কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ইরানে ইসরায়েলের হামলা: ট্রাম্প কি পাগল হয়ে গেছেন

লেখা:মার্কো কার্নেলস [প্রকাশ : প্রথম আলো, ১৪ জুন ২০২৫]

ইরানে ইসরায়েলের হামলা: ট্রাম্প কি পাগল হয়ে গেছেন

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের খেয়ালিপূর্ণ শাসনপদ্ধতি গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে। অন্ধ অনুসারীরা ছাড়া তাঁর ভক্ত হওয়া এখন সত্যিই কঠিন, যদিও এমন মানুষের সংখ্যা সত্যিই কম।

 

 

গত রাতে ইরানে ইসরায়েলের হামলার জন্য ট্রাম্প যে সবুজ সংকেত দিয়েছেন, তা আবারও এই সত্যকে প্রমাণ করে।

তবুও ট্রাম্পকে নিয়ে এমন ভাবনাগুলোর স্বচ্ছ বিবেচনার দাবি রাখে। যার মধ্যে রয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ওপর সামরিক শিল্পখাতের নেতিবাচক প্রভাবের সমালোচনা, যা দেশটিকে অবিরাম যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে এবং এর কোষাগার খালি করে দিয়েছে।

 

 


বিশ্বায়নের ফলে দেশের বাইরে থেকে অর্থাৎ আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে সৃষ্ট উৎপাদন খাত নিয়েও ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। এই নীতি সাম্প্রতিক দশকগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রকে শিল্পায়নমুক্ত করেছে, দেশটিকে বিদেশি শ্রমের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল করে তুলেছিল।

 

 

এর পাশাপাশি আছে ট্রাম্পের সেই ‘মরণপণ লড়াই’, যেটা তিনি ‘ডিপ স্টেট’-এর বিরুদ্ধে চালিয়ে যাচ্ছেন। যে ডিপ স্টেট প্রতিনিধিত্ব করছে মূলত ডেমোক্রেটিক পার্টির ক্রমবর্ধমান একটি অভিজাত গোষ্ঠী ও বড় বড় করপোরেট লবিগুলো, যারা বিশ্বকে ঠেলে দিচ্ছে এমন এক উদারপন্থী অর্থনৈতিক মডেলের দিকে, যেটি আদতে টেকসই নয়।

 

 

কিন্তু ট্রাম্পের প্রবৃত্তি অনেক সময় তাঁকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অনুপ্রাণিত করলেও তিনি এতটাই বোকা যে সেসব বাস্তবায়ন করতে গিয়ে উল্টোপাল্টা করে ফেলেন।

 

 

সমস্যার মূলে রয়েছে তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি, উদাসীনতা ও মানুষের প্রতি সহানুভূতির অভাব। বিশেষ করে তিনি এমন নীতি গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করেন যা আমেরিকার ভেতরে এবং বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই সবচেয়ে গরিব মানুষগুলোর জন্য বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসে। উদাহরণস্বরূপ ইউএসএআইডিকে অচল করে দেওয়া, যা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচির ওপর বিশাল প্রভাব ফেলছে, অথচ এতে যে অর্থ সাশ্রয় হয়েছে তা সামরিক খাতে নষ্ট হওয়া বাজেটের তুলনায় একেবারেই নগণ্য।

 

এখন পর্যন্ত, ট্রাম্পের কাছ থেকে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত বিষয় হচ্ছে, তিনি বন্ধু ও শত্রু উভয়কেই বিভ্রান্ত করে ফেলছেন।

 

অসংগতির শেষ নেই


ট্রাম্পের অসংগতি গুনে শেষ করা যাবে না। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অসংগতি হলো, নিজেকে ‘শান্তির প্রতিনিধি’ হিসেবে উপস্থাপন করে ক্ষমতায় ফিরে এলেন, তারপর প্রতিরক্ষা বাজেটে রেকর্ড ১ ট্রিলিয়ন ডলার খরচের প্রতিশ্রুতি দিলেন।

 

 

এই পরিস্থিতিতে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গিকে বোঝা কার্যত অসম্ভব। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ট্রাম্প ও বিলিয়নিয়ার ইলন মাস্কের নাটকীয় দ্বন্দ্ব, যা মার্কিন ইতিহাসের সংকটময় পরিস্থিতির এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়া কঠিন করে তুলছে। চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পপকর্ন হাতে বিষয়গুলো উপভোগ করছেন, এমন কল্পনাও অবান্তর নয়।

 

 

এখন প্রশ্ন হলো—যে প্রেসিডেন্ট একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৬ ট্রিলিয়ন ডলারের ঋণ নিয়ে হুঁশিয়ারি দেন, আর অন্যদিকে বিপুল প্রতিরক্ষা বাজেটর প্রতিশ্রুতি দেন, করপোরেট কর কাটছাঁট (যা সামাজিক খাতে বাজেট কমিয়ে এনে সম্ভব) এবং অন্য খরচসহ মোট ২.৪ ট্রিলিয়ন ডলারের ঋণ বাড়ান, তাঁকে কীভাবে বিশ্বাস করবে বিশ্ব?

 

 

রেটিং সংস্থাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের রেটিং নামিয়ে দিচ্ছে, আর ট্রেজারি বন্ডগুলো আগের মতো আর আকর্ষণীয় থাকছে না। অর্থাৎ, যে শক্তিশালী আর্থিক অবস্থানকে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী সফট পাওয়ার হিসেবে ধরা হয়, সেখানে ফাটল ধরেছে। জেপি মরগান চেজ-এর সিইও সম্প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ট্রাম্পের শুল্কনীতি মূল্যস্ফীতি বাড়াবে এবং মন্দার সম্ভাবনা জোরালো করছে।

 


পররাষ্ট্রনীতির বোকামি


পররাষ্ট্রনীতিতে এসেও ট্রাম্পের হঠকারিতা একেবারে স্পষ্ট। ইউক্রেনের ইস্যুতে তিনি একদিকে দাবি করেন, তিনি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে শান্তিচুক্তি করাতে পারবেন, আবার পরক্ষণেই বলেন, তিনি হয়তো দুই দেশের মধ্যে মধ্যস্থতা করা ছেড়ে দেবেন। এমনকি তিনি রাশিয়াকে পরোক্ষভাবে হুমকি দেন শান্তিচুক্তির জন্য। আবার তার কয়েক দিন পরেই ইউক্রেন রাশিয়ার ভেতরে ডজনখানেক ড্রোন হামলা চালায়, যে হামলার লক্ষ্য ছিল পারমাণবিক বোমা বহনে সক্ষম একটি রুশ বিমানঘাঁটি। যে হামলা পশ্চিমা গোয়েন্দা সহায়তা ছাড়া সম্ভব নয়।

 

 

গাজা যুদ্ধ নিয়েও ট্রাম্প কোনো যুদ্ধবিরতি আনতে ব্যর্থ হন। তাঁর বিশেষ দূত গাজার সশস্ত্র বাহিনী হামাসকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে রাজি হতে। তার যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে কিছু বন্দী বিনিময়ের কথা বলা হয়েছে, তবে স্থায়ীভাবে শান্তি স্থাপনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। এটি অনেকটা জানুয়ারিতে হওয়া সেই চুক্তির মতো, যা পরে ইসরায়েল নিজের ইচ্ছেমতো লঙ্ঘন করেছিল নেতানিয়াহুর ক্ষমতা ধরে রাখার উন্মত্ততায়।

 

 

ইরানের সঙ্গে পরমাণু আলোচনা নিয়েও ট্রাম্প যদি মনে করেন, তিনি তেহরানকে ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ হওয়া থেকে বিরত রাখার চুক্তিতে রাজি করাতে পারবেন, তাহলে তিনি স্বপ্ন দেখছেন। ইরান এত বছর ধরে নিষেধাজ্ঞা সহ্য করেছে তাদের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক অধিকার বজায় রাখার জন্য, শুধুমাত্র ট্রাম্পের কাছে সেটি বিকিয়ে দিতে নয়—যিনি একসময় ইরানের অন্যতম সামরিক নেতা জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

 

 

ট্রাম্প হয়তো ভাবছেন, ইরানে ইসরায়েলের হামলা সহজতর করে দিয়ে তিনি চুক্তিতে সুবিধা পাবেন, কিন্তু এটি মারাত্মক ভুল প্রমাণিত হতে পারে। ইতিমধ্যে ইরান এই সপ্তাহে হতে যাওয়া আলোচনা বাতিল করেছে।

 

 

মার্কো কার্নেলস ইতালির সাবেক কূটনীতিক। মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়ায় ইতালি সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন।

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: রাফসান গালিব