কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ইরান-ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ : লাভ-ক্ষতির খতিয়ান

আমীর খসরু [প্রকাশ : যুগান্তর, ২৪ জুন ২০২৫]

ইরান-ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ : লাভ-ক্ষতির খতিয়ান

বর্তমানে ইরান এবং ইসরাইলের মধ্যকার যে যুদ্ধ চলছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ নেওয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। এটি হঠাৎ হলেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। এখনও কে জিতেছে, কে হেরেছে, তার হিসাব-নিকাশ করার চূড়ান্ত সময় এসেছে, এমনটি বলা যাবে না। আবার ইসরাইলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর যুদ্ধ এই প্রথম-তাও নয়।

 

জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন বিভক্তির পর আরব রাষ্ট্রগুলো অর্থাৎ মিসর, ইরাক, জর্ডান, লেবানন এবং সিরিয়া-ইসরাইল যুদ্ধ হয়। গাজা উপত্যকা ছাড়া মিসরের ও ইসরাইলের ফিলিস্তিন পর্যন্ত ইসরাইলি দখলের মাধ্যমে ১৯৪৯ সালে এ যুদ্ধটি শেষ হয়। ১৯৫৬ সালে সুয়েজ খাল নিয়ে ইসরাইল-মিসর যুদ্ধ শুরু হয়। মিসর সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করলে যুদ্ধটি শুরু হয়েছিল। ইসরাইলের সঙ্গে তখন যোগ দিয়েছিল ফ্রান্স, ব্রিটেন। ইসরাইল ১৯৬৭ সালে মিসর ও সিরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। আর ইসরাইল গাজা উপত্যকা, সিনাই উপদ্বীপ, পশ্চিম তীর এবং জেরুজালেম দখল করে। মাত্র ৬ দিনের এ যুদ্ধে এতসব ঘটনা ঘটে। আবার ১৯৭৩ সালে মিসর ও সিরিয়া ইসরাইল আক্রমণ করে, যা ইয়োম কিপপুর যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন মিসর ও সিরিয়াকে সমর্থন দেয়। এ যুদ্ধটিতে দুই পরাশক্তি পারস্পরিক শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে পুরো বিশ্বব্যবহার এক ভিন্নমাত্রা গ্রহণ করে।

 

 

ইসরাইল ১৯৮২ সালে লেবানন আক্রমণ করে প্যালেস্টাইন লিবারেশন আর্মি বা পিএলওকে বিতাড়নের জন্য। ২০০৬ সালে লেবাননে হিজবুল্লাহর সঙ্গে মাসব্যাপী লড়াই চলে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় লড়াই শুরু হয় হামাসের ইসরাইল আক্রমণ করার ফলে। এতে ১২০০ জনের বেশি নিহত হয়। হামাস ২৪০ জনকে জিম্মি করে। পরে ইসরাইল পরিপূর্ণ যুদ্ধ ঘোষণা করে, গাজা উপত্যকায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে থাকে। এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।

 

 

এসবের মাঝখানে উল্লেখযোগ্য আরও কিছু ঘটনাও ঘটে। এর একটি ঘটেছিল ১৯৭৮ সালে। তা হলো বিখ্যাত ক্যাম্পডেভিড চুক্তি স্বাক্ষর। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার এর উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

 

 

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, হামাসের হামলার কারণে গাজায় এখন নয়, সেই ২০০৮ থেকে দফায় দফায় ইসরাইল আক্রমণ এবং হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আসছে। এতে এ পর্যন্ত সরাসরি লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।

 

 

কাজেই এটি মনে করার কোনো কারণ নেই যে, ইসরাইল কোনো নিরীহ দেশ এবং প্রথমবার কোনো যুদ্ধ করছে। আর যথারীতি এবারও যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি এতে অংশ নেওয়ায় পরিস্থিতি ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। ইরান ও ইসরাইলের যুদ্ধটি আর দুটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি অংশ নেওয়া বিশ্বজুড়ে এক সীমাহীন অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।

