কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

হালফিল বয়ান : জুলাই বিপ্লবের চেতনা ও নজরুল

ড. মাহফুজ পারভেজ [সূত্র : যুগান্তর, ২৭ মে ২০২৫]

হালফিল বয়ান : জুলাই বিপ্লবের চেতনা ও নজরুল

এ বছর জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মদিন পালিত হলো জুলাই বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে, যে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দ্রোহ ও বিপ্লবের বরপুত্র নজরুল খুবই প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্জনের পেছনে যে সাংস্কৃতিক প্রণোদনা বিদ্যমান, তাতে নজরুলের অবদান অবিচ্ছেদ্য। একইভাবে রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক হলো দুই মহাপর্বতের মৈত্রী ও মিলনের সম্পর্ক। বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপালের মধ্যকার সম্পর্ক এক স্বাভাবিক ও বাস্তব ঘটনা।

 

 

মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল-এ তিন ব্যক্তিত্ব মিলে সমগ্র বাংলা সাহিত্যের যে সৌধ নির্মাণ করেছেন, তা এক অবিভাজ্য ও ঐতিহাসিক ঘটনা। একদেশদর্শী হয়ে এসব সম্পর্ককে দেখার অবকাশ নেই। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক, সাযুজ্য ও অবদানকে দেখতে হবে সাংস্কৃতিক নীচুতা ও হীনম্মন্যতাকে অতিক্রম করে বৃহত্তর পরিসরে এবং উদার মানসিকতার মাধ্যমে।

 

 

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বিনির্মাণে এবং রাজনৈতিক অগ্রগমনে এ তিন সাংস্কৃতিক মহিরুহের অনুপ্রেরণা ও অবদান অনস্বীকার্য। বিশেষত, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কেবল আমাদের মুক্তিযুদ্ধেই নয়, গত বছরের ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের রচনাবলীতে নজরুলের মতো বৈপ্লবিক চেতনার প্রতিফলন না থাকলেও এ দুজনের মধ্যে সাহিত্যিক যোগাযোগ ছিল। রবীন্দ্রনাথের বহু রচনায় এক ধরনের আধ্যাত্মিকতা ও আত্মমগ্ন নিবেদন ছিল স্পষ্ট, আর নজরুলের বিভিন্ন কবিতা গান এবং বিভিন্ন রচনায় রয়েছে অন্যায় ও অনাচারের বিরুদ্ধে সরাসরি বিদ্রোহ ও তীব্র প্রতিবাদ। বস্তুত নতুন প্রজন্ম নজরুলকে যেভাবে ধারণ করেছে তার সঙ্গে অন্য প্রজন্মের ধারণ করার মধ্যে ব্যাপক পাথর্ক্য লক্ষ করা যায়। কয়েক দশক ধরে আমাদের দেশে নজরুলকে নিয়ে অনেক একাডেমিক আলোচনা হয়েছে। জুলাই বিপ্লবের সময় নতুন প্রজন্ম যখন ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মাঠ নেমেছে, নজরুলেন কবিতা ও গান তাদের বিশেষভাবে উজ্জীবিত করেছে। এ উদাহরণ থেকেই স্পষ্ট অতীতের অন্য কোনো প্রজন্ম এ প্রজন্মের মতো নজরুলকে মর্মচেতনায় এতটা ধারণ করতে পারেনি।

 

 

 

একজন মহত্তম স্রষ্টা হিসাবে নজরুল তার পূর্ববর্তী রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করেছিলেন। এটাই নজরুলের আধুনিক মানসিকতা ও অগ্রসরতার স্মারকচিহ্ন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে নজরুল রচনা করেছিলেন এক মর্মস্পর্শী স্মরণসংগীত। রবীন্দ্র প্রয়াণের পটভূমিতে অসীম শ্রদ্ধার প্রলেপে অবিস্মরণী হয়ে আছে সেই গান : ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবি রে জাগায়ো না জাগায়ো না’। শুধু তাই নয়, ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুসংবাদে নজরুল শোকে বিহ্বল, বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। সেই অবস্থাতেই তিনি পরপর তিনটি শ্রদ্ধাজ্ঞাপক কবিতা রচনা করেন। একটিতে বলেন, ‘দুপুরের রবি পড়িয়াছে ধলে অস্ত-পথের কোলে’। কবিতাটি তিনি কলকাতা রেডিওতে যখন আবৃত্তি করছিলেন, তখন, আবৃত্তি করার সময়ই তার দেহে রোগাক্রমণের লক্ষণ দেখা দেয়। আবৃত্তি তিনি সম্পূর্ণ করতে পারেননি। তার জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল। পরের বছর ১৯৪২ সালে মাত্র ২২ বছরের সৃষ্টিশীল জীবনের অবসান ঘটিয়ে নজরুল চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যান।

