজান । সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ জানুয়ারি ২০২৫

গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জসমূহ

গণতন্ত্র এমন একটি শাসনব্যবস্থা, যা জনগণের শাসন, জনগণের জন্য এবং জনগণের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি একটি আদর্শ ব্যবস্থা, যা মানুষের মৌলিক অধিকার, স্বাধীনতা এবং সমতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য অপরিহার্য। গণতন্ত্র কেবল একটি শাসনব্যবস্থা নয়, বরং এটি মানুষের মুক্তি, মর্যাদা ও উন্নতির একটি পথপ্রদর্শক। আধুনিক পৃথিবীতে গণতন্ত্রের প্রভাব নিঃসন্দেহে ব্যাপক এবং তা শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তার অনস্বীকার্য গুরুত্ব রয়েছে।

গণতন্ত্র মানুষের মৌলিক অধিকার, স্বতন্ত্র চিন্তা, বাকস্বাধীনতা এবং আইনের শাসনকে গুরুত্ব দিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ, সমান ও উন্নত সমাজ গঠনের পক্ষে অবদান রাখে। এমন একটি শাসনব্যবস্থা জনগণের মধ্যে শ্রদ্ধা, সহানুভূতি এবং সহযোগিতার পরিবেশ তৈরি করে, যা কেবল একটি দেশেই নয়, বরং পুরো বিশ্বে সমৃদ্ধি ও শান্তির বীজ রোপণ করে। কারণ গণতন্ত্রের মূল আদর্শ মানুষের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা। গণতন্ত্রের মূল ধারণাটি হলো জনগণের ক্ষমতায় অধিকার। এই শাসনব্যবস্থায় নাগরিকরা নিজেরা বা নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে সরকার পরিচালনায় অংশগ্রহণ করেন। এটা এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে মানুষের মতামত শাসন ব্যবস্থায় প্রতিফলিত হয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় জনগণের ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানানো হয়। তাই এর মূল স্তম্ভ হলো বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ভোটাধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা, আইনের শাসন এবং মানুষের মৌলিক অধিকার।

গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো জনগণের রাজনৈতিক স্বাধীনতা। এটি নাগরিকদের তাদের ইচ্ছামতো প্রতিনিধিদের নির্বাচন করার, সরকারের প্রতি তাদের মতামত প্রকাশ করার এবং সরকারের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করার সুযোগ প্রদান করে। এর ফলে, রাজনৈতিক সত্তার স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠিত হয়, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়, যেমন বাকস্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা। এই সব অধিকার মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও শ্রদ্ধা প্রতিষ্ঠা করে, যা অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রায়শই হুমকির মুখে পড়ে।

গণতন্ত্র শুধু রাজনৈতিক ব্যবস্থা নয়, এটি একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিপূরকও। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সাধারণত আরো বেশি সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, শ্রম অধিকার এবং নারী- পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা হয়। গণতান্ত্রিক সমাজে জনগণের মধ্যে নিজেদের মতপ্রকাশের অধিকার এবং স্বতন্ত্র চিন্তা ও মতাদর্শের পরিপুরক পরিবেশ থাকে, যা মানুষের সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনাকে উৎসাহিত করে। গণতন্ত্রে বিভিন্ন জাতিগত, ভাষাগত ও ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর অধিকার সংরক্ষিত হয়, এবং তাদের মধ্যে সহানুভূতি, সৌহার্দ্য এবং সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়।

অন্যদিকে, অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সাধারণত উন্নয়ন একতরফাভাবে পরিচালিত হয় এবং তা জনগণের চাহিদা ও বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। এতে জাতির সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা কঠিন হয়ে পড়ে। এবং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন সম্ভব হয় না। তাছাড়া বিশ্বময় শান্তি এবং সহযোগিতার জন্য গণতন্ত্র অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জনগণ স্বাভাবিকভাবে যেহেতু তাদের দেশের শাসনব্যবস্থা এবং বিদেশি সম্পর্কের প্রতি অবগত থাকে এবং তারা নিজেদের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা পায়, তাতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলো সাধারণত শান্তিপূর্ণ এবং সহযোগিতামূলক হয়ে ওঠে। অন্যদিকে, একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থাগুলিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবিশ্বাস এবং সংঘর্ষের প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এমনকি, এই শাসনব্যবস্থাগুলো প্রায়শ তাদের জনগণের মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে, যা আন্তর্জাতিক চাপ এবং অবরোধের সৃষ্টি করতে পারে। এইভাবে, গণতন্ত্র বিশ্বে শান্তি এবং সমতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

যদিও গণতন্ত্র একটি অত্যন্ত কার্যকর ব্যবস্থা, তবুও এর সফলতা কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। আজকের বিশ্বের অনেক দেশ গণতন্ত্রের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও তা বাস্তবায়নে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো রাজনৈতিক বিভাজন, দুর্নীতি, নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য। গণতন্ত্র যখন অপ্রতুল গণমাধ্যম, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বা আইনের শাসনের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন তা জনগণের আস্থাহীনতা সৃষ্টি করতে পারে এবং এতে দেশের শাসনব্যবস্থার গুণমান হ্রাস পেতে পারে। এছাড়া গণতন্ত্রে জনগণের মতামতকে সমর্থন দেওয়ার প্রক্রিয়া কখনো কখনো সময়সাপেক্ষ এবং জটিল হতে পারে। জনগণের চাহিদা ও অভিযোগের সঠিকভাবে প্রতিফলন না হলে তা সরকারের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতার সৃষ্টি করতে পারে, যা গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভকেই বিপন্ন করে তুলতে পারে।

সর্বোপরি, গণতন্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো-রাজনৈতিক দুর্নীতি, বৈষম্য, এবং মধ্যে মধ্যে স্বাধীনতা হরণ। কিন্তু তার পরও গণতন্ত্রের মৌলিক নীতিগুলো মানবাধিকার, শান্তি এবং আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। অতএব, বিশ্বের প্রতিটি দেশের জন্য গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। গণতন্ত্র যদি যথাযথভাবে কাজ করে, তবে এটি সমাজে শান্তি, ন্যায় এবং সমৃদ্ধি বয়ে আনবে, যা শেষ পর্যন্ত মানবতার জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যতের সূচনা করবে। তাই গণতন্ত্রের প্রতি আমাদের গভীর আস্থা, শ্রদ্ধা এবং প্রতিশ্রুতি একান্তভাবে প্রয়োজনীয়, যেন আগামী প্রজন্ম শান্তি, সমৃদ্ধি এবং মানবিক মর্যাদায় এগিয়ে যেতে পারে।