কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ইন্দো-মার্কিন বাণিজ্যের সর্বনাশে চীনের পৌষ মাস

মেনাকা দোশী [প্রকাশ : সমকাল, ০৯ আগস্ট ২০২৫]

ইন্দো-মার্কিন বাণিজ্যের সর্বনাশে চীনের পৌষ মাস

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে শুল্ক চূড়ান্ত করার বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হাতে আর ১৯ দিন সময় আছে। আলোচনা ব্যর্থ হলে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিতে ভারতের শুল্ক দ্বিগুণ তথা ৫০ শতাংশ হারে গুনতে হবে। এতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভোক্তার বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্র অতিরিক্ত যে ২৫ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করেছে, এটিই ট্রাম্প আরোপিত সবচেয়ে বেশি শুল্ক। ভারত যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে ৮৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে, সেখানে এই শুল্কহার স্বাভাবিকভাবেই তার প্রতিযোগী চীন, ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের 
তুলনায় তাকে পিছিয়ে রাখবে। দৃশ্যত মনে হতে পারে, এতে যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হবে। কিন্তু এই শুল্কহার বজায় থাকলে দিন শেষে চীনই বেশি লাভবান হবে।

 

 

এ অবস্থার পেছনে আংশিকভাবে ভারতের কূটনৈতিক ব্যর্থতা আছে। প্রথমত বাণিজ্য চুক্তি করতে ব্যর্থ হওয়া এবং অতিরিক্ত শুল্ক ঠেকাতে না পারা। ভারতীয় কর্মকর্তারা ও বিশেষজ্ঞরা হয়তো যৌক্তিকভাবেই ট্রাম্পকে ‘উৎপীড়ক’ ও ‘অযৌক্তিক’ বলছেন। কারণ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও চীনের মতো অন্য দেশগুলো রাশিয়ার পণ্য কিনলেও তাদের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হয়নি। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং চীনের হাতে গুরুত্বপূর্ণ বিরল খনিজ উপকরণের নিয়ন্ত্রণসহ উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে।

 

ট্রাম্পের নীতির শিকার ভারত, তবে তিনি কাউকে ছাড় দেননি। এমনকি তাঁর অন্যতম বড় ডোনার ইলন মাস্ককেও নয়। সরল বিশ্লেষণে এটি বলা যায়, রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ট্রাম্পের ইউক্রেন যুদ্ধবিরতির দাবির চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ব্লুমবার্গ ওপিনিয়নে মিহির শর্মা স্পষ্টই লিখেছেন, ‘এই হোয়াইট হাউস আনুগত্য চায়, প্রতিবাদ নয়।’ যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র তথা যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাপান তা মেনে নিয়েই শুল্কহার কমাতে পেরেছে; মোদি তা পারেননি।

 


ভারতের বাণিজ্যিক সংকটের আরেকটি কারণ হলো, নরেন্দ্র মোদির সচেতনভাবেই নিজেকে কঠোর নেতা হিসেবে চিত্রিত করা। এর মাধ্যমে তাঁর জাতীয়তাবাদী অনুসারীরা যে কোনো বাণিজ্য কিংবা রাজনৈতিক সমঝোতা কঠিন কিংবা অসম্ভব করে তোলে। ভারতের বিরোধী দল এবং সংবাদমাধ্যমও এ ক্ষেত্রে সাহায্য করেনি। তারা প্রতিটি বাণিজ্য ছাড়কে মার্কিন বাজারে প্রবেশাধিকারকে অর্থনৈতিক বিজয় হিসেবে দেখার বদলে রাজনৈতিক পরাজয় হিসেবে উল্লেখ করেছে। আর যারা বলে, ভারতকে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মিত্রতা করা উচিত, তারা আসলে সীমান্ত বিরোধ এবং চীনের অধিক উৎপাদন সক্ষমতার বিষয়কে উপেক্ষা করছে।

 

 

ব্যাপারটা এভাবে আসা উচিত হয়নি। হ্যাঁ, ভারতকে কৃষি ও ছোট শিল্প সুরক্ষায় অনেক কিছু করতে হবে। সেখানকার ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রনিকস, ওষুধ শিল্প, পোশাক, প্রসাধনী ও জুয়েলারির মতো উচ্চ কর্মসংস্থানের খাতগুলোর যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ধরতে হবে। অনুরূপ আইটি সেবাও গুরুত্বপূর্ণ, এটি যদিও বাণিজ্যিক চুক্তির অন্তর্ভুক্ত নয়, কিন্তু এটি নিয়ে দরকষাকষির বিষয় আছে। কারণ ভারতের শীর্ষ আউটসোর্সিং কোম্পানির আয়ের ৪০ শতাংশ আসে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে।

 


এমতাবস্থায় রুপির ওপর কিছুটা চাপ পড়বে। তবে শেয়ারবাজারের স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তেমন উদ্বিগ্ন বলে মনে হয় না। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি ভারতের জিডিপির ৩ শতাংশেরও কম। আগামী কয়েক বছরে ভারতের জিডিপিতে ৬-৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস রয়েছে এবং এটি মূলত অভ্যন্তরীণ উপাদান দ্বারাই চালিত। এখানকার ফ্যাক্টরগুলো হলো ডেমোগ্রাফি, নগরায়ণ, অর্থনীতির আনুষ্ঠানিকীকরণ ও ডিজিটালাইজেশন। 

 

 

এমনকি ৫০ শতাংশ শুল্কের পরও ভারতের দিক থেকে এক ধরনের অস্বীকারের মনোভাব রয়েছে। পররাষ্ট্রনীতি ও বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে ভারতের কোনো পক্ষ নেওয়া উচিত নয়। ভারতের কৌশলগত অবস্থান বজায় রাখতে হবে, যেখানে আধুনিক নিরপেক্ষ নীতি জরুরি। ভারত যখন যুক্তরাষ্ট্রে আইফোন সরবরাহে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা শুরু করেনি তখনও এই নীতি চিন্তা করা হয়। ব্যবসায়ী নেতারা পুরোনো সুরে বলছেন, দেখতে হবে কীভাবে সংকট সংস্কারের সুযোগ এনে দেয়। যদিও সরকারের অবস্থানে নড়চড় দেখা যাচ্ছে না। তবে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি যত বিলম্বিত হবে ট্রাম্পকে বাগে আনা তত কঠিন হবে এবং ভারতের ছাড় দেওয়ার পরিমাণও তত বাড়তে পারে। 

 

 

মেনাকা দোশী: ব্লুমবার্গের সাংবাদিক; ব্লুমবার্গ থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত 
ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক