ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধপ্রভাব দেশের বাণিজ্যে
[সূত্র : দেশ রূপান্তর, ১৯ জুন ২০২৫]

ইরান-ইসরায়েল হামলা-পাল্টা হামলা চলছে। কোনো দেশই থেমে নেই। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন ধরনের হুমকি দিচ্ছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্র যদি ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেয়, তাহলে ইরান মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন ঘাঁটিগুলোর ওপর হামলা চালানোর জন্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। মার্কিন গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। জাহাজের গতিপথে নজর রাখা ওয়েবসাইট মেরিন ট্রাফিকের তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার ভোরের আগে রণতরীটি মালাক্কা প্রণালিতে ছিল গতিমুখ সিঙ্গাপুরের দিকে।
ইরানও যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে আমেরিকার যুদ্ধজাহাজকে ঠেকাতে। যুক্তরাষ্ট্র তিন-চার দিনে বিভিন্ন ঘাঁটি থেকে অন্তত ৩০টি সামরিক জেট ইউরোপে সরিয়ে এনেছে। অনেক বিশ্লেষকের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালাবে। ইসরায়েল এরই মধ্যে ওই স্থাপনাগুলোতে হামলা চালালেও, তেল আবিবের কাছে যে বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র আছে তা দিয়ে ইরানের ভূগর্ভস্থ স্থাপনার ক্ষতি করা যাবে না। ফলে জ্বালানি তেলের দাম ও জাহাজ চলাচল খরচ বেড়ে যাচ্ছে। যা সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থাকে ব্যাহত করছে। এতে বিশ্ববাণিজ্যে ব্যাপক অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। আমাদের দেশের ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা এর ফলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
এটা পরিষ্কার, সংঘাতের জেরে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে ধাক্কা লাগতে যাচ্ছে তা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত নয় বিশ্ব। এমন আশঙ্কার কথা বলছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা। আমাদের মোট আমদানির প্রায় ৩০ শতাংশ তেল, খাদ্য ও সারের মতো পণ্যে, যেগুলোর একটি বড় অংশ হরমুজ প্রণালির পথে আসে। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি সামরিক সংঘাত শুরুর পর অঞ্চল জুড়ে আতঙ্ক ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। এই যুদ্ধের সামরিক অভিঘাত বাংলাদেশে না পড়লেও অর্থনৈতিক অভিঘাত হবে গভীর, ব্যাপক ও বহুমুখী।
এর ফলে জ্বালানি তেলের দাম ও জাহাজ চলাচল খরচ বেড়ে যাচ্ছে। যা সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থাকে ব্যাহত করছে। এতে বিশ্ববাণিজ্যে ব্যাপক অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা এতে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। বিরাজমান যুদ্ধ পরিস্থিতিকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান। তিনি বলেন, ‘ইসরায়েল ও ইরান যুদ্ধের প্রভাবে তেলের মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে। এর প্রভাব সবার ওপর পড়বে। পোশাকশিল্পেও পড়বে। এই অবস্থায় প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখতে আমাদের অনেক কাজ করতে হবে।
ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর, অনেকে আশঙ্কা করছেন ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিতে পারে। বিশ্ব জুড়ে তেল সরবরাহের জন্য যে প্রণালি কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইরানের নৌবাহিনীর কমান্ডার বলেছেন, ইরান এই প্রণালি বন্ধ করার কথা বিবেচনা করতে পারে। প্রণালি বন্ধ করলে স্পষ্টতই ভয়ংকর অর্থনৈতিক সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। কারণ এর প্রভাব পড়বে তেলের দামের ওপর। মধ্যপ্রাচ্য বিশ্ব জুড়ে অপরিশোধিত তেল সরবরাহের কেন্দ্রবিন্দু। যুদ্ধের ফলে হরমুজ প্রণালির মতো গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি রুট বন্ধ হয়ে গেলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বিপর্যয়করভাবে বাড়তে পারে। যেখান থেকে বাংলাদেশ ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং অর্থনীতিতে বিপর্যয় আসতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, হরমুজ প্রণালি বন্ধ করা অনেকটা পারমাণবিক অস্ত্র রাখার মতোই। বাংলাদেশ একটি জ্বালানিনির্ভর দেশ এবং আমদানি করা জ্বালানি, বিশেষ করে এলএনজি ও পরিশোধিত তেলের ওপর নির্ভরতা বেশি। ফলে তেলের দাম বেড়ে গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বাড়বে। এর প্রভাব শিল্প, কৃষি, পরিবহন ও ভোক্তাপর্যায়ে ব্যাপকভাবে পড়বে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নতুন প্রকল্প স্থগিত রাখতে পারেন। দেশীয় বিনিয়োগকারীরাও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় সংকুচিত হতে পারেন। শিল্প খাতে কাঁচামাল আমদানির জটিলতা উৎপাদন ব্যাহত করবে, ফলে চাকরি হারানোর ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে। বাংলাদেশের শ্রমবাজার প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যে। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি সংকুচিত হতে পারে। আর বাংলাদেশের পণ্যের একটি বড়বাজার মধ্যপ্রাচ্য। সেখানেও সংকট হতে পারে। সব মিলিয়ে সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে ভয়ংকর প্রভাব পড়বে। আর আমরা তো আমদানিনির্ভর দেশ! সব মিলিয়ে পরিস্থিতি কোনো ধরনের মোড় নেয়, তা বলা কঠিন।