কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ইরানে সরকার পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই

এম হুমায়ুন কবির [সূত্র : কালের কণ্ঠ, ২৪ জুন ২০২৫]

ইরানে সরকার পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে ইরান-ইসরায়েল সংঘর্ষ নতুন মাত্রা লাভ করল। বিষয়টি এখন অনেকগুলো ডাইমেনশনে ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। এই আক্রমণের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ও অতীতের কর্মকাণ্ডের স্মৃতি মানুষের মনে ভেসে উঠবে। অনেকেরই মনে থাকার কথা, ২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণবিধ্বংসী অস্ত্রের কথা বলে ইরাকে আক্রমণ করেছিল।

 


কিন্তু অনেক ধ্বংসযজ্ঞের পরও ওই দাবির কোনো যৌক্তিকতা মানুষ খুঁজে পায়নি।
আরো আগে, ১৯৫৩ সালে ইরানে মোসাদ্দেকের নেতৃত্বে একটি নির্বাচিত সরকার দেশটির তেলক্ষেত্রগুলো জাতীয় করতে গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচিত সরকারকে উত্খাত করে সেখানে রেজা শাহ পাহলোবীকে ক্ষমতায় আনে এবং রাজতন্ত্র চালু হয়। ফলে ইরানের মানুষের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে একটি অবিশ্বাস ঐতিহাসিকভাবেই ছিল।

 


১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সেটির একটি বড় ধরনের প্রতিফলন আমরা দেখি। ইসলামী বিপ্লবের পর ইরানে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের ৪০০ দিনের বেশি আটকে রাখা হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরান আক্রমণের ঘোষণা দেওয়ার সময় এসব পুরনো কথা বলেছেন। এমনকি ইরাক আক্রমণের সময় ইরানের পরোক্ষ আক্রমণে এক হাজার মার্কিন সেনা নিহত হওয়ার কথাও বলেন ট্রাম্প।

 

 

৫০ বছরের বেশি সময় ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে যে পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস এবং নেতিবাচক মনোভাব বহমান আছে, আমার ধারণা এই আক্রমণের মধ্যে সেটি আরো বেশি ঘনীভূত হলো। আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে আছে। সেখানে চীনের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ছে। আমার ধারণা, ইরানে আক্রমণের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আরব দেশগুলোর আস্থা কমে আসতে পারে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের হয়ে ইরানের ওপর যেভাবে আক্রমণ চালিয়েছে, সেটি এই অঞ্চলের দেশগুলো কিভাবে দেখবে—কৌশলগতভাবে আগামী দশকগুলোর জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

 


এই দেশগুলোর অনেকগুলোতে মার্কিন ঘাঁটি আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ওই দেশগুলোর সম্পর্ক বেশ নিবিড় হলেও ইরান আক্রমণের ফলে তারা আসলে কী বার্তা পেল? মানে দাঁড়াচ্ছে, ইসরায়েলের সঙ্গে যে কেউ যে কোনো রকম প্রতিদ্বন্দ্বিতায় গেলেই কিন্তু তাকে বিরূপ অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র সেখানে ইসরায়েলের পক্ষে সর্বশক্তি নিয়ে দাঁড়াবে। এই ধরনের বাস্তবতায় আস্থার জায়গাটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

 


মনে রাখা দরকার, বিশ্বপরিস্থিতি পরিবর্তিত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নিরাপত্তা, অর্থনীতি বা ভাবমূর্তি নিয়ে যে আকর্ষণ তৈরি করতে পেরেছিল, সেটি কমছে। এই আক্রমণের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে এবং বাইরের পৃথিবীতেও কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে মানুষের ধারণা নেতিবাচক হবে। এক-দেড় দশক ধরে মাল্টিপোলার বা বহুশক্তির বিশ্বব্যবস্থা উত্থানের যে প্রক্রিয়া চলছিল, আমার ধারণা সেটি আরো গতি পাবে এই সংঘাতের ফলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের পরে যখন জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন মানুষের স্বপ্ন ছিল পরবর্তী প্রজন্মকে যুদ্ধের আশঙ্কা থেকে মুক্ত রাখা। এই যে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের মানুষের যে প্রত্যাশা, সেখানে একটি বড় আঘাত লাগল। এই মুহূর্তে বড় ধরনের পরিবর্তন না হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আস্থা, ভূমিকা, ভাবমূর্তি—সব কটিই বৈশ্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর একটি দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পেতে হবে।

 

 

আমরা জানি, প্রায় দুই বছর ধরে গাজায় ইসরায়েলি যুদ্ধ ও আগ্রাসন নিয়েই নানা রকম আলোচনা চলছিল। এর মধ্যে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি জাড়িয়ে পড়া পুরো বিষয়টিতেই অন্য মাত্রা যোগ করল। মনে রাখতে হবে, ইরানের সঙ্গে চলমান সংঘাতের মধ্যেও কিন্তু গাজায় ইসরায়েলি আক্রমণে হতাহতের ঘটনা থেমে নেই। এরই মধ্যে তো গাজা দখলের পরিকল্পনা নেতানিয়াহু ঘোষণা করেছেন এবং ট্রাম্প সেখানে একটি বিনোদনকেন্দ্র বানানোর কথাও প্রকাশ্যে বলেছেন। ইরানে এই হামলা গাজা আক্রমণের ধারাবাহিকতারই অংশ। কারণ ইসরায়েলি আক্রমণে হামাস গুটিয়ে গেছে, হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করা হয়েছে, সিরিয়ায় আসাদ রেজিমের পরিবর্তন হয়েছে। ইরানের বন্ধুরা একে একে সবাই অন্তর্হিত হয়ে গেছে। ফলে ইরান একা হয়ে গেছে এবং সেই একা হওয়ার মুহূর্তেই ইরান হামলার শিকার হলো।

 

 

তবে নেতানিয়াহু ইরানের সরকার পরিবর্তনের কথা যেটি প্রকাশ্যে বলছেন, আমার কাছে মনে হয়, ইরানে এই মুহূর্তে সরকার পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ পশ্চিমা মিডিয়া জানাচ্ছে যে আক্রমণ করার আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গোপনে ইরানকে খবর দিয়েছে। ইরানকে তারা জানিয়েছে, ইরান তার ইউরেনিয়াম সরিয়েছে, তারপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ করেছে। আর সেখানকার সরকার পরিবর্তনের উদ্যোগের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্র জড়াবে না বলে বার্তা দিয়েছে। ফলে এটিকে এক ধরনের কোরিওগ্রাফট অ্যাকশন বলা যেতে পারে। দুই পক্ষই তাদের মুখ রক্ষা করার মধ্যে সামরিক তৎপরতা ও প্রতিক্রিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকবে বলে মনে হচ্ছে।

 

 

ইসরায়েলের হামলায় যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়ার পর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘কূটনীতির সময় শেষ, এখন আর কূটনীতি নিয়ে আমরা কথা বলব না। এখন তারা যে ভাষায় কথা বলছে, আমরা সে ভাষায় কথা বলব।’ এই সংঘাতের ব্যাবহারিক বা বাস্তব অর্থে কিছু শঙ্কা তৈরি করেছে। প্রথমত, একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, ‘ইরান এখন শান্তির পথে আসবে আশা করি; যদি না আসে তার ওপর আরো বেশি আক্রমণ করা হবে।’ এখানে দুই পক্ষ পরস্পর চ্যালেঞ্জ করে যাচ্ছে।

 

 

এত দিন আমরা অপেক্ষা করেছি যে ট্রাম্প কী সিদ্ধান্ত নেয় তার ওপর পরিস্থিতির গতি-প্রকৃতি দেখার। ট্রাম্প তো আক্রমণ করে বসলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় এখনকার পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, সেটি ইরান কী করে তার ওপর নির্ভর করবে। কাজেই দেখতে হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই আক্রমণের প্রতিশোধ ইরান কিভাবে নেয়। কারণ তারা গুটিয়ে যায়নি, পাল্টা আক্রমণ করে যাচ্ছে। অবশ্য মার্কিন স্বার্থে ইরান আঘাত করেনি এখনো। আমার ধারণা, ইরানের পাল্টা আক্রমণে ইসরায়েলই থাকবে প্রধান লক্ষবস্তু। ধ্বংসযজ্ঞ দুই দিকে চললেও ইসরায়েলের যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেটি তারা কত দিন সহ্য করতে পারবে বা যুক্তরাষ্ট্র ফের সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রকাশ্য হবে কি না বলা মুশকিল। কিন্তু ইরানের দিক থেকে হামলা ও ক্ষয়ক্ষতির জবাব চালু থাকবে বলে মনে হয়। 

 

 

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার মার্কিন সেনা ও তাদের সামরিক ব্যবস্থাপনা আছে। ইরান কিন্তু আগেই বলেছে যে আমরা আক্রান্ত হলে সেভাবে প্রত্যুত্তর দেব। এখন ইরান যদি মার্কিন সেনা বা স্থাপনার ওপর আক্রমণ করে, তাহলে যে কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি হবে, তা নয়। এই মার্কিন সেনারা কিন্তু সব উপসাগরীয় দেশে আছে—কাতার, বাহরাইন ও সৌদিতে। কাজেই এই উপসাগরীয় দেশগুলোতে সংঘাত সৃষ্টির শঙ্কা আছে। তারপর শেষ পর্যন্ত ইরান যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে, তার প্রভাব আরো বিস্তারিত হবে। এর প্রতিক্রিয়া উপসাগরীয় অঞ্চলে তো পড়বেই, বাইরের পৃথিবীতেও পড়বে। কারণ যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে তেলের দাম বাড়বে। বাজারে ২০ শতাংশ তেলের সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়বে। তেল বিক্রির ওপর নির্ভরশীল সৌদি, কাতার ও কুয়েত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

 

 

এই দেশগুলোর অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেখানকার শ্রমবাজার আক্রান্ত হবে।

 

আমরা একটি শঙ্কাজনক অচেনা জগতের দিকে যাচ্ছি। এখন অনেক কিছু নির্ভর করছে ইরানের সিদ্ধান্তের ওপর। আমার ধারণা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াটা ইরানের জন্য খুব বেশি লাভ হবে, তা নয়। প্রচুর ধ্বংসযজ্ঞ হবে। তার প্রতিক্রিয়া ইরানের ওপর, ইসরায়েলের ওপর, উপসাগরীয় অঞ্চলে এবং সারা বিশ্বেই হতে পারে।

 

 

আর আরেকটি বিষয় হলো, ১৯৭০ সাল থেকে কার্যকর হওয়া পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি)। এই ট্রিটিতে সই করেছিল ইরান। কিন্তু এই চুক্তির আওতায় না-ও থাকতে চাইতে পারে ইরান। কারণ সে এর আওতায় থাকার পরও পারমাণবিক শক্তিধর দেশ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েলের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র আছে বলে মনে করা হলেও সেটি নিয়ে কোনো কথা উঠছে না। ফলে এই ট্রিটির মধ্যে থেকে তার কী লাভ, সেটি ভাবতে পারে ইরান। চূড়ান্ত বিবেচনায় ইরান এখান থেকে বের হয়ে গেলে এনপিটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আর সেটি হলে বহু দেশ পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করার পথে হাঁটতে পারে, যা বিশ্বব্যাপী দুর্যোগের আশঙ্কা জন্ম দেবে। আমরা যেই ধরনের একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্বের কথা চিন্তা করি, সেটি হয়তো স্বপ্নই থেকে যাবে, আমরা বোধ হয় আবার নিরন্তর সংঘাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি এবং সেই সংঘাতের পরিণতি কী হবে, কোথায় গিয়ে থামবে, সেটি বলা যাচ্ছে না। তবে সময়টি যে খুব ভালো আসছে না, সেটি নিশ্চিত করে বলা যায়।

 

অনুলিখন : মোজাম্মেল হৃদয়

লেখক : সাবেক কূটনীতিক