কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

গণভোট : প্রয়োজন, নাকি বিভ্রান্তি

শেখ রফিক [সূত্র : কালের কণ্ঠ, ৩০ নভেম্বর ২০২৫]

গণভোট : প্রয়োজন, নাকি বিভ্রান্তি

গণভোটকে গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। এটি সরাসরি জনগণের মতকে সরকার ও নীতিনির্ধারণে প্রতিফলিত করার সুযোগ দেয়। কিন্তু গণভোট কার্যকর হওয়ার জন্য যে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ প্রয়োজন, তা বর্তমানে বাংলাদেশে অনুপস্থিত। গণভোট আয়োজন করতে গেলে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ভোটব্যবস্থা অপরিহার্য।

 
 
রাজনৈতিক আস্থার অভাব একটি গভীর সংকট। দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচনী ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের আস্থা নেই। মানুষ প্রায়ই মনে করে ভোটের ফলাফল আগে থেকেই নির্ধারিত। এমন অবস্থায় গণভোটের আয়োজন মানে ভোটারদের ওপর নতুন চাপ সৃষ্টি করা।

 

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। প্রশাসন, পুলিশ, নির্বাচন কমিশন—সবই রাজনৈতিক দলের প্রভাবের অধীনে। গণভোটের পরিবেশ যদি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ না হয়, তাহলে এটি রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হবে, সমাধানের হাতিয়ার হিসেবে নয়। যেখানে প্রশাসন স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে পারে না, সেখানে গণভোটের ফলাফল কখনোই জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন হতে পারে না।

 

 

বাংলাদেশে নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রভিত্তিক চাপ, হুমকি, ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক উসকানি, বিভ্রান্তিকর প্রচারণা—সব মিলিয়ে ভোটারদের সচেতন ও নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। ভোটাররা ভয় পান যে ভোট দিলে তাঁদের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন হতে পারে। অনেক ভোটার এসব ঝুঁকির কারণে ভোট দিতে অনীহা প্রকাশ করবেন, যা গণভোটকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

 

 

গণভোটকে রাজনৈতিকভাবে দখল ও কৌশলগতভাবে ব্যবহার করার প্রবণতা বিদ্যমান। সরকার ও তাদের সহযোগী দল চাইবে গণভোটকে জনসমর্থনের প্রতীক হিসেবে দেখাতে।

 
 
 
 
 

 

আন্তর্জাতিক উদাহরণ সতর্কবার্তা দেয়। ব্রেক্সিট দেখিয়েছে, ভুল তথ্য, বিকৃত প্রচার ও রাজনৈতিক চাপের মধ্যে গণভোটের ফলাফল কিভাবে বিভাজন এবং দীর্ঘমেয়াদি সংকট সৃষ্টি করতে পারে। কলম্বিয়ার শান্তিচুক্তি গণভোটেও দেখা গেছে, জনগণ সব সময় যুক্তিবোধ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয় না; আবেগ, ভয় এবং বিভ্রান্তি তাদের প্রভাবিত করে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা, সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব এবং সাম্প্রদায়িক উসকানি মিলিয়ে গণভোটের মাধ্যমে সঠিক সমাধান পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

 

 

গণভোট সংখ্যাগরিষ্ঠের ওপর নির্ভরশীল। হাওর-চরাঞ্চল, পাহাড়ি এলাকা বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মতামত প্রায়ই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় হারিয়ে যায়। গণভোটে তারা আরো অসহায় হয়ে পড়তে পারে।

 

 

গণভোটে ব্যালটে প্রশ্নের জটিলতা—ভোটারকে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ দিতে বলা হয়। কিন্তু সংবিধান সংশোধন, ক্ষমতার ভারসাম্য, প্রশাসনিক কাঠামো—এসব বিষয় দুই শব্দের মধ্যে বোঝানো সম্ভব নয়। ফলে গণভোটের ফলাফল রাজনৈতিক কৌশল ও প্রচারের ওপর নির্ভরশীল হবে, যা সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করবে। এতে রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সামাজিক বিভাজন বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি সংঘর্ষমুখী। গণভোটের ফলাফল যদি জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন না করে, তাহলে বিভাজন, সামাজিক উত্তেজনা ও দ্বন্দ্ব আরো প্রকট হবে।

 

 

গণভোট অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর কাঠামো অনুযায়ী একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিগত—তিন ক্ষেত্রেই বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। প্রথমত, একই কেন্দ্রে দুই ধরনের ব্যালট ও দুই ধরনের ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া চালানোতে প্রিজাইডিং অফিসার থেকে শুরু করে সাধারণ পোলিং অফিসার পর্যন্ত সবার ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হবে। একই দিনে দুই ধরনের ভোটগ্রহণের কারণে সময় ব্যবস্থাপনায় জটিলতা তৈরি হবে। লম্বা লাইন, ধীর ভোটগ্রহণ, বুথসংকট ও নিরাপত্তা তদারকিতে ফোর্সের ওপর চাপ বাড়বে। ভোটারদের দ্বিগুণ সময় লাগবে—একটি সংসদ ভোট, অন্যটি গণভোট—এতে বিশেষত নারী, বৃদ্ধ, নিরক্ষর মানুষ ও প্রতিবন্ধী ভোটাররা অসুবিধায় পড়তে পারেন।

 

 

প্রযুক্তিগত জটিলতাও গুরুত্বপূর্ণ। ভোটার তালিকা ভাগ, ব্যালট পেপার গণনা, পরিবহন ও ঘোষণার সময় একটি ভুলও সামগ্রিক ফল নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। একই দিনে দুই ফলাফল (সংসদ ভোট ও গণভোট) ঘোষণার সমন্বয়ও প্রযুক্তিগতভাবে কঠিন।

 

 

নিরাপত্তা এবং আইন-শৃঙ্খলার ভার বহুগুণ বাড়বে। কোনো কেন্দ্রে উত্তেজনা তৈরি হলে একসঙ্গে দুটি ভোট বাতিল বা স্থগিত করতে হতে পারে, যা আইনি ও প্রশাসনিকভাবে জটিল। কোনো কেন্দ্রে মুলতবি হলে গণভোটের ফল স্থগিত রাখতে হবে কি না, সেটি পরিষ্কার নয়। দলীয় এজেন্টদের দুই আলাদা ভোটের ব্যাখ্যা ভোটারদের দিতে গেলে ভুল ব্যাখ্যার ঝুঁকি বাড়বে।

 

 

প্রবাসী ভোটার, কর্মজীবী ভোটার অথবা দূরবর্তী অঞ্চলের ভোটারদের জন্য একই দিনে দুই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা কঠিন হতে পারে; তাঁরা গণভোটে অংশ নিতে না পারলে গণভোটের প্রতিনিধিত্বমূলক বৈধতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উপদেষ্টা পরিষদ ভেঙে দেওয়া অবস্থায় গণভোটের ফল উপস্থাপন, পরবর্তী সাংবিধানিক সংস্কার বাস্তবায়ন এবং পরবর্তী সংসদ গঠনের সময়সূচি মেলানোও রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে চ্যালেঞ্জিং।

 

 

তারেক রহমান সম্প্রতি বলেছেন, গণভোটের আগে দেশের বাস্তব জনগণের সমস্যা—কৃষকের ন্যায্যমূল্য, শ্রমিকের কাজ, শিক্ষার মান, বাজারব্যবস্থা—এসব সমাধান করা মুখ্য। অর্থাৎ শুধু ক্ষমতার কাঠামো নয়, মানুষের জীবনের মান পরিবর্তন করাই তাঁর অগ্রাধিকার।

 

 

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন, সংবিধান ও আইনগত অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে। দ্বিতীয় সংসদ, উচ্চকক্ষ, ক্ষমতার ভারসাম্য ও সাংবিধানিক স্বাধীনতা—এসব পরিবর্তনের আগে আইনগত প্রক্রিয়া মানা জরুরি। রেফারেন্ডাম যদি হয়, তা শুধু রাজনৈতিক সুবিধা বা নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামোর পুনর্বিন্যাস হতে পারে, নাগরিক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা নয়।

 

 

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা এটিকে স্থিতিশীল রাজনীতি গঠনের বদলে নতুন সংকট হিসেবে দেখছেন। রেফারেন্ডাম ও নির্বাচন একসঙ্গে করার সিদ্ধান্ত এবং সাংবিধানিক কাঠামোর পুরনো ভিত্তি না বদলে নতুন কাঠামো চালু করার প্রস্তাব আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকের নজরদারির প্রয়োজনীয়তা তৈরি করছে। তাই দেশীয় সিদ্ধান্ত শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ও মূল্যায়ন পাবে।

 

 

আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও বিশ্লেষকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যে আইনে গেজেট জারি হয়েছে, তা বর্তমান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধান অনুযায়ী, সংবিধান পরিবর্তন বা রূপান্তরের জন্য সাধারণত সংসদের অনুমোদন প্রয়োজন। সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের মতে, গণভোট নয়, বরং নিরপেক্ষ নির্বাচন ও রাজনৈতিক-প্রশাসনিক সংস্কার প্রয়োজন। তাঁর যুক্তি হলো, গণভোট কোনো ‘শর্টকাট’ নয়, যদি আগে রাষ্ট্রের কাঠামোগত রোগ সারানো না হয়। ১৫ নভেম্বর তিনি বলেছিলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের দিনে গণভোটের প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়।’ কারণ রাজনৈতিক পরিবেশ, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা ও গণতান্ত্রিক অভ্যাস এখনো মজবুত হয়নি।

 

 

শুধু কাঠামো বদল বা আইন প্রণয়ন, সংবিধান পরিবর্তন যথেষ্ট নয়, এর আগে প্রয়োজন চিন্তা, নৈতিকতা ও সাংস্কৃতিক চেতনার রূপান্তর। দুর্নীতি রোধে কঠোর আইন কার্যকর করতে হলে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি। গণতন্ত্র রক্ষায় শুধু নির্বাচন নয়, নাগরিকের চেতনায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি দরকার। তাই চিন্তা-চেতনার সংস্কার ছাড়া সব সংস্কারই ব্যর্থ হবে। প্রয়োজন অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ, রাষ্ট্র গঠন, যা সময়ের দাবি।

লেখক : গবেষক ও রাজনৈতিক কলাম লেখক