কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

গ্রিনল্যান্ডে ট্রাম্পের ‘কালো চোখ’

রূপান্তর ডেস্ক । সূত্র : দেশ রূপান্তর, ১০ জানুয়ারি ২০২৫

গ্রিনল্যান্ডে ট্রাম্পের ‘কালো চোখ’

সম্প্রতি গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে আলোচনায় আছেন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ডেনমার্কের নিয়ন্ত্রণে থাকা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলটি পৃথিবীর বৃহত্তম দ্বীপ। যার অবস্থান আর্কটিক অঞ্চলে। ট্রাম্প দ্বীপটি কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়ার পর এর মধ্যেই ট্রাম্পের ছেলে ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়রও গ্রিনল্যান্ড সফরে পৌঁছেছেন।

 

এসব ঘটনাপ্রবাহ দ্বীপটি নিয়ে জল্পনা-কল্পনার আগুন আরও উসকে দিয়েছে। তবে বিষয়টি মোটেও নতুন কিছু নয়। দীর্ঘদিন ধরেই গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। নিরাপত্তা সুরক্ষা বিবেচনাসহ বিভিন্ন কারণে গ্রিনল্যান্ড ওয়াশিংটনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। একনজরে দেখে নেওয়া যাক কেন ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নিতে চান!

 

গ্রিনল্যান্ড কোথায়

 
 
ডেনিশদের পাশাপাশি দ্বীপটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিও রয়েছে। দ্বীপটির অর্থনীতি তাদের মৎস্য সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। তবে গ্রিনল্যান্ডের মোট জিডিপির এক-পঞ্চমাংশই আসে ডেনমার্ক সরকারের ভর্তুকি থেকে। ২৯ শতকের মধ্যভাগে দ্বীপটি উপনিবেশ হিসেবে শাসিত হতো। তখন বেশিরভাগ সময়ই এ অঞ্চল ছিল বিচ্ছিন্ন ও দারিদ্র্যপীড়িত। ১৯৫৩ সালে গ্রিনল্যান্ড ডেনমার্কের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং গ্রিনল্যান্ডবাসীরা ডেনিশ নাগরিকত্ব পায়।
 
 
১৯৭৯ সালে গণভোটের মাধ্যমে গ্রিনল্যান্ড স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। তবে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষানীতি এখনো ডেনমার্কই নিয়ন্ত্রণ করে।
 
 

ভূরাজনৈতিক অবস্থান

গ্রিনল্যান্ড ভৌগোলিকভাবে উত্তর আমেরিকায় অবস্থিত। দ্বীপটির ভূরাজনৈতিক অবস্থান অনন্য। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মাঝখানে অবস্থান গ্রিনল্যান্ডের। গত ৩০০ বছর ধরে অঞ্চলটি ডেনমার্কের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ডেনমার্ক থেকে গ্রিনল্যান্ডের দূরত্ব প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার। কোপেনহেগেনের থেকে নিউ ইয়র্কের সঙ্গে দূরত্ব কম গ্রিনল্যান্ডের। বিরল মৃত্তিকা ধাতু, ইউরেনিয়াম ও লোহাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদে পূর্ণ গ্রিনল্যান্ড। ফলে দীর্ঘদিন ধরেই দ্বীপটির প্রতি বড় শক্তিগুলোর আগ্রহ বেড়ে চলেছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে গ্রিনল্যান্ডের বরফের কিছু অংশ গলে গেলে এসব প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন করা সম্ভব হতে পারে।

 

যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কেন গুরুত্বপূর্ণ?

গ্রিনল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরেই গ্রিনল্যান্ডে কৌশলগত নিরাপত্তা স্বার্থরক্ষা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৮৬৭ সালে প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জনসন যখন রাশিয়ার কাছ থেকে আলাস্কা কেনেন, তখন গ্রিনল্যান্ড কেনার বিষয়ও বিবেচনা করছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি ডেনমার্কের মূল ভূখণ্ড দখল করে নিলে তখন গ্রিনল্যান্ডে সেনা পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। অঞ্চলটি জুড়ে সামরিক ঘাঁটি ও রেডিও স্টেশন স্থাপন করে ওয়াশিংটন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও মার্কিন বাহিনী গ্রিনল্যান্ডে থেকে যায়।

 

জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য বিবেচনায় ১৯৪৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র ১০০ মিলিয়ন ডলারে (এখনকার হিসাবে প্রায় ১.২ বিলিয়ন ডলার) গ্রিনল্যান্ড কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে ডেনিশ সরকার সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। ১৯৫১ সালে প্রতিরক্ষা চুক্তির অধীন গ্রিনল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিমে একটি বিমান ঘাঁটি গড়তে সক্ষম হয় যুক্তরাষ্ট্র। এ ঘাঁটি বর্তমানে পিটুফিক স্পেস বেস নামে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর সর্ব-উত্তরের ঘাঁটি এটি। নিজের প্রথম মেয়াদে ট্রাম্পও গ্রিনল্যান্ড কেনার চেষ্টা করেছিলেন। ২০১৯ সালের সেই প্রস্তাব ডেনমার্ক ও গ্রিনল্যান্ড উভয়ই প্রত্যাখ্যান করে।

 