 

 

২০০৬ সালে ‘উইপন্স অব ম্যাস ডেকস্ট্রাশন’ রয়েছে বলে ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং সাদ্দাম হোসেনকে হত্যা করে। এই যুদ্ধ যে তেলসহ নানা সম্পদের লক্ষ্যেই করা হয়েছে-তা এখন স্পষ্ট হয়েছে।

 

 

আরব বসন্তের নামে ২০১০ সালে তিউনিশিয়া, সিরিয়া, বাহরাইন, মিসর এবং লিবিয়ায় সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ও সশস্ত্র বিদ্রোহ হয় সরকার বদল যাকে রেজিম চেঞ্জের নিয়ে। ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করেছে না, এবং ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এমনকি অনুমোদন দেননি বলে দেওয়া গোয়েন্দাদের তথ্য সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এমনকি দুই সপ্তাহ তিনি কোনো সিদ্ধান্তে যাবেন না বলেও জানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সে কথা না রেখে, গোপনে স্বল্প সময়ে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর অনুমোদন দেন ট্রাম্প। এমন প্রেক্ষাপটে গার্ডিয়ান সংবাদপত্র তার নিরাপত্তা বিশ্লেষণে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প নেতানিয়াহুর ফাঁদে পা দিয়েছেন। ইরানে হামলায় অংশ নিয়ে ট্রাম্প এখন অভ্যন্তরীণভাবে বেশ বড় ঝামেলার মধ্যে পড়েছেন। কংগ্রেসে অনুমোদন থাকার কথা থাকলেও তার তা নেই। এ নিয়ে চাপের মুখে পড়তে পারেন ট্রাম্পও।

 

 

তবে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করতে হবেই, ট্রাম্প তাহলে কেন ইসরাইলের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে জড়ালেন? তিনি হয়তো তার অভিবাসী সংকট নিয়ে যে ঝামেলা চলছিল, তা থেকে রক্ষা পাবেন এবং ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ বলে বড় ধরনের উল্লেখ করা হয়-তার মূল উদ্দেশ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আরব বিশ্বের তেল সম্পদ হস্তগত করা। যোশেফ স্টিললিজ এবং লিন্ডা ব্লেমাস তাদের বিখ্যাত বই দ্য থ্রি ট্রিলিয়ন ডলার ওয়্যার-এ ইরাক যুদ্ধের ব্যয় কমপক্ষে তিন ট্রিলিয়ন ডলার বলে উল্লেখ করেছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসাবে এসব যুদ্ধ ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ঘটনায় ৮ থেকে ১০ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছিল। আর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং এ জাতীয় কর্মকাণ্ড বিভিন্ন দেশের ৯ লাখ ৪০ হাজার সাধারণ মানুষ নিহত হয়, বাস্তুচ্যুত হয় ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষ। ব্রাইন ইউনিভার্সিটির ওয়ার্টসন ইনস্টিটিউট এ হিসাব করেছে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইয়েমেন এবং পাকিস্তানে। বাকি দুনিয়ার চিত্র এবং হিসাব এর মধ্যে নেই।

 

 

মার্কিনিরা এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে। কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছে-এ প্রশ্নে ৬০ শতাংশ মার্কিনি যুদ্ধের বিপক্ষে অভিমত দিয়েছে। ইউ গভ নামের একটি সংস্থা ১৩ থেকে ১৬ জুন পর্যন্ত যে জরিপ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ৬০ শতাংশ মার্কিন নাগরিক মনে করে, এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জড়ানো উচিত নয়। এর মধ্যে ডেমোক্রেট দলীয় ৬৫ শতাংশ, ট্রাম্পের নিজ দল রিপাবলিকান দলীয় ৫৩ শতাংশ এবং স্বতন্ত্র ৬১ শতাংশ এ অভিমত ব্যক্ত করেছে।

 

 

