কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ইসরাইলি বর্বরতার শেষ কোথায়?

সৈয়দ ফারুক হোসেন। সূত্র : সময়ের আলো, ১৯ এপ্রিল ২০২৫

ইসরাইলি বর্বরতার শেষ কোথায়?
গাজা জ্বলছে, গাজা পুড়ছে, নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। একের পর ইসরাইলি মিসাইলের আঘাতে প্রতিনিয়ত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিন। সম্প্রতি বেশ কিছু ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিকমাধ্যমে। যেখানে দেখা যায়, মিসাইলের আঘাতে মানুষ ১০-১৫ তলারও বেশি উচ্চতায় উঠে আবার নিচে পড়ে যাচ্ছে। এ যেন ছাড়িয়ে গেছে আধুনিক বিশ্বের সব বর্বরতাকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া এসব ভিডিওচিত্র দেখে কাঁদছে প্রতিটি মানুষের অন্তর। দখলদার ইসরাইলের নৃশংসতার শেষ কোথায়, জানা নেই কারোরই। ভাইরাল হওয়া ভিডিওচিত্র দেখে অনেকেই নিশ্চিত করেছে এ ক্ষেপণাস্ত্রগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই দেওয়া। পশ্চিমা বিশ্ব যেন এক হয়েছে ফিলিস্তিনিদের পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে। গাজা উপত্যকাকে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে দখলদার ইসরাইল, আর নির্লজ্জ বেহায়ার মতো তাকিয়ে দেখছে অন্য দেশগুলো। গাজার এ ভয়াবহ চিত্র দেখে শুধু যে মুসলিমদের হৃদয় ব্যথিত হচ্ছে তা নয় ভিন্নধর্মীরাও আজ ব্যথিত ইসরাইলের স্মরণকালের সবচেয়ে বড় এই নৃশংসতায়। ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনের মানুষের ওপর যে নৃশংসতা চলছে, তা বর্ণনা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। 
 
 
 
ফিলিস্তিনের শিশুদের অসহায়ত্ব বিশ্ববাসীর বিবেককে নাড়া দিচ্ছে। ফিলিস্তিনের নিরীহ মানুষের ওপর ইসরাইলের অব্যাহত বর্বরতা মানবসভ্যতার অর্জনগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এর দায় বিশ্ববাসী এড়াতে পারে না। এ জঘন্য কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিশ্বের ক্ষমতাধরদের নীরবতা আমাদের বিস্মিত করে। গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করছে দখলদার ইসরাইলি বাহিনী। ইসরাইলি বাহিনী প্রতিনিয়ত ফিলিস্তিন যুদ্ধের ধরন পাল্টেছে। যেসব আক্রমণ চালাচ্ছে, তার বেশিরভাগই পরিচালিত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে। শুধু ট্যাঙ্ক, বোমা আর ড্রোনই নয়, যুদ্ধের মাঠে রয়েছে তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল অস্ত্র, যা দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঠিক করা হচ্ছে লক্ষ্যবস্তু।
 
 
 
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বাহিনীকে এই ডিজিটাল অস্ত্রের জোগান দিচ্ছে গুগল, মাইক্রোসফটসহ বিশ্বখ্যাত মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো। এ ব্যবস্থায় এআই ব্যবহার করে উপগ্রহচিত্র, ফোনকল, ভিডিও ফুটেজ ও সোশ্যাল মিডিয়া তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। এরপর সম্ভাব্য ‘টার্গেট’ শনাক্ত করে হামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ‘অ্যালগরিদমিক ওয়ারফেয়ার’ গাজার সাধারণ মানুষের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এআইনির্ভর নজরদারি প্রযুক্তি, টার্গেটিং সিস্টেম ও ড্রোন পরিচালনার স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা এরই মধ্যে অপারেশনাল ইউনিটে যুক্ত করার কথা স্বীকার করেছে ইসরাইল। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর, দেশটির প্রতিরক্ষা বাহিনী এখন যুদ্ধে মানব সম্পৃক্ততা কমিয়ে প্রযুক্তিনির্ভরতা বাড়ানোর দিকে জোর দিচ্ছে। এ প্রযুক্তির জোগানদাতা হিসেবে বারবার উঠে আসছে মার্কিন টেক জায়ান্টগুলোর নাম। মাইক্রোসফট দীর্ঘদিন ধরেই ‘অ্যাজিউর গভর্নমেন্ট’ নামে একটি পৃথক সিকিউর ক্লাউড প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ইসরাইলি বাহিনীর সঙ্গে কাজ করছে। এ ক্লাউডে বিশাল তথ্যভান্ডার সঞ্চিত রাখা হয়, যা রিয়েল টাইম বিশ্লেষণে ব্যবহৃত হয়। 
 
 
 
এদিকে ‘প্রজেক্ট নিমবাস’ নামে একটি যৌথ প্রকল্পে ২০২১ সালেই ইসরাইলি সরকারকে এআই ও ক্লাউড সেবা সরবরাহের জন্য এক দশমিক দুই বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে গুগল। প্রযুক্তির এমন ব্যবহার নিয়ে উঠছে তীব্র বিতর্ক। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এ ধরনের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা মানে যুদ্ধাপরাধ থেকে দায়মুক্তি নিশ্চিত করা। কারণ এতে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো জানতেও পারছে না, তাদের প্রযুক্তি কোথায়, কাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ প্রযুক্তি যুদ্ধের দায়ভার মানুষ থেকে সরিয়ে মেশিনের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। আর সেই সুযোগেই আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেও অনেক সরকার পার পেয়ে যাচ্ছে। আরও উদ্বেগের বিষয় সম্প্রতি গুগল ও ওপেনএআই উভয়েই তাদের এআই ব্যবহারের নীতিমালা পরিবর্তন করেছে।    
 
 
 
আগে এসব প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে স্পষ্ট লেখা থাকত যে, এআই কখনোই অস্ত্র বা নজরদারির কাজে ব্যবহার করা হবে না। কিন্তু এখন সেই শর্ত সরিয়ে দিয়ে বলা হচ্ছে, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এআই ব্যবহারে কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকবে না। বিশ্লেষকদের মতে, এর ফলে এখন এআই প্রযুক্তি সরাসরি সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের পথ প্রশস্ত হয়েছে। ইসরাইলের কারণে অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনিদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে চরমভাবে। ক্ষমতার মোহে নিমজ্জিত বিশ্বনেতারা নীরব থাকলেও সাধারণ মানুষ এ বর্বরতার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন নিজ নিজ অবস্থান থেকে। ক্ষমতার মোহ নয়, মানবতার স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে গাজায় শান্তি ফেরাতে বিশ্বনেতারা কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন-এটাই আমাদের প্রত্যাশা। বিশ্ববাসীকে এসব জঘন্য ও নৃশংস কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। গত জানুয়ারিতে হওয়া দুই মাসের যুদ্ধবিরতি ভেস্তে যাওয়ার পর ১৮ মার্চ থেকে ইসরাইল আবার গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে হামলা শুরু করে। সে সময় থেকে ইসরাইলি বাহিনী গাজার বিশাল অঞ্চল দখল করেছে। এতে নতুন করে বাস্তুচ্যুত হয়েছে শত সহস্র ফিলিস্তিনি। এ ছাড়া ইসরাইলি বাহিনী ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড গাজার সীমান্ত বরাবর চলে যাওয়া বিস্তীর্ণ অঞ্চলও দখল করেছে। গাজা সিটির আল-আহলি আরব হাসপাতালে বোমা হামলা চালিয়েছে। হামলায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ধ্বংস হয়েছে। রোগীদের অন্য স্থানে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। 
 
 
 
গাজায় গত ১৭ মাসের বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধে নিহত হয়েছে ৫০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি। সেই সঙ্গে আহত হয়েছে সোয়া লাখ মানুষ। এ ছাড়া লাখ লাখ ফিলিস্তিনি ঘরছাড়া হয়েছে। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যার প্রতিবাদে গত ১২ এপ্রিল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচিতে যোগ দেন লাখ লাখ মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শত শত মানুষ ফিলিস্তিনি পতাকা নিয়ে বিক্ষোভকারীরা ‘ফ্রি ফ্রি, ফিলিস্তিন’ স্লোগান দেন। এ গণহত্যার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সরব হয়েছেন বাংলাদেশের মানুষও। ‘প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট বাংলাদেশ’-এর উদ্যোগে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলের বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে মানুষের ঢল মহাসমুদ্রে রূপ নেয়। এদিন ছিল না দল-মতের বিভেদ। ছিল না কোনো রেষারেষি। সবকিছু ভুলে ফিলিস্তিনের জন্য পাশাপাশি হেঁটেছেন সবাই। বাংলাদেশের কর্মসূচি ঘিরে ঐক্যের এক নতুন ইতিহাস তৈরি হয়েছে। অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের মত প্রকাশ করেছে। এ কর্মসূচিতে অংশ নিতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছেন শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের মানুষ। খণ্ড খণ্ড মিছিল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জমায়েত হয়ে জনসমুদ্র  তৈরি করে।
 
 
 
এদিকে ঢাকায় এমন প্রতিবাদের দিনেই গাজার বেশিরভাগ অঞ্চলে হামলা জোরদারের ঘোষণা দিয়েছিল ইসরাইল। ‘মার্চ ফর গাজা’ উপলক্ষে আয়োজিত পদযাত্রা ও গণজমায়েত থেকে ২০ দফা ঘোষণাপত্র ও অঙ্গীকারনামা পেশ করা হয়েছে। এতে আন্তর্জাতিক বিশ্ব, মুসলিম উম্মাহ ও সরকারের প্রতি চার দফা দাবি তুলে ধরা হয়। আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরাইলের গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করা এবং গণহত্যা বন্ধে কার্যকর সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানানো হয়। ফিলিস্তিনকে ১৯৬৭ সালের পূর্ববর্তী ভূমি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা নিয়ে ঘোষণাপত্রে বলা হয়, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সব জাতির অধিকার রক্ষা, দখলদারি ও গণহত্যা রোধের সংকল্প প্রকাশ করে। এ কারণে ইসরাইলের গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে নিশ্চিত করতে হবে। গণহত্যা বন্ধে কার্যকর ও সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করতে হবে।
 
 
 
লেখক-সৈয়দ ফারুক হোসেন, সাবেক রেজিস্ট্রার, জেএসটিইউ