 

 

রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপাল, জীবনে ও কর্মে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী ব্যক্তিত্বের মানুষ হলেও তাদের যোগাযোগ, সম্পর্ক ও পারস্পরিক মনোভাব কেমন ছিল, তা সাহিত্যবোদ্ধা মাত্রই জানতে আগ্রহী হবেন। তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত মিল ও অমিল এবং সম্পর্কের ইতিবৃত্তটিও তাদের আলাদা সাহিত্য রুচি ও বৈশিষ্ট্যের মতো পার্থক্যপূর্ণ হবে, এটাই স্বাভাবিক। তথাপি একই সময়কালের আগে ও পরে মহিরুহসম দুই ব্যক্তিত্বের অবস্থান হওয়ায় তাদের পারস্পরিক সংশ্লেষ ও সম্পর্কের তুলনামূলক পর্যালোচনা সবার বিশেষ মনোযোগের কারণ।

 

 

তবে সমাজের দশজন সাধারণ মানুষের বিচারে যা প্রামাণ্য মাপকাঠি, তা দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে এবং তাদের সম্পর্ককে বিচার করা সংগত হবে না। কারণ সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে যা সম্ভব-অসম্ভব এবং স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়, তাদের ক্ষেত্রে তা সর্বত্র প্রযোজ্য নয়। যেমন, স্কুলে কোনো একজন কতটুকু পাটিগণিত-বীজগণিত-ইংরেজি-বাংলা-ইতিহাস-ভূগোল ইত্যাদি শিখে কতটা ভালো ফলাফল করেছে, সেটা একজন সাধারণ লোকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ডের বিষয় হলেও প্রতিভাবানদের ক্ষেত্রে তা নয়। তাদের জীবনের দিকে তাকালেই এ সত্য প্রতিভাত হয়।

 

 

 

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন স্কুল পালানো ছেলে। প্রথাগত শিক্ষা ও স্কুলব্যবস্থার শক্ত কাঠামোর বিরুদ্ধে তার এন্তার অভিযোগ ও অনেক সমালোচনা রয়েছে। তা সত্ত্বেও তিনি রবীন্দ্রনাথ হয়েছিলেন। এর ব্যাখ্যায় বলা যায়, তার জন্ম হয়েছিল কলকাতার অত্যন্ত অভিজাত এক পরিবারে। এ পরিবারের শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ছিল ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে অগ্রগণ্য এবং প্রায় তুলনাহীন। প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও তাই সেই পরিবেশে লালিত-পালিত হয়ে একটি ছেলের পক্ষে রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠার বিশ্বাসযোগ্য একটা ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়।

 

 

 

কিন্তু বৃহত্তর বাংলার এক সুদূর প্রান্তবর্তী পাড়াগাঁয়ের ছেলে ‘দুক্ষু/দুখু মিয়া’ জাতীয় জাগরণে নকিব কবি নজরুল ইসলাম হয়ে উঠলেন, সে এক অজানা রহস্য। তার অধিকাংশ জীবনী-লেখকরা সেই রহস্যের বিশ্বাসযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ না দিলেও কোনো কোনো গবেষক বিস্তারিত পরিসরে বিষয়টি তুলনামূলকভাবে আলোচনা করেছেন। এতে এ কথা স্পষ্ট, দুর্বিষহ দারিদ্র্য ও অশিক্ষার বন্ধন কাটিয়ে উঠে নজরুল কী করে নজরুল হলেন, সেটা কেবল একটা বিস্ময়ের ব্যাপার নয়, সেটা প্রায় অবিশ্বাস্য, প্রায় অলৌকিক এবং অনন্যসাধারণ ব্যাপার।

 

 

 

নজরুলের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম পরিচয় লেখার মাধ্যমে, চাক্ষুষ ও সরাসরি নয়। এবং সেটা বাংলায় বা কলকাতায় নয়। বরং যোগাযোগের সময়কাল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে অবিভক্ত সিন্ধু প্রদেশের করাচির সেনানিবাসে, যেখানে সৈনিক নজরুল তখন অবস্থান করছিলেন আর রবীন্দ্রনাথ যথারীতি বাংলায়।

উল্লেখ্য, ১৯১৪ সালের জুলাইয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে স্কুলের দেওয়ালপত্রিকায় সৈন্যবাহিনীতে যোগদানের একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় এবং তা দেখে কিশোর নজরুল বাঙালি পল্টনে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন। করাচির সেনানিবাসে নজরুল কী কী করতেন এবং কী কী পড়তেন, সে সম্পর্কে যে বিবরণ জানা যায়, তা হলো : ‘ভান্ডারের দায়িত্ব পালন করতেন দিনের বেলা, রাতের বেলা করতেন লেখাপড়া। তিনি রবীন্দ্রনাথ পড়েছিলেন, বিশেষ করে কবিতা আর গান।’ তদুপরি, নজরুল করাচি থেকে কলকাতায় ফিরে আসার সময় সঙ্গে যেসব জিনিসপত্র নিয়ে এসেছিলেন, তাতে ব্যবহার্য পোশাক ছাড়াও ‘কবিতার খাতা, গল্পের খাতা, পুথি-পুস্তক, মাসিক পত্রিকা ও রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি ইত্যাদিও ছিল। পুস্তকগুলোর মধ্যে ছিল ইরানের মহাকবি হাফিজের দিওয়ানের একখানা খুব বড় সংস্করণ।’ এ তথ্য দিয়েছেন নজরুল-সুহৃদ কমরেড মুজফফর আহমদ। গবেষক গোলাম মুরশিদ দাবি করেছেন, ‘করাচিতে লেখা তার গল্প ও অন্যান্য রচনায় বহু রবীন্দ্রসংগীতের উদ্ধৃতি আছে।’ তার মানে হলো, রবীন্দ্রনাথ ও তার লেখালেখি নজরুলের চোখ এড়িয়ে যায়নি এবং রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কের নজরুলের পাঠ-পরিধি ছিল রীতিমতো উল্লেখযোগ্য।

 

 

 

১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হওয়ায় ১৯২০ সালে সৈন্যবাহিনী ভেঙে দিলে নজরুল কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতায় তিনি বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মেসে উঠেছিলেন। পরে তিনি চলে আসেন মুজফফর আহমদের আস্তানায়। চলে আসার নেপথ্য কারণ ছিল সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি। এ প্রসঙ্গে তিনটি ভাষ্য পাওয়া যায়। ভাষ্যগুলো সুখকর নয়। ‘এর ফলে তার মনে হিন্দুবিদ্বেষ তৈরি হতে পারত; কিন্তু তেমনটা হয়েছিল বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে জাতিভেদ এবং ছোঁয়াছুঁয়ির তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনি কবিতা ও গান লিখেছিলেন,’ দাবি করেন গবেষক গোলাম মুরশিদ।

 

 

 

নজরুল-সুহৃদ কমরেড মুজফ্ফর আহমদ বাংলাদেশের সন্দ্বীপে জন্মগ্রহণকারী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা; যে দলটি ১৯২৫ সালে স্থাপিত হয়। রাজনীতি শুরুর আগে, ১৯২০-এর দশকে তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং নজরুলের ‘মুক্তি’ কবিতা এবং ‘হেনা’ ও ‘ব্যথার দান’ প্রকাশ করেছিলেন। মুজফ্ফর আহমদ থাকতেন ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির’ অফিসে। নজরুলকে তিনি আহ্বান করেছিলেন, সৈন্যবাহিনী থেকে কলকাতায় ফিরে তিনি যেন তার মেসে ওঠেন। এসব ঘটনাবলির বিবরণ রয়েছে মুজফ্ফর আহমদের আত্মজৈবনিক গ্রন্থগুলো যথাক্রমে-কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা, আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রভৃতি গ্রন্থে।

 

 

 

কলকাতার নতুন আবাসে ১৯২০-২১ সালের সময়কালে নজরুলের সঙ্গে সাহিত্য পরিমণ্ডলের যোগসূত্র নিবিড়ভাবে স্থাপিত হয়। শিক্ষিত মুসলমান যুবক ছাড়াও প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কবি-লেখকদের সঙ্গে তার যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। কলেজ স্ট্রিটের আস্তানায় আগে থেকেই অনেক হিন্দু-মুসলমান কবি-সাহিত্যিক আড্ডা দিতে আসতেন। নজরুলের আগমনের পর তার গান এবং ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে সে আড্ডার পরিধি দ্রুত সম্প্রসারিত হয়। এ সময় যারা আসতেন, তাদের কয়েকজনের নাম উল্লেখ করেছেন মুজফ্ফর আহমদ। এরা হলেন-শশাঙ্কমোহন সেন, গোলাম মোস্তাফা, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রলাল রায়, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, কান্তি ঘোষ, ধীরেন গঙ্গোপাধ্যায়, যোগীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, শান্তিপদ সিংহ। মোহিতলাল মজুমদারের নামও উল্লিখিত হয়েছে।

 

 

 

কলকাতার আবাসস্থল ৩২ নম্বরে আড্ডা দেওয়া ছাড়া নজরুল এ সময়ে আরও আড্ডা দিতে যেতেন গজেন্দ্রনাথ ঘোষের আসরে-বৈঠকে, যিনি ছিলেন মিত্র ও ঘোষ প্রকাশনীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও কথাসাহিত্যিক। মিত্র ও ঘোষ প্রকাশনীর সুদীর্ঘদিনের কর্মী ও পরবর্তীকালে অন্যতম পরিচালক সবিতেন্দ্রনাথ রায় (ভাণু বাবু) নিজের তিন খণ্ডের স্মৃতিচারণমূলক ‘কলেজ স্ট্রিটে সত্তর বছর’ গ্রন্থে সবিস্তারে জানিয়েছেন, সেখানে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে পরিচয় হয় নজরুলের। এছাড়া শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরচ্চন্দ্র পণ্ডিত (দাদা ঠাকুর), মতিলাল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের সঙ্গেও তার পরিচয় হয়েছিল।

 

 

 

নজরুলের সঙ্গে দুজন গায়কের ঘনিষ্ঠতা জন্মে। তাদের একজন তখনকার কলকাতার নামকরা রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী হরিদাস চট্টোপাধ্যায় আর অন্যজন নলিনীকান্ত সরকার। পত্রপত্রিকার সূত্রে আরও অনেকের সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয়। তাদের একজন অরবিন্দ ঘোষের কনিষ্ঠ ভ্রাতা বারীন ঘোষ, যিনি সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিলেন। রাজনীতির পথে নয়, সে সময় পত্রিকার সূত্রে নজরুলের পরিচয় হয় চিত্তরঞ্জন, একে ফজলুল হক এবং আরও অনেক কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, রাজনীতিক, সাংবাদিকের সঙ্গে।

 

 

 

তবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তখনো তার সাক্ষাৎ-পরিচয় হয়নি। সে পরিচয় হয়েছিল পরের বছর (১৯২১)। রবীন্দ্রনাথ এ সময়ে একটানা ষোলো মাস ইউরোপ-আমেরিকায় ভ্রমণে ছিলেন। কিন্তু কোনো কোনো জীবনীকার দাবি করেছেন, ১৯২১ সালের আগস্ট-অক্টোবরের কোনো একদিন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুল দেখা করেন। এ সম্পর্কে দুটি মত প্রচলিত আছে। প্রথম মতটি হলো, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় নজরুলকে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে নিয়ে যান। কিন্তু এ মতটিকে ‘আপাতদৃষ্টিতে ভ্রান্ত’ বলেছেন গোলাম মুরশিদ। কারণ পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় কোথাও উল্লেখ করেননি যে, তিনি নজরুলকে রবীন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি প্রতিদিন রবীন্দ্রনাথের কাছে যেতেন না যে, নজরুলকে নিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করার যোগ্য মনে করবেন না। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা তার আত্মজীবনী চলমান জীবন-এ বেশ বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে গেলে তাও লিপিবদ্ধ করতেন।

 

 

 

আরেকটি বিবরণে জানা যায়, ১৯২১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথের ষাট বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ তাকে একটি সংবর্ধনা দেয়। নাটোরের মহারাজা সে অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। কিংবদন্তি প্রচলিত আছে যে, এ সভায় রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে তার পাশের আসনে বসার জন্য আহ্বান জানান। অরুণকুমার বসু নজরুল জীবনী গ্রন্থে এমন দাবি করলেও অনেকের মতে তা সঠিক নয়। প্রশান্ত পালের রবি জীবনীতে কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে এ অনুষ্ঠানের কার‌্যাবলীর দীর্ঘ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। তাতে নজরুলের কোনো উল্লেখ নেই। এ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হওয়ার মাত্র তিন সপ্তাহ আগে রবীন্দ্রনাথ প্রায় ষোলো মাস বিদেশে থাকার পর প্রথমবারের মতো কলকাতায় আসেন। এ সময় অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে তার দিন কেটেছে। বেশকটি সংবর্ধনা সভায় তাকে যোগ দিতে হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় তিনি কয়েকটি বক্তৃতাও দেন। এর মধ্যে একটা বক্তৃতা ছিল টিকিট করে যোগদানের। মহাত্মা গান্ধীও তার সঙ্গে দেখা করতে আসার কথা এ অনুষ্ঠানের দুদিন পর। এত ব্যস্ততার মধ্যে তরুণ ও অপরিচিত নজরুলের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা না হওয়াই সম্ভব।

 

 

 

তবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথমবারের মতো নজরুলের দেখা হয় ১৯২১ সালের অক্টোবরে। এ সময়ে পূজার ছুটিতে একদিন মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে নজরুল শান্তিনিকেতনে যান রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে। সেখানে নজরুল তার ‘আগমনী’ কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনান। কিন্তু এ তথ্যের বিষয়েও ভিন্নমত আছে। মুজফ্ফর আহমদের বিবরণ অনুযায়ী, দুর্গাপূজার ছুটিতে নজরুল কুমিল্লা যান। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি, তার সঙ্গে দেখা করার গুরুত্ব এবং আকর্ষণ দুই-ই নজরুলের ছিল। কিন্তু এক কিশোরীও তাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করছিল পূর্ব বাংলার মফস্বল শহর কুমিল্লার কান্দিরপাড় থেকে।

 

 

 

সেটা অবশ্য প্রেম ও প্রত্যাখ্যানের বেদনাময় অন্য আরেক কাহিনি। ধূমকেতুর মতো গতিময় নজরুল জীবনের প্রায় সব ঘটনাই ঘটেছে চরম অস্থিরতার মধ্যে, সিদ্ধান্তহীন আকস্মিকতায় ও অপরিকল্পিতভাবে। তবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত গভীর ও সার্বক্ষণিক যোগাযোগের ভিত্তিতে পরিচালিত না হলেও তার গভীরতা ছিল ব্যাপক। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এই, সমকালের অন্যদের মতো নজরুল রবি-বলয়ে আবর্তিত হননি। বরং নিজস্ব স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বে ও বৈশিষ্ট্যে রবি-বলয়কে অতিক্রম করেছিলেন নজরুল এবং বৈপ্লবিক পন্থায় গণমানুষের মুক্তির পথে নিজেকে উত্তরণ করেছিলেন যুগ থেকে যুগান্তরে, কাল থেকে কালান্তরে-স্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর ছুঁয়ে জুলাই বিপ্লবের মর্মমূলে।

 

প্রফেসর ড. মাহফুজ পারভেজ : চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়