ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাত : বাস্তবতা ও সমাধান
ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতের রাতারাতি সমাধান হবে না। তবে টেকসই সমাধান সম্ভব, যদি প্রকৃত রাজনৈতিক সদিচ্ছা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি এবং মানবিক ত্রাণকার্যক্রমকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। বিশ্বকে বুঝতে হবে, কেবল সামরিক শক্তির মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি অর্জন সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার কূটনীতি, পারস্পরিক স্বীকৃতি ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা। যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, তাহলে সহিংসতার এই চক্র অব্যাহত থাকবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি অন্তহীন যুদ্ধের উত্তরাধিকারী হবে। এখনই সাহসী নেতৃত্ব এবং একটি ন্যায়সঙ্গত, দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য প্রতিশ্রুতি দেয়ার সময়- ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) রুকন উদ্দিন । সূত্র : নয়া দিগন্ত, ১৫ মার্চ ২০২৫

ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাত আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী বিরোধ। ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতপার্থক্যের কারণে সৃষ্ট এই সঙ্ঘাত বহু যুদ্ধ, বিদ্রোহ এবং ব্যাপক মানবিক সঙ্কটের জন্ম দিয়েছে, বিশেষ করে ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য। মার্চ ২০২৫ সালের বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত অস্থিতিশীল, যেখানে নতুন সহিংসতার ঘটনায় চলমান সঙ্কট গভীরতর হয়েছে।
ফিলিস্তিনের বর্তমান পরিস্থিতি : গাজা এবং পশ্চিমতীরে চলমান সঙ্ঘাত নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে, যা এক অভূতপূর্ব মানবিক সঙ্কট তৈরি করেছে। ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর ধারাবাহিক বিমান হামলা ও স্থল অভিযানের কারণে গাজার জনবসতি এলাকাগুলো বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। হাজার হাজার পরিবার তাদের ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে, যেখানে মৌলিক চাহিদাগুলোও মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। খাদ্যের অভাব মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, কারণ অবরোধের কারণে ত্রাণ সংস্থাগুলো পর্যাপ্ত সাহায্য পৌঁছে দিতে পারছে না। বিশুদ্ধ পানির স্বল্পতা ও নিকাশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে, যা বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।
চিকিৎসাব্যবস্থাও চরম সঙ্কটের মুখে পড়েছে। হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোর বড় অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং যারা এখনো চালু আছে, তারা প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও ওষুধের অভাবে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। আহতদের চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, কারণ জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম, অপারেশন থিয়েটার ও পর্যাপ্ত ডাক্তার নেই। অনেক জায়গায় বিদ্যুৎসংযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকায় জরুরি চিকিৎসাসেবাও ব্যাহত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো গাজার পরিস্থিতিকে ‘মানবসৃষ্ট দুর্যোগ’ বলে বর্ণনা করছে এবং অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকর না হলে আরো ব্যাপক প্রাণহানি ও মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করছে।
একই সময়ে, পশ্চিমতীরেও উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী প্রায় প্রতিদিনই নানা অজুহাতে অভিযান চালাচ্ছে, যার ফলে ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। অবৈধ ইসরাইলি বসতি সম্প্রসারণ অব্যাহত থাকায় অনেক ফিলিস্তিনি পরিবার তাদের শতাব্দীপ্রাচীন বসতভিটা হারাচ্ছে। ইসরাইলি বসতকারীরা প্রায়ই ফিলিস্তিনি গ্রাম ও শহরে হামলা চালাচ্ছে, যাকে অনেকে ‘রাষ্ট্র-সমর্থিত সহিংসতা’ বলে আখ্যায়িত করছেন।
রাজনৈতিকভাবে, যুদ্ধবিরতির জন্য কিছু আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা চলমান থাকলেও, কার্যকর সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। ইসরাইল দাবি করছে, তারা হামাসের সামরিক সক্ষমতা ধ্বংস করতে অভিযান চালিয়ে যাবে, অন্য দিকে হামাসও প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ জনগণই সবচেয়ে বেশি ভুগছে, কারণ তাদের নিরাপত্তা, মৌলিক মানবিক অধিকার এবং জীবনের নিশ্চয়তা প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে পড়ছে। যদি এই সঙ্ঘাত শিগগিরই থামানো না হয়, তাহলে এটি আরো ব্যাপক রক্তপাত ও মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে।
গাজা : এক মানবিক বিপর্যয় : ইসরাইলের অবরোধ এবং ধারাবাহিক বোমা হামলার ফলে গাজা কার্যত একটি ‘উন্মুক্ত কারাগারে’ পরিণত হয়েছে। খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও চিকিৎসা সহায়তা অপ্রতুল। হাসপাতালগুলো আহতদের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে, তবে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও জনবল সঙ্কটের কারণে কার্যকর চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে।
জাতিসঙ্ঘ ও বিভিন্ন মানবিক সংস্থা সতর্ক করে দিয়েছে যে, জরুরি সহায়তা না পৌঁছালে গাজায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে বিভিন্ন সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় একটি দীর্ঘমেয়াদি মানবিক সমাধান অত্যন্ত জরুরি, যাতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমানো যায়।
পশ্চিমতীর : উত্তেজনা ও বসতি সম্প্রসারণ : পশ্চিমতীরে ইসরাইলি অবৈধ বসতি সম্প্রসারণ অব্যাহত রয়েছে, যার ফলে ফিলিস্তিনি পরিবারগুলো তাদের পূর্বপুরুষের ভূমি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে। ইসরাইলি বসতকারীদের দ্বারা ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এসব ঘটনার বেশির ভাগই বিচারহীন থেকে যাচ্ছে। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী প্রায়ই ফিলিস্তিনি এলাকায় অভিযান পরিচালনা করছে, যার ফলে বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে এবং ব্যাপক গ্রেফতার করা হচ্ছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে আরো ক্ষোভ ও প্রতিরোধের মনোভাব সৃষ্টি করছে।
আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রভাব : এই সঙ্ঘাত এখন আর শুধু ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; বরং এটি পুরো অঞ্চলের জন্য বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। লেবানন, সিরিয়া এবং ইরান বিভিন্ন মাত্রায় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিয়ে আসছে, অন্য দিকে ইসরাইল হিজবুল্লাহ ও ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করছে।
ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরাও ইসরাইলি জাহাজ লক্ষ্য করে হামলার হুমকি দিয়েছে, যা এই সঙ্ঘাতকে আরো বিস্তৃত আকার দেয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে।
আন্তর্জাতিক পরিসরে, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব দেশগুলো কূটনৈতিক সমাধানের জন্য আহ্বান জানালেও, রাজনৈতিক বিভাজন ও স্বার্থের সঙ্ঘাতের কারণে একক সমাধান বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। ইসরাইল পশ্চিমা শক্তিগুলোর শক্তিশালী সমর্থন পেলেও, গাজা ও পশ্চিমতীরে তার সামরিক কার্যক্রমের জন্য আন্তর্জাতিক মহলে ক্রমবর্ধমান সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছে। অনেক দেশ ও সংস্থা ইসরাইলের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও যুদ্ধাপরাধ তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
টেকসই সমাধানের সম্ভাবনা : এই সঙ্ঘাতের টেকসই সমাধান নিশ্চিত করতে একটি বহুমুখী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে, যা স্বল্পমেয়াদি মানবিক ত্রাণ এবং দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সমাধান উভয়কেই গুরুত্ব দেবে।
১. জরুরি মানবিক সহায়তা
যেকোনো রাজনৈতিক সমাধানের আগে গাজার মানুষের জন্য জরুরি মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে, যা অন্তর্ভুক্ত হবে :
ক. খাদ্য, পানি ও ওষুধের বাধাহীন প্রবেশাধিকার।
খ. হাসপাতাল, স্কুল ও নাগরিক অবকাঠামোর পুনর্গঠন।
গ. অবরোধ প্রত্যাহার করে মানুষের চলাচল ও পণ্যপ্রবাহের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
ঘ. বেসামরিক মানুষের জন্য নিরাপদ অঞ্চল নির্ধারণ করা, যাতে নিরীহ মানুষের প্রাণহানি বন্ধ হয়।
চ. আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে এই সহায়তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে না এবং প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের কাছেই পৌঁছাচ্ছে।
২. স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ও উত্তেজনা হ্রাসের ব্যবস্থা
দুই পক্ষকেই দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হতে হবে, যা নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে। এর আওতায় থাকবে :
ক. গাজায় ইসরাইলি সামরিক হামলা বন্ধ করা।
খ. হামাস ও অন্যান্য গোষ্ঠীর দ্বারা রকেট হামলা ও সামরিক কার্যক্রম বন্ধ করা।
গ. সঙ্ঘাত রোধে একটি নির্ভরযোগ্য আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দল গঠন।
ঘ. যতক্ষণ না বিশ্বাসযোগ্য সংঘর্ষ-নিবারণ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, ততক্ষণ পর্যন্ত সাময়িক যুদ্ধবিরতিগুলো বারবার ব্যর্থ হতে থাকবে।
৩. দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের পুনরুজ্জীবন
যদিও বাস্তবতা এই সমাধানের পথে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, তবুও দ্বিরাষ্ট্র সমাধানই সবচেয়ে কার্যকর পথ হতে পারে। এর আওতায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে:
ক. পূর্ব জেরুসালেমকে রাজধানী করে একটি সার্বভৌম ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।
খ. নির্ধারিত ও সুরক্ষিত সীমান্তের মধ্যে ইসরাইলের অস্তিত্বের স্বীকৃতি।
গ. ফিলিস্তিনি শরণার্থী সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধান।
ঘ. জেরুসালেমের মর্যাদা নিয়ে এমন সমাধান যা সব ধর্মের মানুষের জন্য পবিত্র স্থানগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
৪. অবৈধ বসতি সম্প্রসারণ বন্ধ করা
শান্তি প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান বাধা হলো ইসরাইলি বসতি সম্প্রসারণ। এগুলো বন্ধ করার জন্য প্রয়োজন :
ক. ইসরাইলকে বসতি সম্প্রসারণ বন্ধ এবং অবৈধ স্থাপনা অপসারণে বাধ্য করা।
খ. ফিলিস্তিনিদের জমির ওপর সার্বভৌমত্ব ও অধিকার স্বীকার করা।
গ. একটি আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোর মাধ্যমে ভূমি বিরোধ নিরসনের ব্যবস্থা করা।
৫. নিরাপত্তাসংক্রান্ত উদ্বেগ নিরসন ও নিরস্ত্রীকরণ
নিরাপত্তা উভয়পক্ষের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য দরকার :
ক. ধাপে ধাপে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর নিরস্ত্রীকরণ এবং ফিলিস্তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি।
খ. একটি যৌথ ইসরাইলি-ফিলিস্তিনি নিরাপত্তা সহযোগিতা কাঠামো গঠন।
গ. বহিরাগত শক্তিগুলো যাতে এই সঙ্ঘাতকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে তা নিশ্চিত করা।
ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতের রাতারাতি সমাধান হবে না। তবে টেকসই সমাধান সম্ভব, যদি প্রকৃত রাজনৈতিক সদিচ্ছা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি এবং মানবিক ত্রাণ কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। বিশ্বকে বুঝতে হবে, কেবল সামরিক শক্তির মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি অর্জন সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার কূটনীতি, পারস্পরিক স্বীকৃতি ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা। যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, তাহলে সহিংসতার এই চক্র অব্যাহত থাকবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি অন্তহীন যুদ্ধের উত্তরাধিকারী হবে। এখনই সাহসী নেতৃত্ব এবং একটি ন্যায়সঙ্গত, দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য প্রতিশ্রুতি দেয়ার সময়।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক