কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ইরান-ইসরাইল সর্বাত্মক যুদ্ধে কী ঘটতে পারে

রবার্ট ইনলাকেশ [সূত্র : যুগান্তর, ১৪ জুন ২০২৫]

ইরান-ইসরাইল সর্বাত্মক যুদ্ধে কী ঘটতে পারে

ফিলিস্তিন ও ইরানের ভাগ্য অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। গাজায় ইসরাইলের গণহত্যার প্রথম দিন থেকেই এটি ইসরাইলি নেতৃত্ব স্পষ্ট করে দিয়েছে। তেল আবিব ও তেহরান বড় ধরনের সংঘর্ষের প্রান্তে। কী ঘটতে পারে এবং সংঘর্ষ কতদূর যেতে পারে, তা বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ। ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কঠোর হচ্ছে। ইরানের আঘাতের সম্ভাবনার মধ্যেই তারা বিভিন্ন দেশের সৈন্য এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিচ্ছে। পরিস্থিতি বোঝার জন্য অনেক বিশ্লেষক ব্যস্ত। মাসব্যাপী ইসরাইলি, ব্রিটিশ ও মার্কিন মিডিয়া বারবার ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে বিরোধের গুজব ছড়াচ্ছে। ট্রাম্প ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে পারেন, এমন দাবি থেকে শুরু করে তিনি তার কর্মীদের বরখাস্ত করে ইরানের পরমাণু চুক্তি কার্যকর করতে চান-এমন নানা কল্পকাহিনি শোনা গেছে। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয়েছে যে, এই ‘অজ্ঞাত সূত্র’ ও ‘নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের’ কোনো অস্তিত্ব নেই এবং অধিকাংশ খবরই ভুল।

 

 

 

তবে ইসরাইলি প্রচারণার মূল উদ্দেশ্য মিথ্যাকে বিশ্বাস করানো নয়, বরং এত তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে সত্য-মিথ্যার মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা। ইরানের বিরুদ্ধে হামলার সঙ্গে এসব কেন প্রাসঙ্গিক? কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের জনসাধারণ ব্যাপকভাবে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে চায় না, ট্রাম্পের প্রয়োজন কারও ওপর দোষারোপ করা। অন্যদিকে নেতানিয়াহু তার পরিকল্পনা সফল হলে সব সাফল্য নিজের বলে দাবি করতে চান। বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রায়ই বলা হয় ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার বিপরীতে ইরানকে আক্রমণ করতে চায়। কিন্তু ইরানে ইসরাইলি হামলার বিরোধিতা করার সম্ভাবনা যুক্তরাষ্ট্রের নেই এবং এ ধরনের কোনো প্রমাণও নেই, শুধু অজানা সূত্রের গুজব ছাড়া।

 

 

স্বাভাবিক যুক্তি প্রয়োগ করলে বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া ইরানের বিরুদ্ধে বড় ধরনের ইসরাইলি হামলা চালানো প্রায় অসম্ভব। কারণ, ১. ইরানের বিরুদ্ধে আক্রমণ বড় যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটাতে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা ছাড়া তাদের আঞ্চলিক উদ্যোগকে ধ্বংস করে দিতে পারে। অতীতে ইসরাইলি আক্রমণ সীমিতই ছিল। ২. ইসরাইল তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। ইরানের ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ ১’-এ যুক্তরাষ্ট্রের বিমানই বেশির ভাগ সফলভাবে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন প্রতিরোধ করেছে। ৩. এত বড় ইসরাইলি হামলা তার মার্কিন মিত্রদের থেকে লুকানো সম্ভব নয়, তারা অবশ্যই এটা জানে। ৪. যুদ্ধ হলে ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি একটি জাতির অস্তিত্ব সংকটের মতো। যুক্তরাষ্ট্র এখন অঞ্চলব্যাপী হুমকির পর্যায় বাড়াচ্ছে, তাদের বাহিনী ও পরিবারগুলো সরিয়ে নিচ্ছে, প্রধান সামরিক ঘাঁটিগুলোকে সতর্ক অবস্থায় রেখেছে এবং বিভিন্ন হুমকি দিচ্ছে। তাই বলা যায় না তারা অবগত নয় বা ‘ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে’। সরল কথায়, যুক্তরাষ্ট্র চাইলে এমন হামলা বন্ধ করতে পারে, কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, যা ঘটছে তা একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনার অংশ।

 

 

কী ঘটতে পারে

 

এটি একটি বিধ্বংসী যুদ্ধে পরিণত হতে পারে, যেখানে ইসরাইল পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে এবং ইরান ইসরাইলকে বিধ্বস্ত করতে পারে। তবে এটি সবচেয়ে সম্ভাব্য দিক নয়। যদি কোনো পক্ষ সম্পূর্ণ পরাজিত হয়, তা স্থলযুদ্ধেই হবে। ইরান স্থলযুদ্ধে হার মেনে নেবে না, কিন্তু ইসরাইলের জন্য বহু সামরিক ফ্রন্টে স্থলযুদ্ধ চালানো কঠিন। ট্রাম্প প্রশাসনের সবচেয়ে প্রভাবশালী থিংকট্যাংক হিসাবে পরিচিত হেরিটেজ ফাউন্ডেশন সম্প্রতি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোয় আঘাত করার পরিকল্পনার কথা বলেছে, যেখানে ইরানের প্রতিক্রিয়া হবে সীমিত।