বিরল খনিজ সম্পদের সমাহার

গ্রিনল্যান্ডের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের সম্ভাবনায়ও বিশ্বের পরাশক্তিগুলো আগ্রহী হয়ে উঠবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। অধ্যাপক মার্ক জ্যাকবসেন বলেন, গ্রিনল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে থাকা বিরল মৃত্তিকা ধাতুর প্রতি এখন বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে উইন্ড টারবাইন পর্যন্ত সব ধরনের প্রযুক্তিতে এ খনিজগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

বরফ গলার ফলে গ্রিনল্যান্ডের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন এলে উত্তোলন না করা এসব ধাতু থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। আর্কটিকে বরফ গলতে থাকায় সেখানে জাহাজ চলাচলের নতুন নতুন পথ খুলে যাচ্ছে। ২০২৪ সালের আগপর্যন্ত এক দশকে এ অঞ্চলে জাহাজ চলাচল বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। আর্কটিক কাউন্সিলের মতে, জাহাজের চলাচল এতটা বেড়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ বরফ গলে যাওয়া।

 

ট্রাম্পের আগ্রহের কারণ

মস্কো ও নিউ ইয়র্কের মাঝামাঝি অবস্থিত হওয়ায় নিজেদের নিরাপত্তা বিষয়ে দ্বীপটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক অবস্থান ধরে রেখে আসছে। রাশিয়া যদি যুক্তরাষ্ট্রকে লক্ষ্য করে মিসাইল নিক্ষেপ করত, তবে পারমাণবিক অস্ত্র পাঠানোর সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথ উত্তর মেরু এবং গ্রিনল্যান্ডের মধ্য দিয়ে। এ কারণেই পিটুফিক স্পেস বেজ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

আর এটি গ্রিনল্যান্ড নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের সবচেয়ে বড় কারণ বলে জানান রয়্যাল ডেনিশ ডিফেন্স কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মার্ক জ্যাকবসেন। আর্কটিক ইনস্টিটিউটের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত কয়েক বছরে চীন ও রাশিয়া আর্কটিক অঞ্চলে তাদের সামরিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবিলা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে এ অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি আরও জোরালো করার আহ্বান জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে।

 

 ট্রাম্প দাবি করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রেসিডেন্ট গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। আর্কটিক নিরাপত্তাবিষয়ক নিউজলেটার ‘৬৬ক্ক নর্থ’-এর লেখক লুকাস ওয়াডেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কয়েকবার ডেনিশদের গ্রিনল্যান্ড থেকে সরিয়ে জায়গাটিকে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করে নিতে চেয়েছে, অথবা অন্তত গ্রিনল্যান্ডের সম্পূর্ণ নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে চেয়েছে।

 

 

বিরল খনিজ সম্পদের সমাহার

গ্রিনল্যান্ডের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের সম্ভাবনায়ও বিশ্বের পরাশক্তিগুলো আগ্রহী হয়ে উঠবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। অধ্যাপক মার্ক জ্যাকবসেন বলেন, গ্রিনল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে থাকা বিরল মৃত্তিকা ধাতুর প্রতি এখন বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে উইন্ড টারবাইন পর্যন্ত সব ধরনের প্রযুক্তিতে এ খনিজগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

বরফ গলার ফলে গ্রিনল্যান্ডের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন এলে উত্তোলন না করা এসব ধাতু থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। আর্কটিকে বরফ গলতে থাকায় সেখানে জাহাজ চলাচলের নতুন নতুন পথ খুলে যাচ্ছে। ২০২৪ সালের আগপর্যন্ত এক দশকে এ অঞ্চলে জাহাজ চলাচল বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। আর্কটিক কাউন্সিলের মতে, জাহাজের চলাচল এতটা বেড়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ বরফ গলে যাওয়া।

 

 

গ্রিনল্যান্ড ও ডেনমার্কের ভাবনা

গ্রিনল্যান্ডের পার্লামেন্ট সদস্য কুনো ফেনকার বলেন, তিনি ট্রাম্পের মন্তব্যকে হুমকি হিসেবে দেখছেন না। অবশ্য নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা স্বার্থ নিয়ে দুই দেশ সহযোগিতাপূর্ণ অবস্থান ধরে রাখার পক্ষে কথা বলেন তিনি। তবে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন গ্রিনল্যান্ডের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী আলেকা হ্যামন্ড। তিনি বলেন, ট্রাম্প আমাদের ক্রয়যোগ্য পণ্য হিসেবে দেখছেন। এমনকি তিনি গ্রিনল্যান্ডের সঙ্গে আলোচনার পরিবর্তে ডেনমার্কের সঙ্গে কথা বলছেন সেটি আরও নিন্দনীয়।

 

 ট্রাম্পের হুমকির মধ্যে বুধবার ডেনিশ রাজার সঙ্গে বৈঠক করেছেন ডেনমার্কের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী। তবে ডেনিশ রাজপ্রাসাদ গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাজার বৈঠকে আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানায়নি। এ অঞ্চলে ওয়াশিংটনের ‘বৈধ’ স্বার্থ রয়েছে উল্লেখ করে বুধবার ডেনমার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লার্স লক্কে রাসমুসেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার দরজা খোলা রেখেছে ডেনমার্ক।