কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ এবং ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নতুন চাপ

[সূত্র : ইত্তেফাক, ১৫ জুন ২০২৫]

ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ এবং ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নতুন চাপ

ড. ফরিদুল আলম


ইসরাইলের হামলার জবাবে পালটা হামলার কোনো ধরনের বিকল্প ছিল না ইরানের, এটা আগেই জানা ছিল, ব্যস্তবে ঘটল তা-ই। ইরানের পালটা হামলার জবাবে ইসরাইল তার হামলা অব্যাহত রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী বেনয়ামিন নেতানিয়াহু অজ্ঞাত স্থানে চলে গেছেন, দেশটির বেসামরিক মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

 

 

পরিস্থিতি থেকে এই মুহূর্তে এটা পরিষ্কার যে, ইসরাইল পূর্ণমাত্রার যুদ্ধপ্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে। ইরানের মাটিতে ইসরাইলের হামলার পর এ ধরনের আরো ভয়াবহ হামলা পরিচালিত হতে পারে, এমন সম্ভাবনার কথা জানিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানকে দ্রুতই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার আলোকে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের শেষ সুযোগের বিষয়ে সতর্ক করেছেন। ট্রাম্পের দিক থেকে এই কথাকে ইরানের ওপর ইসরাইলের হামলায় এক পরোক্ষ স্বীকারোক্তি হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। আগে তিনি বলেছিলেন যে, এই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কিছুই জানত না।

 

 

এখানে ইতিমধ্যে এই উত্তেজনা নিয়ে এক ধরনের দ্বিধাবিভক্তি কাজ করছে, যা প্রকাশ্য। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে, ইরানে এই হামলার বিষয়ে কঠোরভাবে যারা নিন্দা জানিয়েছে এদের মধ্যে সৌদি আরব, তুরস্ক ও পাকিস্তান অন্যতম। পশ্চিমা শক্তিগুলো ইরানকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে, একই আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এটা অযৌক্তিক দাবি বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এর আগে যখন ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাসের দিক থেকে ইসরাইলে হামলা করা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা পশ্চিমা গোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া ছিল কঠোর। এর বিপরীতে সংযম' জানানোর আহ্বান বড় পরিহাস।
' বর্তমান বাস্তবতায় তিনটি প্রশ্ন কমবেশি সবার মনে আসছে-প্রথমত, মধ্যপ্রাচ্যে কি ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল এবং এই যুদ্ধ বন্ধে কী ধরনের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে? দ্বিতীয়ত, ইরানকে কি একাই এই পথ পাড়ি দিতে হবে এবং বাস্তবিক অর্থেই কি তারা একা? এবং তৃতীয়ত, ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রকে কতটা কাছে পাবে এবং তারা আসলে এটাকে কোন দিকে নিয়ে যেতে চাইছে? বলে নেওয়া ভালো, যুদ্ধটি শুরু হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে এটাও বলা যায় যে, এটা যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল, উভয়ের জন্যই প্রত্যাশিত ছিল।

 

এ ধরনের একটি যুদ্ধের বিষয়ে প্রক্রিয়াগত দিকটি শুরু হয় কার্যত জো বাইডেনের সময় থেকেই। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস থেকে শুরু হওয়া ইসরাইল-হামাস যুদ্ধের মধ্য দিয়েই ইরানে হামলার পুরো প্লটটি তৈরি করা হয়। ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রের উপলব্ধি এটাই যে, এই অঞ্চলে তাদের আধিপত্য নির্বিঘ্ন করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ইরান। এর আগে তাদের দরকার ছিল ইরানের প্রক্সিদের প্রথমে দুর্বল করা, তারপর ইরানে আঘাত হানার বিষয়টি নিশ্চিত করা। এ বছরের জানুয়ারি মাসেই বাইডেনের মেয়াদ শেষের ঠিক আগে তার উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান হিজবুল্লাহ, হামাস এবং হুতিদের মতো ইরানের প্রক্সিরা অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেছে জানিয়ে ইরানে হামলা শুরু করার পরামর্শ দেন।

 

 ট্রাম্পের মেয়াদ শুরুর পর এটাকে একটি যৌক্তিক প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে এসে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর শর্ত মেনে নিয়ে ইরানের পক্ষে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে চুক্তিতে স্বাক্ষর করা সম্ভব হবে না বুঝে সুবিধামতো সময়ে হামলার সমন্বিত পরিকল্পনার অংশই হচ্ছে ইসরাইলের এই হামলা। এই হামলার জবাবে পালটা হামলা অনিবার্য এবং অনস্বীকার্য হবে-এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ধরনের আঘাতের জবাবে পশ্চিমাদের ডাকে সংযম জানানোর অর্থ হচ্ছে ইরানের দুর্বলতা জানান দেওয়া এবং আরো আঘাতের জন্য অপেক্ষা করা। সুতরাং তারা আঘাত করবেই, যা ইসরাইলকে আরো কঠোর আঘাতের সুযোগ করে দেবে, যা তারা চাইছে। এক্ষেত্রে বিশ্বরাজনীতির গতি-প্রকৃতি আমলে নিলে এটাই বলা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার বাইরে গিয়ে এই যুদ্ধ বন্ধে উদ্যোগ গ্রহণ করার উদ্যোগ নেওয়ার সামর্থ্য আপাতত কারো নেই। যুদ্ধ শুরু করা, বিরতি দেওয়া কিংবা বন্ধ করা এর একচ্ছত্র অধিপতি যুক্তরাষ্ট্রই।

 

 


ইরানকে কি একাই এই যুদ্ধ ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়তে হবে কি না-এই প্রশ্নের এক কথায় জবাব হচ্ছে, আপাতত তাই, অন্ততপক্ষে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো শক্তি কিংবা ওআইসি বা আরব লিগ এক্ষেত্রে কোনো ধরনের উদ্যোগ নিয়ে ইরানের পক্ষে লড়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরাগভাজন হতে চাইবে না। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে (গত ১৩-১৬ মে) প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম আনুষ্ঠনিক সফরের গন্তব্য হিসেবে বেছে নেন মধ্যপ্রাচ্যকে, তার এই সফরের সময়ে সৌদি আরব এবং কাতারের সঙ্গে কয়েক শ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা এবং বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের জন্য যেমন রক্ষাকবচ, অন্যদিকে সৌদি আরব, কাতার এবং আরব আমিরাত-এই তিনটি দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার নবায়ন।

 

 

আপাতদৃষ্টিতে ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ এবং ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নতুন চাপ যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর শর্ত মেনে নিয়ে ইরানের পক্ষে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে চুক্তিতে স্বাক্ষর করা সম্ভব হবে না বুঝে সুবিধামতো সময়ে হামলার সমন্বিত পরিকল্পনার অংশই হচ্ছে ইসরাইলের এই হামলা এই দেশ তিনটি মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে ক্ষমতাধর, যারা ইসরাইলের সমালোচনা করলেও এই মুহূর্তে সরাসরি ইরানের পক্ষে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে নাখোশ করতে চাইবে না। তাছাড়া অতীত ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলেও এটা স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো কখনই ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। এক্ষেত্রে ইরানের জন্য বিকল্প আশা হিসেবে রাশিয়াকে কাছে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও তারা (রাশিয়া) ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরানকে কতটা কাছে থেকে সহযোগিতা করবে, এটা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের কৌশলগত সম্পর্ক পরবর্তী ২০ বছরের জন্য নবায়ন করা হয়েছে, যা গত ১০ জুন ইরানের পার্লামেন্টে অনুমোদিত হয়েছে। রাশিয়ার দিক থেকেও সেটা তাদের পার্লামেন্টের অনুমোদন লাভ করেছে।

 

ইরানে ইসরাইলের একটি হামলা অত্যাসন্ন-সম্ভবত এই বিষয়টি আঁচ করেই সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইরানে নতুন করে আরো আটটি পরমাণু স্থাপনা নির্মাণে সহায়তার ঘোষণা দেন, যা থেকে এটা ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, এটা ইরানের শত্রুদের জন্য একটি বার্তা। এই বার্তাকে অগ্রাহ্য করে ইসরাইলের দিক থেকে হামলা চালিয়ে কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকেও পালটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখ যায় বিষয়টিকে। এখন রাশিয়া যদি এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের শক্তি অনেক বেশি বেড়ে যাবে, সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে ইসরাইলের পরোক্ষ সমর্থনটি প্রত্যক্ষ সমর্থনে রূপ নিতে পারে। এমনটা হলে যুদ্ধটি অনেক বেশি বিস্তৃতি লাভ করতে পারে, যেখানে ইরান-রাশিয়ার সমর্থনে তুরস্কের জড়িয়ে পড়াটাও অসম্ভব কিছু হবে না। আর এটা একপর্যায়ে যদি যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়াকে সামনাসামনি দাঁড় করিয়ে দেয়, তাহলে অবাক হওয়ার মতো কিছু থাকবে না। অন্যদিকে চীনও নিশ্চয়ই নীরব ভূমিকায় থাকবে না।

 


সামরিক শক্তিমত্তা এবং ব্যয়ের দিক দিয়ে ইসরাইল অনেক বেশি অগ্রগামী। যদিও তাদের সামরিক বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ইরানের এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি, সামরিক প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে তারা কল্পনাতীতভাবে ইরানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আয়রন ডোম এবং পেট্রিয়টিক ব্যবস্থা ইরানের যে কোনো সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে আগাম তথ্য নিয়ে সেগুলোকে নিষ্ক্রিয় করতে সফল, যার প্রমাণ ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে। তাছাড়া তাদের হাতে রয়েছে কমপক্ষে ৯০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড, যার বিপরীতে ইরানের সম্বল হচ্ছে ড্রোন এবং ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা। ইসরাইলের তরফ থেকে জানানো হয়েছে যে, আত্মরক্ষার প্রয়োজনে এ ধরনের হামলা চালানোর কোনো বিকল্প ছিল না তাদের, যা যুক্তরাষ্ট্রকেও জানানো হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। আর তাই এই হামলার আগেই মধ্যপ্রাচ্যের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি থেকে মার্কিন সৈন্যদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দেওয়া এক সতর্কবার্তায় ইরানকে উদ্দেশ্য করে জানানো হয়েছে যে, যদি তারা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন কোনো স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলার পরিকল্পনা করে, তাহলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ অবস্থান কী হবে তা নির্ভর করবে ইরানের আচরণের ওপর।

 


এমন পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে যে নতুন যুদ্ধাবস্থার সূচনা হলো, এর থেকে শিগগির পরিত্রাণ সম্ভব নয়, বাস্তবে ইসরাইল সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে, যার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের ভূখণ্ডকে বিস্তৃত করা। গাজা যুদ্ধ থেকে তারা বাড়তি এই সুবিধা পেয়ে ইরানের ক্ষেত্রেও যদি সফল হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই ভবিষ্যতে তদের দৃষ্টি থাকবে সিরিয়া ও তুরস্কের ওপর। সুতরাং ইরানকে যদি এই পরিস্থিতিকে একাই মোকাবিলা করতে হয়, তাহলে ভবিষ্যতের হামলাগুলোর পরিণতিও একই রকমের হবে। এটা এখন মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোকে এক বড় ধরনের আত্মোপলব্ধির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।

লেখক: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়