হিজবুল্লাহর নতুন প্রধান ও মধ্যপ্রাচ্য সংকট
ড. ফরিদুল আলম ।। সূত্র : কালের কণ্ঠ, ৩ নভেম্বর ২০২৪

ইসরায়েল একের পর এক হামাস এবং হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যার পর তারাও বারবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে আদর্শিক দিক দিয়ে এই সংগঠনগুলো কতটুকু শক্ত অবস্থানে রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয় কঠিন, এটি বুঝতে পেরেও তারা জীবন বাজি রেখে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এটি সম্ভব হয়েছে তাদের ওপর ইসরায়েলের দীর্ঘ সময়ের অমানবিক আচরণ এবং জুলুম-নির্যাতনের কারণে।
এদিকে প্রথমে হিজবুল্লাহপ্রধান হাসান নাসরাল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচনের আগেই সম্ভাব্য উত্তরসূরি হাসেম সফিউদ্দিনকেও হত্যা করে ইসরায়েল। নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনে হিজবুল্লাহ অবশ্য বেশি সময়ক্ষেপণ করেনি। নইম কাশেমকে নতুন প্রধান হিসেবে ঘোষণার মধ্য দিয়ে দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের শূন্যস্থান পূরণ হলো। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, এই নইম কাশেম কোনো দিক দিয়েই প্রয়াত নেতা হাসেম সফিউদ্দিন, এমনকি হাসান নাসরাল্লাহর চেয়ে কম যোগ্য নন, বরং তাঁর রয়েছে বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা।
এদিকে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার বর্তমান অবস্থাও অনিশ্চিত, বিষয়টি কোন দিকে গিয়ে গড়াবে, তা বলা যাচ্ছে না। গত ১ অক্টোবর ইসরায়েলের ভূখণ্ডে ইরানের হামলার জবাবে ২৫ অক্টোবর ইরানের তিনটি শহরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে ইরানকে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখানো থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করা হলেও ইরানের বিভিন্ন সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে সিএনএন জানিয়েছে, ইরান যেকোনো সময় ইসরায়েলের ভূখণ্ডে আবারও হামলা চালাতে পারে এবং তা হতে পারে আগামী ৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে। যদি এমন কিছু হয়, তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীর জন্য নির্বাচনের হিসাব যতটা জটিল হয়ে দাঁড়াবে, তার চেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসনের জন্যও বিষয়টি অস্বস্তিকর হবে। এ কথা সবারই জানা যে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণভাবে মার্কিন সরকারের ভূমিকা দ্বারা প্রভাবিত। বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছু ক্ষেত্রে লোক-দেখানো প্রতিক্রিয়া জানানো এবং যুদ্ধবিরতির কথা বলে এলেও তারাই ইসরায়েলকে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে। যদি সত্যি ইরান আবারও ইসরায়েলে হামলা করে বসে, সে ক্ষেত্রে নির্বাচন সামনে রেখে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া কী হবে কিংবা নির্বাচনের পরপরই বা তারা কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাবে, সেটি মার্কিন নীতিনির্ধারকদের জন্য নতুন ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। তবে এটিও ঠিক যে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের সমন্বিত শক্তি, সেই সঙ্গে পশ্চিমাদের সমর্থন—সব কিছু মিলিয়ে ইসরায়েল ইরানের চেয়ে ঢের শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। ইরান গত ১ অক্টোবর ইসরায়েলে যে হামলা চালিয়েছে, এর প্রায় প্রতিটিই রুখে দিতে পেরেছিল ইসরায়েল, পক্ষান্তরে ইরানের ভূমিতে ইসরায়েলের হামলায় তাদের সামরিক স্থাপনার উল্লেখযোগ্য ক্ষতি সাধিত হয়েছে বলে জানা গেছে। এমন পরিস্থিতিতে ইরানের পক্ষ থেকে পাল্টা হামলা ইসরায়েলকে আরো আগ্রাসী করে তুলতে পারে।
যত দূর জানা গেছে, মার্কিন নির্বাচনে ইসরায়েল লবি বর্তমানে শক্ত অবস্থানে রয়েছে এবং তুলনামূলকভাবে তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য প্রচারণা, এমনকি ব্যাপক অর্থ বিনিয়োগ করেছে বলে ধারণা করা হয়। এই ব্যয়ের দুটি দিক রয়েছে—প্রথমত, ইহুদিদের ভোটের ক্ষেত্রে এবং অন্যদিকে ইহুদিনির্ভর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বিনিয়োগ। এদিক দিয়ে কমলা হ্যারিস অবশ্য কিছুটা পিছিয়ে; যদিও সাম্প্রতিক সময়গুলোতে ইসরায়েলের পক্ষ নিতে জো বাইডেন কালবিলম্ব করেননি, তার পরও ইসরায়েল, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু মনে করছেন, আরো আগ্রাসী হওয়ার সুযোগ থেকে তাঁদের বঞ্চিত করেছেন জো বাইডেন। সেই সঙ্গে নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী কমলা হ্যারিস তাঁর প্রচারণায় সরাসরি ইসরায়েলের পক্ষে যতটা না জোর দিয়েছেন, তার চেয়ে যুদ্ধবিরতির দিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থান এ ক্ষেত্রে স্পষ্ট, কোনো রাখঢাক না করে তিনি ইসরায়েলের প্রতি তাঁর সমর্থন জানিয়েছেন এবং নির্বাচিত হলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই সংকটের অবসান হবে বলে জোর দিয়েছেন। তবে বিষয়টি হবে অবশ্যই ইসরায়েলকে আস্থায় রেখে অর্থাৎ তারা খুশি থাকে এমন নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে, যা থেকে মধ্যপ্রাচ্যে এক ধরনের ত্রাসের নীতির প্রকাশ ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সম্ভবত সে কারণেই ট্রাম্পের প্রতি ইহুদিদের আস্থা বেশি।
ইরানের দিক থেকে পাল্টা হামলার আশঙ্কার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গেই দেখছে মার্কিন প্রশাসন। তাই তাদের পক্ষ থেকে নির্বাচনের আগেই মধ্যপ্রাচ্যে অন্তত সাময়িক সময়ের জন্য যাতে একটি যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন করা যায় সে লক্ষ্যে তারা কাজ করে যাচ্ছে। এমন কোনো চুক্তি যদি এই মুহূর্তে স্বাক্ষরিত হয়, বিষয়টি হয়তো নির্যাতিত গাজাবাসী বা লেবাননবাসীর জন্য স্বস্তির কারণ হবে, তবে এর মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হঠকারী নীতির দিকটি আরো পরিষ্কার হয়ে যাবে। সবার কাছে আরো স্পষ্ট হয়ে যাবে যে এ ধরনের যুদ্ধবিরতিতে এর আগে পৌঁছাতে না পারার কারণ যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে আন্তরিকতার অভাব। বিষয়টিকে হামাস এবং হিজবুল্লাহ স্বাগত জানালেও ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের যে বৈরিতা নতুন করে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়ে গেছে, সেটি সমাধানের কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে না। ইরানের তরফ থেকে যদি ইসরায়েলের বিষয়ে নমনীয় ভূমিকা দেখানো না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে ইসরায়েল রাষ্ট্রের নিরাপত্তা অরক্ষিতই থেকে যাবে। হামাস এবং হিজবুল্লাহ কার্যত যুদ্ধবিরতিতে থাকলেও তারা ইরান দ্বারা সমর্থিত হয়ে আসছে বিধায় ইরানের প্রয়োজনে যেকোনো সময় আবারও সোচ্চার হয়ে উঠতে পারে। সব কিছু মিলিয়ে এই যুদ্ধবিরতি, যা নিয়ে কয়েক মাস ধরে আলোচনা চলছে এটি মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের কোনো নিশ্চয়তা দেয় না। ফলে সাময়িক এই বিরতি একতরফাভাবে ইসরায়েলকেই লাভবান করবে।
মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান সংঘাতে ইসরায়েলের একের পর এক নিশানায় পরিণত হচ্ছেন হামাস এবং হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতৃত্ব। এরই মধ্যে গাজায় প্রায় ৪৫ হাজার এবং লেবাননে আড়াই হাজার মানুষকে হত্যা করেও তারা এই হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত রাখছে। শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যার মধ্য দিয়ে তারা হামাস এবং হিজবুল্লাহ নিধনের মিশনে ইসরায়েল যে সফল হতে পারছে না, সেটি নিজেরাও উপলব্ধি করতে পারছে না, উপরন্তু নিজেদের নাগরিকদের নিরাপত্তাকেই আরো অনিশ্চয়তার মধ্যে রাখছে। মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় তারা অনেক শক্তিশালী হলেও মনোবলের দিক দিয়ে হামাস এবং হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা অনেক বেশি চাঙ্গা, যার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল এবং সেই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবতাবিরোধী নীতি ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আর এখানেই তাদের নৈতিক পরাজয় ঘটেছে। তবে যুদ্ধের মাঠে বাস্তবে কী ঘটবে, সেটি সময়ই বলে দেবে।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
mfulka@yahoo.com