কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ইসরায়েলি আগ্রাসনের সমাধান কোথায়?

সাখাওয়াত হোসেন সুজন । সূত্র : দেশ রূপান্তর, ২৩ মার্চ ২০২৫

ইসরায়েলি আগ্রাসনের সমাধান কোথায়?

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় মানবতার যে বীভৎস রূপের দেখা মিলছে, তাকে নির্মম গণহত্যা আর চরম আগ্রাসন ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। গাজার অসহায় মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এ যুদ্ধ সভ্য পৃথিবীর অসম যুদ্ধগুলোর অন্যতম। নৃশংসভাবে নারী-পুরুষ-শিশুকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার তাণ্ডব চালাচ্ছে দখলদার ইসরায়েল। পবিত্র রমজানে যেখানে যুদ্ধবিরতি অব্যাহত রাখার কথা ছিল, সেখানে নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিরীহ মানুষের ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে তারা। পৃথিবীর ইতিহাস বলে, অন্যায়কারী চিরদিন আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। ইতিহাস সাক্ষী, এমন অসভ্যতা চালিয়ে সোনার মুকুট মিলবে না ঘৃণার প্রতীক হয়ে নর্দমায় খড়কুটোর মতো ভেসে বেড়াতে হবে। রমজানের ইতিহাস কেবল সংযমের নয়, যুদ্ধেরও। ১৭ রমজানই সংঘটিত হয়েছিল বদরের যুদ্ধ। ইতিহাসের টার্নিং পয়েন্ট। অসম যুদ্ধের অন্যতম নজির। সামান্য অস্ত্র, বাহন, জনবল নিয়ে সম্মুখ সমরে যুদ্ধজয়ের এমন দৃষ্টান্ত বিরল। গাজাবাসীর মধ্যে সে প্রেরণাই দেখা যায়, না হলে মাতৃভূমি অথবা মৃত্যুকে তারা কখনই বেছে নিত না।

 

 

এবার ইসরায়েলের হামলা ঐতিহাসিক বদর দিবসের প্রাক্কালেই হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের দৃঢ়তা প্রমাণ করে এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই দাঁড়িয়ে তারা একদিন হাসবে। এখনকার আর্তচিৎকার হুঙ্কারে পরিণত হবে। জালিমের জয় ক্ষণিকের মজলুমের হাসি চিরকালের, তাদের দাবিয়ে রাখা অসম্ভব। মাঝে মাঝে বিশ্ববিবেক কেঁদে কেঁদে যখন বলে ‘মুসলমানদের মানবাধিকার থাকতে নেই’। কথাটায় বিরক্ত হলেও অস্বীকার করার উপায় নেই। যখন দেয়ালের লিখন সামনে আসে ‘একদিন ইতিহাস বলবে গাজা একা লড়েছিল, আর বিশ্ব মুসলিম শুধু তাকিয়েছিল!’ বাহারি ইফতারি আর সাহরি সাজিয়ে যদি অভুক্ত ফিলিস্তিনিদের মলিন মুখটার কথা ভেবে চোখ দিয়ে অশ্রু না গড়ায়, তবে বুঝতে হবে কতটা পাষাণ আমাদের হৃদয়। গাজার সাম্প্রতিক অবস্থা আমাদের মনকে বিধ্বস্ত করে। আলজাজিরার প্রতিবেদন দেখে আঁতকে উঠতে হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গাজা উপত্যকার দক্ষিণ ও উত্তরে বৃহস্পতিবার রাত ও ভোরে সংঘটিত হামলায় কমপক্ষে ৯১ জন নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে শিশু ও নারীদের পাশাপাশি একটি নবজাতক শিশুও আছে। এর মানে যুদ্ধে জন্ম নিয়ে যুদ্ধেই শহীদ হয়েছে শিশুটি। এটা একদিনের হামলার চিত্র।

 
 

হামাসের প্রতিক্রিয়া : এদিকে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে হামলা চালালেও হামাস তাৎক্ষণিক কোনো জবাব দেয়নি। কিন্তু গণহত্যার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার তারা তেল আবিবে রকেট হামলা চালিয়েছে। হামাসের বন্ধু একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, হামাসসহ অন্য যোদ্ধাদের পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় সতর্ক করা হয়েছে। তাদের মোবাইল ফোন ব্যবহার বন্ধ করতেও বলা হয়েছে। হামাসের মনোযোগ মূলত আরেক দফা যুদ্ধবিরতির দিকে। ইসরায়েলি সেনারা জানিয়েছে, তারা গাজা থেকে ছোড়া একটি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করেছে, অন্য দুটি একটি খোলা জায়গায় পড়েছে। তবে হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত সপ্তাহে ইসরায়েলি হামলায় ২০০ শিশুসহ কমপক্ষে ৫০৬ জন নিহত হয়েছে। কারও কারও মতে নিহতের সংখ্যা ৭০০ ছাড়িয়েছে। আহতও হয়েছে হাজারের বেশি। লাশের সারি, ক্ষতিগ্রস্ত ও আহতের সারি আরও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে পারে। সামনে এ নৃশংসতা না থামলে গাজা রক্তপিচ্ছিল জনপদে রূপ নিতে পারে।

 

 

 

জবাব চেয়েছে জাতিসংঘ : গত বুধবার মধ্য গাজায় জাতিসংঘের একটি স্থাপনায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় জাতিসংঘের একজন বিদেশি কর্মী নিহতসহ আরও পাঁচজন কর্মী আহত হয়েছেন। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা প্রধান টম ফ্লেচার এই হামলার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের পুনরায় হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তিনি বলেন, ‘গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় আমি ক্ষুব্ধ।’

 

 

নেতজারিম করিডরের দখল : গাজায় ইসরায়েলি সেনারা স্থল অভিযান পুনরায় শুরুর সঙ্গে সঙ্গে নেতজারিম করিডরের নিয়ন্ত্রণও পুনরুদ্ধার করেছে। এই করিডর পুনরায় দখলের পদক্ষেপ যুদ্ধবিরতির আগের খারাপ স্মৃতি ফিরিয়ে আনছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ইসরায়েলি সেনারা বড় পরিসরে অভিযানের জন্য এগিয়ে যাচ্ছে। সামরিক অভিযানের জন্য এটি একটি লঞ্চিং প্যাড, ফিলিস্তিনিদের জন্য ‘মৃত্যু ফাঁদ’।

 

 

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ : মসনদ টেকাতে যুদ্ধবিরতি ভেঙেছেন নেতানিয়াহু। এমনটাই ভাবছেন ইসরায়েলিরা। এজন্য তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। অনেকের স্বজন এখনো হামাসের কাছে জিম্মি। স্বজনদের ফিরে পেতে তারা আশায় বুক বেঁধেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধবিরতির চুক্তি লঙ্ঘন করে হামলার কারণে তারা শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। জেরুজালেমে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।

 

 

পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে : জানুয়ারি থেকে দুই মাস তুলনামূলক শান্ত থাকার পর ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনে আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ফিলিস্তিন পরিস্থিতি। তাদের সর্বাত্মক বিমান ও স্থল অভিযানে গাজায় ফের রক্তপাত শুরু হয়েছে। ফের অনিশ্চয়তায় পড়েছে গাজাবাসীর জীবন। ‘যুদ্ধ ফিরে এসেছে, বাস্তুচ্যুতি এবং মৃত্যু ফিরে এসেছে, আমরা কি এ যাত্রায় বেঁচে থাকব?’ রয়টার্সের কাছে এমন প্রশ্ন করেছেন, বাস্তুচ্যুত এক তরুণ সামেদ সামি। যুদ্ধবিরতির ফলে হুদা জুনাইদ, তার স্বামী এবং পরিবার তাদের বাড়ির ধ্বংসস্তূপে ফিরে গিয়ে শিবির স্থাপন করতে পেরেছিলেন। কিন্তু এখন তারা আবার পালাতে বাধ্য হয়েছেন। নিজেদের অবশিষ্ট কিছু জিনিসপত্র গাধার গাড়িতে তুলে একটি স্কুলের কাছে তাঁবু স্থাপনের জন্য নতুন জায়গা খুঁজছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ চাই না, আমরা মৃত্যু চাই না। যথেষ্ট হয়েছে, আমরা ক্লান্ত, গাজায় আর কোনো শিশু নেই, আমাদের সমস্ত শিশু মারা গেছে, আমাদের সমস্ত আত্মীয়-স্বজন মারা গেছে।’ এই আকুতি যদি যুদ্ধবাজদের হৃদয়কে নাড়া দেয় তাহলে হয়তো যুদ্ধ থামবে। নয়তো অসম এ যুদ্ধের সমাপ্তির গল্পটা ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেবে। নারকীয় তাণ্ডব চালানো ইসরায়েলকেও থামতে হবে। পৃথিবীতে যুদ্ধ চিরকাল চলে না। বদরের অনুপ্রেরণায় দৃঢ় পদক্ষেপে দাঁড়িয়ে থাকা হামাস কোনো নতুন ইতিহাস রচনা করে কি-না তা দেখতেও প্রহর গুনতে হবে।

 

 

লেখক : সাংবাদিক ও অনুবাদক