ট্রাম্প হয়তো ১৯৭৩ সালে গৃহীত রেজ্যুলেশনটি-যাতে যুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত প্রেসিডেন্ট এককভাবে নিতে পারেন না-ভুলেই গিয়েছিলেন। কংগ্রেসকে এড়িয়ে যাওয়া এবং ১৯৭৩ সালের রেজ্যুলেশন নিয়ে তাকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে।

 

 

তবে এ যুদ্ধের কারণে ভয়াবহ কয়েকটি সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ইরানকে আলোচনার টেবিলে আনা এখন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের ইরাক, বাহরাইনসহ যেসব ঘাঁটি এবং সেনা উপস্থিতি রয়েছে-তাতে চোরাগোপ্তাসহ যে কোনো হামলার এক ধরনের বৈধতা অর্জন করল।

 

 

এছাড়া ইরানের পার্লামেন্ট ইতোমধ্যে হরমুজ প্রণালি বন্ধের অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে। এটি অবধারিত, ইরানের সুপ্রিম জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলও এতে সহসাই অনুমোদন দেবে। হরমুজ প্রণালি দিয়ে কমপক্ষে ২০ শতাংশ তেল সরবরাহ করা হয়। ফলে প্রণালিটি বন্ধ অনুমোদন হলে তেল সরবরাহ ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইতোমধ্যে তেলের বাজার অশান্ত হয়ে উঠেছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি, যা যুক্তরাষ্ট্রকে বিপদে ফেলেছে, তা হলো-ইসরাইলের বিপজ্জনক দায় এখন যুক্তরাষ্ট্রকেও বহন করতে হবে।

 

 

ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিরাট বড় ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে বড় বড় শক্তি এখন ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের ওপর আগ্রাসন চালালে-তার পরিণাম কী হবে, সে বিষয়টি বড় প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এ যুদ্ধের বড় প্রভাব পড়বে মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। ভারত মহাসাগরকেন্দ্রিক যে হিসাব-নিকাশ তা-ও বিবেচনায় নিতে হবে। বিবেচনা নিতে হবে চীনের ভূমিকা কী হবে, সেদিকে। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, গত কয়েকশ বছরের হিসাবে ইতিহাসে কোনো একক শক্তি অনন্তকাল ধরে বিশ্ব মোড়লি করেনি। চারশ বছর আগে স্পেন পুরো বিশ্বকে দখলে রেখেছিল, এর পরে এলো ফ্রান্স। দুইশ বছর ধরে দুনিয়াকে শাসন এবং মুরব্বিপনা দেখিয়েছে। ব্রিটিশরা দেখিয়েছে একশ বছরের বেশি সময়। বর্তমানে মার্কিনি দুনিয়ার শাসন এবং মুরব্বিপনা কতদিন থাকবে-তা চিন্তার সময় এসেছে।

 

 

তবে ইসরাইল-ইরান পালটাপালটি আক্রমণ এবং যুদ্ধে ইরান বড় ধরনের এক শক্তিতে শক্তিমান হয়েছে। ইরানের সব বাধা বিঘ্ন উপেক্ষা করে পুরো জাতিকে এক করতে পেরেছে। লাখ লাখ মানুষ রাজপথে নেমে এসেছে। ইরান এখন এক এবং একাত্ম। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিজয়।

 

 

পক্ষান্তরে নেতানিয়াহু ইরানকে অবমূল্যায়ন ও দুর্বল ভেবেছিলেন। তিনি তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির জন্য-যা নিম্নমুখী ছিল-চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ইসরাইলিরা ইতঃপূর্বে যে ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেনি-সেই ভয়াবহতা দেখে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে আশ্রয়ের আশায়। এখানেই নেতানিয়াহুর নৈতিক পরাজয় হয়ে গেছে। ইসরাইলের মানুষ এখন মনোবলহীন। এমনটি তারা বহুকাল প্রত্যক্ষ করেনি।

 

 

আমীর খসরু : সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক।