কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ইসরাইলের যুদ্ধ উন্মাদনা বিপন্ন মুসলিম বিশ্ব

ইসলামী বিশ্বকে অনুধাবন করতে হবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল যা করতে চাচ্ছে তা সুদূরপ্রসারী নীলনকশারই অংশ। এই বিদ্বেষের সূচনা সুদীর্ঘকাল থেকে, তা এখনো তারা লালন করে চলেছে। হাজার বছর ধরে ঘোষিত ও অঘোষিত সে যুদ্ধ চলছে। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে এর অনেক প্রমাণ রয়েছে। তারা ইসলাম, মুসলিম বা এ ধরনের শব্দ ব্যবহার না করে অন্য ভাষায় কথা বলে। যখন তারা নাইন-ইলেভেনের পর মুসলমানদের দায়ী করে, তখন প্রেসিডেন্ট বুশ মুখ ফসকে বলে উঠলেন ক্রুসেড। ইতিহাসব্যাপী মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের সেই যুদ্ধ উসকে দিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরাইলের হয়ে। গাজা কিংবা তেহরান খালি করা নয়, আসলে ট্রাম্প চাচ্ছেন মুসলিম বিশ্বকে খালি করতে ড. আবদুল লতিফ মাসুম [সূত্র : নয়া দিগন্ত, ১৯ জুন ২০২৫]

ইসরাইলের যুদ্ধ উন্মাদনা বিপন্ন মুসলিম বিশ্ব

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে ‘যুদ্ধ নয় শান্তি’-এর বাণী নিয়ে জন্মলাভ করে জাতিসঙ্ঘ। দাফতরিক নাম ‘United Nations Organizations-UNO’ এখন সংক্ষেপে বলা হয় টঘ। বিগত ৮ দশক ধরে নানাবিধ টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে জাতিসঙ্ঘ শান্তির পতাকা উড্ডীন করে চলেছে। এই শান্তির বার্তা সীমিত থেকেছে সাধারণ বিশ্বে। অসাধারণ ক্ষমতা দ্বারা যারা তাদের আগ্রাসন চালাচ্ছে তাদের রোধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি জাতিসঙ্ঘ।

 

বিশ্বে অসাধারণ পঞ্চশক্তি- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া এবং অবশেষে চীন যখন যেমন তখন তেমন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। দীর্ঘ বছরগুলোতে একেকটি অসাধারণ শক্তি একেক সময় স্বীয় স্বার্থ রক্ষায় ভেটো প্রয়োগ করে আসছে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার ১৯৪৮ সালে আরব ভূমি ফিলিস্তিন দখল করে যখন ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম হলো আর আরব রাষ্ট্রগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করল, তখন বিপরীত মেরুতে অবস্থানরত এই পঞ্চশক্তি সম্মিলিতভাবে অবৈধ ইসরাইলের প্রতিষ্ঠাকে বৈধতা দান করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল প্রথম শক্তি, যারা তাৎক্ষণিকভাবে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়।

 

 

সেই থেকে আজ অবধি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের ধারক, বাহক ও রক্ষক। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মজা করে বলে থাকেন, যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম অঙ্গরাজ্য হচ্ছে ইসরাইল। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে মার্কিন রাষ্ট্রব্যবস্থার অপরিহার্য দ্বৈত দলীয় ব্যবস্থায় কখনো কখনো নরম-গরম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। কিন্তু ইসরাইলের স্বার্থের বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কোনো হেরফের হয়নি। ইসলামবিদ্বেষী ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন দ্বিতীয়বারের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তখনই আন্তর্জাতিক মহলে এই আশঙ্কা বারবার উচ্চারিত হচ্ছিল যে, বিশ্ব আবার এক অভাবনীয় বিপদ-আপদের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। কয়েক মাস যেতে-না-যেতেই তাদের আশঙ্কা সত্যে প্রমাণিত হলো।

 

 

কোনোরকম আন্তর্জাতিক আইন, মানবিক বিষয়কে পাত্তা না দিয়েই ট্রাম্প ইসরাইলের অব্যাহত আক্রমণের মুখে পতিত গাজা খালি করার কথা বললেন। কার্যত গাজায় হাজার হাজার লাশের পর এখন একরকম খালি হতে চলেছে। এবার ডোনাল্ড ট্রাম্প তেহরান খালি করার নির্দেশ দিয়েছেন। যুদ্ধেরও কিছু নিয়ম-কানুন আছে। ১৯৫১ সালে জেনেভায় গৃহীত সম্মিলিত রাষ্ট্রগুলো কিছু কিছু মানবিক বিষয়ে একমত হয়। এখন দেখা যাচ্ছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল সেসব নীতিকথা নিজেরাই অগ্রাহ্য করে চলেছে। যুদ্ধ আর হত্যা এক কথা নয়। দীর্ঘকাল ধরে ইসরাইল ইরানের যুদ্ধ যারা পরিচালনা করবেন, তাদেরই হত্যা করে চলেছে। ২০২০ সালে তারা সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল কাসেম সুলাইমানিকে হত্যা করে।

 

 

এবার তারা হত্যা করেছে ইরানের ইসলামী রেভল্যুশনারি গার্ড কোর প্রধান হোসেইন সালামিকে। এ ছাড়া হামলায় ইরানের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল বাঘেরি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন আইআরআইএনএন। ইসরাইলের হামলায় নিহত হয়েছেন ইসলামী রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের বিমানবাহিনীর কমান্ডার আমির আলী হাজিজাদেহও। ইসরাইলি বাহিনীর দাবি- ইসরাইলে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল হাজিজাদেহ ও তার শীর্ষ সহকর্মীরা। এ জন্য একটি ভূগর্ভের কমান্ড সেন্টারে বৈঠক করছিলেন। হামলায় পুরো সেন্টারটি ধ্বংস হয়ে যায়। হামলায় ইরানের অন্তত ২০ জন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন বলে রয়টার্সকে জানিয়েছে সূত্র।

 

 

এখন এই যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে আবারো হত্যার কথা নির্লজ্জভাবে উচ্চারণ করছেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। একটি বড় মিথ্যা কথা বলে আরেকটি বড় হত্যাকে জায়েজ করতে চেয়েছেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনি ট্রাম্পকে দু-দফা হত্যার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। এখন নেতানিয়াহু খোলামেলাই বলছেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিকে হত্যা করলেই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটবে। কিভাবে একজন সরকারপ্রধান আরেকটি রাষ্ট্রের প্রধানকে হত্যার হুমকি দিতে পারে! সভ্যতার ক্ষেত্রে পৃথিবী নাকি অনেক এগিয়েছে। এখন এমন নির্মম, নৃশংস, নির্লজ্জ উচ্চারণকে অস্বীকার করার লোক খুঁজে পাওয়া ভার। বস্তুত বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, মুসলমানদের রক্তের কোনো দাম নেই। বাংলাদেশে অথবা পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তে যদি কোনো মুসলিম নেতাকে হত্যা করা হয় বা ফাঁসি দেয়া হয় তার জন্য কোনো জবাবদিহি করতে হয় না কাউকে। অন্য দিকে একজন সালমান রুশদিকে যদি কেউ গুঁতো দেয় তাহলে চিৎকার করে ওঠে সারা বিশ্ব।

 

 


ইসরাইলের জন্ম থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন তাদেরকে আক্রমণ, আগ্রাসন ও হত্যায় আশ্রয়, প্রশ্রয় দিয়ে আসছে, এখনো সেই কাজটি করে যাচ্ছে। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো আধপাগল যখন থেকে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে, তখন থেকেই ইসরাইলের সপক্ষে কূটনীতি থেকে যুদ্ধ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহু এবার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছেন। ট্রাম্পকে বাজি রেখে এই সর্বশেষ হামলাটি চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের উদ্দেশ্য ইরানের ভূমি দখল নয়। তারা বলছেন, ইরানের সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ নয়। তাদের মূল লক্ষ্য ইরানের ইসলামী প্রজতন্ত্র। ১৯৭৯ সালে যখন লাখ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে ইরানে ইসলামী বিপ্লব সফল হয়ে ওঠে তখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সেখানে কঠিন শিক্ষা পায়। তাদের শিখণ্ডি শাহান শাহ-রেজা শাহ পাহলভি পলায়ন করেন। যেমন পলায়ন করেছেন শেখ হাসিনা। ইরানের মরহুম ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির নেতৃত্বে ওই বিপ্লব সম্পন্ন হয়। পরবর্তীকালে কয়েক দফায় ইরানের কাছে মার্কিন প্রশাসনকে নাকানি-চুবানি খেতে হয়। নেতানিয়াহু ও তার সহযোগীরা এখন প্রকাশ্যেই বলছেন, ইরানের ইসলামী শাসনের অবসান ঘটানোই তাদের লক্ষ্য। ইরানের পতিত রেজা শাহর ছেলেকে ডেকে এনেছেন নেতানিয়াহু। তাকে তেহরানের সিংহাসনে আসীন হওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন।

 

 

 

ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে প্রায় ৫০ বছর প্রতি পদে পদে ইরানকে ব্যর্থ করার, পরাভূত করার নানাবিধ ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অনেকেই মনে করেন, খোদ ইরানে ইসলামী বিপ্লববিরোধী শক্তি বেশ প্রবল। তারা সর্বাত্মক সহায়তা না দিলে অতীতের ব্যক্তিগত হত্যাযজ্ঞ সম্ভব হতো না। যুদ্ধের মাঝখানেই তেহরানে ড্রোন তৈরির গোপন আস্তানা আবিষ্কৃত হয়েছে। এটি দুর্ভাগ্যজনক যে, ইরান তাদের সেনাপ্রধানদেরও রক্ষা করতে পারছে না। সবাই জানে পৃথিবীতে মোসাদ হচ্ছে সবচেয়ে অপ্রতিরোধ্য গোয়েন্দা সংস্থা। তার মোকাবেলায় ইরানকেও সক্ষমতা দিয়ে তাদের চ্যালেঞ্জ করতে হবে। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এরও সুনাম রয়েছে। সবাই মিলে এখনই যদি ইসরাইল পরিকল্পনাকে চ্যালেঞ্জ করা না যায় তাহলে পরে আরো বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হবে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা ইরানে ইসলামী শক্তির বিপরীতে কাজ করার নানা গ্রুপের উল্লেখ করছেন। এরা হচ্ছে মার্কিন প্রশ্রয়ে লালিত রাজতন্ত্রপন্থীরা, বামধারার ইরানি জনগণ এবং আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠী। ইসরাইল এখন বলছে বছরের পর বছর ধরে তারা ইরান আক্রমণের পরিকল্পনা এঁটেছে। তাদের বিশ্বস্ত মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সাথে নিয়েই তারা এসব পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। ইসরাইল যত সহজে ইরানকে কাবু করতে পারবে বলে ভেবেছিল তা হয়নি; বরং ইটটি মারতে গিয়ে তাদের পাটকেলটি হজম করতে হচ্ছে।

 

 

এটি দুর্ভাগ্যজনক যে, ইরান আক্রান্ত হওয়ার পর আরব দেশগুলো যে শক্ত প্রতিক্রিয়া দেখানোর প্রয়োজন ছিল তা দেখাতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। যদিও ২১টি মুসলিম রাষ্ট্র এই আগ্রাসী হামলার নিন্দা করেছে, তবুও তা যথেষ্ট বলে মনে হচ্ছে না। ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা-ওআইসির এ ক্ষেত্রে জোরদার ভূমিকা নেয়া উচিত। মনে রাখতে হবেÑ এই যুদ্ধ মুসলমানদের বিরুদ্ধে। ইরানের ইসলামী বৈশিষ্ট্যের বিরুদ্ধে যারা পাশ্চাত্যের তথা ট্রাম্পের অনুগত ভৃত্য হিসেবে কাজ করছে তাদের কোনো ভয় নেই। গত ৫০ বছরের ইতিহাস প্রমাণ করে, ইরান পাশ্চাত্যের সবচেয়ে শক্তিশালী চ্যালেঞ্জ। সামরিকভাবে ও সম্পদেও ইরান সমৃদ্ধ। ইসরাইলের পরবর্তী টার্গেট পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তান, বিশ্ব মুসলিম ঐক্যের প্রবক্তা তুরস্ক এবং তালেবান শাসিত আফগানিস্তান। ইরানে ইসলামী সরকারের পতন হলে মুসলিম বিশ্বে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে। পাশ্চাত্যকে চ্যালেঞ্জ করার আর কোনো শক্তি থাকবে না।

 

 

ইসলামী বিশ্বকে অনুধাবন করতে হবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল যা করতে চাচ্ছে তা সুদূরপ্রসারী নীলনকশারই অংশ। এই বিদ্বেষের সূচনা সুদীর্ঘকাল থেকে, তা এখনো তারা লালন করে চলেছে। হাজার বছর ধরে ঘোষিত ও অঘোষিত সে যুদ্ধ চলছে। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে এর অনেক প্রমাণা রয়েছে। তারা ইসলাম, মুসলিম বা এ ধরনের শব্দ ব্যবহার না করে অন্য ভাষায় কথা বলে। যখন তারা নাইন-ইলেভেনের পর মুসলমানদের দায়ী করে, তখন প্রেসিডেন্ট বুশ মুখ ফসকে বলে উঠলেন ক্রুসেড। ইতিহাসব্যাপী মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের সেই যুদ্ধ উসকে দিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরাইলের হয়ে। গাজা কিংবা তেহরান খালি করা নয়, আসলে ট্রাম্প চাচ্ছেন মুসলিম বিশ্বকে খালি করতে। খলের যেমন অজুহাতের অভাব হয় না, তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভাব হয়নি অজুহাতের ইরাক ও আফগানিস্তান দখল করতে। ট্রাম্প বলছেন, তিনি ইরান আক্রমণ করতে পারেন আবার না-ও করতে পারেন। তিনি নিশ্চয়ই ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির মতো বানোয়াট চিত্রনাট্য তৈরি করবেন। নতুন বয়ান বানাবেন। নতুন করে রণবাদ্য বাজাবেন।

 

 

লেখক : অধ্যাপক (অব:), সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়