কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ইসরায়েল সব জায়গায় ব্যর্থ হয়েছে

ডেভিড হার্স্ট । সূত্র : প্রথম আলো, ১৭ জানুয়ারি ২০২৫

ইসরায়েল সব জায়গায় ব্যর্থ হয়েছে

গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে উঠেছিলেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। প্রায় দুই মাস আগে তাঁর প্রতিরক্ষামন্ত্রী ১৫ মাসব্যাপী যুদ্ধের প্রধান স্থপতি ইয়োভ গ্যালান্টের পদত্যাগ এ বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করে দিয়েছিল। গ্যালান্ট সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন যে গাজায় সেনাবাহিনীর আর কিছু করার নেই। তবু নেতানিয়াহু তাঁর অবস্থানে অনড় থাকেন।

 

 

তিনি সিআইএর পরিচালক উইলিয়াম বার্নসের উপস্থিতিতে হামাসের সঙ্গে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে রাফায় সামরিক অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। নেতানিয়াহুর লক্ষ্য ছিল উত্তর গাজাকে খালি করে সেখানে ইসরায়েলিদের পুনর্বাসন করা। এই পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল সামরিক রাস্তা আর চৌকি দিয়ে আটকে গাজার কেন্দ্র বরাবর ইসরায়েলি সীমান্ত থেকে সমুদ্র পর্যন্ত প্রসারিত একটি করিডর তৈরি করা। এই করিডর কার্যত গাজার ভূমির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ দখল করত। তৈরি হতো গাজার নতুন উত্তর সীমান্ত।

 

 

উত্তর গাজা থেকে বিতাড়িত কোনো ফিলিস্তিনিকে সেখানে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হতো না। বাইডেন প্রশাসনের কেউই নেতানিয়াহুকে এই পরিকল্পনা পুনর্বিবেচনা করতে জোর করেননি।

 

সব দরজা বন্ধ হলেও ফিলিস্তিনিরা পথ খুঁজে নেয়
১৬ জানুয়ারি ২০২৫
সব দরজা বন্ধ হলেও ফিলিস্তিনিরা পথ খুঁজে নেয়
আর এখন খসড়া চুক্তি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করছে যে ফিলিস্তিনিরা তাদের বাড়িতে, এমনকি উত্তর গাজাতেও ফিরে যেতে পারবে। গাজার বাসিন্দাদের বিতাড়িত করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এটি ইসরায়েলের স্থল আক্রমণের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।

 

 

ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে নতুন সরবরাহ না পেলে কয়েক মাসের মধ্যে তাদের বোমা ফুরিয়ে যেত। ইসরায়েলি জনগণ ভাবছে, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পথে। অথচ ইসরায়েলের বড় কোনো লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। অক্টোবর ২০২৩-এ দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের আকস্মিক আক্রমণের পরে নেতানিয়াহু এবং ইসরায়েলি সেনাবাহিনী হামাসকে ‘ধ্বংস’ করার লক্ষ্যে হামলা শুরু করেছিল। তবে স্পষ্টতই তারা এ লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি।

 

 

হামাস ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে এসে প্রতিরোধ করেছে। গাজার উত্তরের সাম্প্রতিক সামরিক অভিযানের শুরু থেকে এই অঞ্চলে ৫৫ জন ইসরায়েলি অফিসার এবং সেনা নিহত হয়েছে। যদি আজ কোনো সেনাবাহিনী রক্তাক্ত এবং ক্লান্ত হয়ে থাকে, তবে তা ইসরায়েলের।

 

গাজা যুদ্ধ ভবিষ্যৎ বিশ্বনেতাদের চোখে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের এক নতুন দৃষ্টিকোণ তৈরি করে দিয়েছে। ২০২৩ সালের ৬ অক্টোবর ইসরায়েল ভেবেছিল যে তারা ফিলিস্তিন সমস্যার ইতি টেনেছে। ভেবেছিল যে বিশ্বমতামত তাদের পক্ষে। কিন্তু বাস্তবতা মোটেই তা নয়।

 

গাজায় ফিলিস্তিনি জনগণের ভূমি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। মাত্র ৩৬০ বর্গকিলোমিটার এই এলাকা পুরোপুরি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। তাদের কোনো মিত্র অবরোধ ভাঙতে এগিয়ে আসেনি। কিন্তু তবু জনগণ ছিল দৃঢ়সংকল্প। তারা নিজের মাটিতে থাকবেই। বাধ্যতামূলক অনাহার, শীতে কষ্ট, রোগ, মৃত্যু, দখলদারদের হাতে নির্মমতা এবং দলবদ্ধ ধর্ষণ...কোনো কিছুই তাদের জমি ছাড়তে বাধ্য করতে পারেনি। ফিলিস্তিনি যোদ্ধা এবং বেসামরিক জনগণ আগে এমন প্রতিরোধ দেখায়নি।

 

 

এই প্রতিরোধযুদ্ধের গতিপথ পাল্টে দিতে পারে। দিয়েছেও। কারণ, ইসরায়েল তার গাজা ধ্বংসের প্রচেষ্টায় যা হারিয়েছে, তার হিসাব করা অসম্ভব। দেশটি বিশ্ব জনমতের চোখে নিজেকে এক উদার গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য কয়েক দশক ধরে চেষ্টা করেছে। এসব অর্থনৈতিক, সামরিক এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টা নিছক অপচয় হলো।

 

 

ইসরায়েল পশ্চিমের একটি প্রজন্মের সমর্থন হারিয়েছে। যে প্রজন্মের স্মৃতি ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার গল্প মনে করতে পারে, বাইডেন তাদের শেষ প্রেসিডেন্ট। আমেরিকান ইহুদি কিশোর-কিশোরীদের এক-তৃতীয়াংশের বেশি হামাসের প্রতি সহানুভূতিশীল। তাদের ৪২ শতাংশ মনে করে যে ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে। আর ৬৬ শতাংশ পুরো ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে।

 

 

গাজা যুদ্ধ ভবিষ্যৎ বিশ্বনেতাদের চোখে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের এক নতুন দৃষ্টিকোণ তৈরি করে দিয়েছে। ২০২৩ সালের ৬ অক্টোবর ইসরায়েল ভেবেছিল যে তারা ফিলিস্তিন সমস্যার ইতি টেনেছে। ভেবেছিল যে বিশ্বমতামত তাদের পক্ষে। কিন্তু বাস্তবতা মোটেই তা নয়।

 

 

পশ্চিমা সরকারগুলো প্রথমে যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদকে ইহুদিবিদ্বেষ বলে নিন্দা করেছিল। পরে একে সন্ত্রাসবাদ বলে আইন করে দমন করা হয়েছে। কিন্তু দুনিয়াজোড়া এই প্রতিবাদগুলো ফিলিস্তিন মুক্তির জন্য একটি বৈশ্বিক ফ্রন্ট গড়ে তুলেছে। ইসরায়েল বর্জনের আন্দোলন আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ইসরায়েল আজ আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার মামলা চলছে। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর আদালতে আরও অসংখ্য মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।

 

 

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তাদের গাজা অভিযানে অংশগ্রহণকারী সেনাদের পরিচয় গোপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ, তারা আশঙ্কা করছে যে বিদেশ ভ্রমণের সময় তাদের বিচারিক প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হবে। এই বড় পদক্ষেপ ছোট এক সংগঠনের কারণে সম্ভব হয়েছে। এই সংগঠনের নাম ইসরায়েলি সেনাদের হাতে নিহত হওয়া ছয় বছর বয়সী একটি শিশু হিন্দ রজবের নামে।

 

 

বেলজিয়ামভিত্তিক এই সংগঠন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে এক হাজার ইসরায়েলির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ জমা দিয়েছে। গাজায় যুদ্ধবিরতির ফলে ফিলিস্তিনের দুঃস্বপ্ন শেষ হয়নি। তবে ইসরায়েলের জন্য নতুন সমস্যার শুরু হয়েছে।

 

 

ইসরায়েলের অভ্যন্তরে বিভক্ত এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। হারেদিম নামে এক সম্প্রদায় সামরিক সেবায় যোগ দিতে অস্বীকার করছে। সেক্যুলার ও জাতীয়তাবাদী ধর্মীয় জায়নিস্টদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। সেটলার কট্টরপন্থীরা বুঝতে পেরেছে যে ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ প্রতিষ্ঠার সুযোগ সামরিক বিজয়ের কাছাকাছি এসেও হারিয়ে গেছে।

 

ইরানের প্রতিরোধ অক্ষ ভালোই ধাক্কা খেয়েছে। হিজবুল্লাহর নেতৃত্ব ধ্বংস হয়েছে। সিরিয়ায় অতিরিক্ত চাপের মুখে পড়েছে তারা। তবু হামাসের মতো, হিজবুল্লাহকেও শক্তি হিসেবে ধ্বংস করা যায়নি।

 

গাজার এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরে চলমান দমন–পীড়নের কারণে সুন্নি আরব বিশ্ব আগের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষুব্ধ। গাজার জনগণ দেখিয়েছে যে তারা এক সর্বাত্মক যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েও নিজেদের ভূমি ছেড়ে যায়নি। তারা বুক ফুলিয়ে জানিয়েছে যে দখলদারেরা যত চাপই দিক না কেন, আরেকটি নাকবা তারা ঘটতে দেবে না। গাজা ইসরায়েলকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে ফিলিস্তিনিরা আছে। যতক্ষণ না ইসরায়েল তাদের সমান অধিকারের ভিত্তিতে কথা বলবে, তারা শান্ত হবে না।

 

ডেভিড হার্স্ট মিডল ইস্ট আইয়ের প্রধান সম্পাদক