 

ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেও বলেছেন, ইরানের বিরুদ্ধে আক্রমণ ইসরাইলিদের নেতৃত্বে হবে। হেরিটেজ ফাউন্ডেশন এবং ইহুদিবাদী ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি ও ফাউন্ডেশন ফর দ্য ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিজ মনে করে, তেহরান দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবে ট্রাম্প প্রকাশ্যে বলেছেন, ইরান দুর্বল নয়; এটি শুধু রাজনৈতিক প্রচারের জন্য বলা। হিজবুল্লাহ পরাজিত হয়েছে, ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ইসরাইলের দুর্বল আক্রমণে ধ্বংস হয়েছে এবং ইরানের নেতৃত্বাধীন প্রতিরোধ অক্ষ ভেঙে পড়েছে-এসব যুক্তি বাস্তবসম্মত নয়। এগুলো জনসাধারণের জন্য, প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয় না। আসলে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল জোটের দুটি বিকল্প রয়েছে : ১. তারা ইরানের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিকল্পনা করছে, কিন্তু তা সীমিত রাখতে চায়। ২. তারা কেবল ভয় দেখাচ্ছে এবং আক্রমণ করবে না।

 

 

সব প্রমাণ নির্দেশ করে, যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল জোট ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে। এর পেছনে অনেক কারণ কাজ করছে। এর মধ্যে একটি হলো, নিয়ন্ত্রিত ও সীমিত সংঘাতের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষই জয় দাবি করতে পারবে এবং তাদের হামলাগুলোকে প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপন করতে পারবে। ইসরাইলের ক্ষতিও তার অন্যান্য সামরিক ফ্রন্টে সংঘাত সমাপ্তির পথ খুলে দিতে পারে। এর পাশাপাশি যদি ইসরাইলি ও আমেরিকানরা দাবি করে যে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়েছে, হামলা সফল হয়েছে কিনা তার কোনো প্রাসঙ্গিকতা না রেখে, তাহলে ইরানের সঙ্গে মধ্যবর্তী কোনো চুক্তিকে স্বীকৃতি দেওয়ার সময় বিরোধীদের মুখ বন্ধ করা যাবে, যা সম্পূর্ণভাবে উত্তেজনা কমাতে সহায়ক হতে পারে।

 

 

জো বাইডেন তেহরানের সঙ্গে একটি অপ্রতিবদ্ধ (নন-বাইন্ডিং) মধ্যবর্তী চুক্তি করার পন্থা নিয়েছিলেন। জব্দ করা বিপুল পরিমাণ ইরানি সম্পদ অবমুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং পুরো বিষয়টিকে সহজ বন্দি বিনিময়ের মতো করে উপস্থাপন করেছিলেন। তখন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট বুঝতে পেরেছিলেন, কংগ্রেসে নতুন ইরান পারমাণবিক চুক্তি পাস করানো সম্ভব হবে না প্রচণ্ড বিরোধিতার কারণে। তাই একটি আনুষ্ঠানিক নয় এমন চুক্তি বেছে নেন তিনি। মনে হচ্ছিল, এই চুক্তি যেন এক ধরনের বিমানীতি, যাতে সৌদি-ইসরাইল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ নিয়ে ইরান সমস্যা সৃষ্টি না করে।

 

 

কিন্তু ৭ অক্টোবর ২০২৩ সবকিছু বদলে দিয়েছে, যা আজকের আঞ্চলিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। মার্কিন ও ইসরাইলি দৃষ্টিভঙ্গি নিজেদের স্বার্থ রক্ষা, বিজয়ের ভাবমূর্তি তৈরি এবং তাদের সামরিক শক্তির মর্যাদা পুনঃস্থাপন করা। ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের সম্পূর্ণরূপে নিধন করতে, হিজবুল্লাহকে পরাজিত করতে এবং তার ‘বৃহত্তর ইসরাইল’ প্রকল্প সফল করতে চেয়েছিল; কিন্তু এক্ষেত্রে নাটকীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। যতই তারা হিজবুল্লাহ ও ইরানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কৌশলগত জয়লাভ করুক না কেন-যেমন তেহরানে উচ্চপদস্থ আইআরজিসি কর্মকর্তাদের এবং ইসমাইল হানিয়ার হত্যাকাণ্ড-তাদের কোনো শত্রুকে কৌশলগতভাবে পরাজিত করা যায়নি। গাজায় ইসরাইলি সেনাবাহিনী ক্লান্ত; তাদের চালিকাশক্তি হলো তাদের বিমান বাহিনী এবং পশ্চিমা দেশ থেকে অবিরাম আসা গোলাবারুদ। ইসরাইলের সেনাবাহিনী চাপের মুখে ভেঙে পড়ছে এবং সফল স্থল অভিযানের বদলে তারা খাদ্যাভ্যাস বন্ধ করে যুদ্ধ করছে। এমনকি তারা অপরাধী আইসিসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মিলিশিয়াদের নিয়োগ দিয়েছে। যাদের আগে তারা ত্রাণ-সাহায্য চুরি করতে ব্যবহার করত, কিছু ক্ষেত্রে তাদের ইসরাইলি সেনার পরিবর্তে স্থলযুদ্ধে নামাচ্ছে।

 

 

দক্ষিণ লেবাননে ইসরাইলের আগ্রাসনও নাটকীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে, সবচেয়ে মোক্ষম পরিস্থিতিতেও। এখন তারা আটকে পড়েছে, তাদের অধিকাংশ গোয়েন্দা কার্ড ব্যয় করা হয়ে গেছে, এবং তারা হিজবুল্লাহর পরাজয়ের জন্য প্রয়োজনীয় আঘাত হানতে সক্ষম নয়।

 

 

যদিও ইরান, হিজবুল্লাহ, হামাস ও অন্যরা আগে এই যুদ্ধকে ‘মুক্তির চূড়ান্ত যুদ্ধ’ হিসাবে দেখত না, যেমনটা দেখতেন হিজবুল্লাহর সাবেক মহাসচিব সাইয়েদ হাসান নাসরাল্লাহ, কিন্তু এখন এই দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টতই বদলে গেছে। তারা এই যুদ্ধকে অস্তিত্বের যুদ্ধ হিসাবে দেখে এবং মনে করে, ইসরাইল এখন তার সর্বকালের দুর্বল অবস্থায় রয়েছে।

 

 

সব মিলিয়ে বলা যায়, ইরানে ইসরাইলের হামলা সম্ভবত সীমিত পরিসরে হবে, যার উদ্দেশ্য তেহরানের প্রতিশোধকে যুক্তিসীমার মধ্যে রাখা। তবে ‘ওয়াইল্ড কার্ড’ হলো হিজবুল্লাহ ও হামাস। যদি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের বিমানঘাঁটিগুলোয় আঘাত হানে এবং তা ইহুদিবাদী সেনাবাহিনীর বিমান শক্তিকে দুর্বল করে দেয়, তাহলে হিজবুল্লাহ সম্ভবত ইসরাইলের ওপর আক্রমণ করবে। এটি হিজবুল্লাহর জন্য তার সুনাম পুনরুদ্ধার এবং লেবাননের অঞ্চল ফিরে পাওয়ার একটি সুবর্ণ সুযোগ হবে।

 

 

এরপর আছে হামাস এবং অন্যান্য ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠী। তাদের কার্যক্রম হিজবুল্লাহর আক্রমণের পরিধি নির্ধারণ করতে পারে, এবং ফিলিস্তিনি প্রতিক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, যদিও গাজার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বড় ধাক্কা খেয়েছে। ইরান সম্পূর্ণরূপে ইসরাইলকে ধ্বংস করতে চাইবে না, কারণ ইসরাইলের পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। ১৯৭৩ সালে সিরীয় ও মিশরীয় সেনাবাহিনীর আক্রমণে ইসরাইল এই বিকল্পটির বিপজ্জনকভাবে কাছাকাছি এসেছিল।

 

 

ইসরাইলের হামলা এবং ইরানের প্রতিশোধমূলক হামলার পর কয়েক দিনের মধ্যে পরিস্থিতি কোনদিকে যাবে, তা বলা কঠিন। তবে এটি সহজেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। যখন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে যুদ্ধ শুরু করেছিল-যদিও সেই সংঘাত ছিল অনেক আলাদা, তখন ওয়াশিংটনের থিংকট্যাংকগুলো নিজেদের প্রোপাগান্ডায় এতটাই আটকা পড়েছিল যে, তারা প্রতিক্রিয়ার পূর্বাভাস দিতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র বাগদাদ দখল করেছিল-এমন কোনো স্পষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই যে কীভাবে দেশটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে এবং আজও তারা ইরাকে অবস্থান করছে।

 

 

ইরান-ইসরাইল যুদ্ধে একটি ভুল পদক্ষেপ মানে কয়েকটি আইইডি (ইমপ্রুভ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) আক্রমণ, বিদেশি প্রভাব কিংবা সশস্ত্র গোষ্ঠী গঠনই শুধু নয়; এটি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের বা অধিকৃত জেরুজালেম দখলের দিকে একটি সম্ভাব্য পিচ্ছিল পথ হতে পারে।

 

প্যালেস্টাইন ক্রনিকেল থেকে ভাষান্তরিত

রবার্ট ইনলাকেশ : ব্রিটিশ সাংবাদিক, লেখক ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা