ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ : দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে
ডেভিড স্মিথ । সূত্র : প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি জানিয়েছেন, ইউক্রেনে শান্তির দাবি পুতিন মেনে নেবেন। তার দাবি অনুযায়ী, যুদ্ধ থামানোর জন্য ইউরোপের শান্তিকামী মধ্যস্থতাকারীদের দাবিগুলো রুশ প্রেসিডেন্ট মেনে নেবেন। এজন্য একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে গলায় কাঁটা হয়ে থাকা এ বড় যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে ট্রাম্প এমনভাবে হোয়াইট হাউসে মন্তব্য করেছেন যেন সবকিছু এখন অনেক বেশি সহজ মনে হচ্ছে। ট্রাম্পের সঙ্গে এ সময় উপস্থিত ছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাঁখো। কিন্তু এ সভা দ্রুতই শেষ হয়ে যায়। ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান বন্ধের জন্য জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব পাস এবং রাশিয়াকে দায়ী করার পক্ষে ভোট দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তর কোরিয়া, বেলারুশ এবং রাশিয়ার মিত্র রাষ্ট্রগুলোও বিপক্ষেই ভোট দিয়েছে। বিষয়টিকে ইতোমধ্যে ডেমোক্র্যাটরা ন্যক্কারজনক বলে অভিহিত করেছেন। ট্রাম্পকে তুলাধুনা করার রসদও এখানেই তারা পেয়েছেন।
ওই সভায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মাখোঁ জানান, শান্তিচুক্তি যদি স্থাপিত হয় তাহলে ফ্রান্স ইউক্রেনকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সহায়তা দিতে প্রস্তুত রয়েছে। তবে সম্মুখসমরে ইউক্রেনকে কোনো ধরনের সহযোগিতা দেশটি দিতে পারবে না। ট্রাম্পও জানিয়েছেন, ইউক্রেনে ইউরোপীয় সেনাদের শান্তি স্থাপনের জন্য পাঠানোর বিষয়ে কোনো আপত্তিকর কিছু নেই। এ সময় তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই জানান, পুতিনের কাছে যখন তিনি এ বিষয়ে প্রশ্ন করেছেন তখন তিনি রাজি হয়েছেন। তিনি জানান, ‘আপনারা আগে বুঝুন। আমরা এ চুক্তি করলে তিনি আর কোনো যুদ্ধ করবেন না।
তার এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ বা আপত্তি নেই।’ ইতোমধ্যে ট্রাম্প ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে ‘স্বৈরাচার’ তকমা দিয়েছেন। তিনি এ যুদ্ধের জন্য জেলেনস্কিকেই দায়ী করেছেন। তিনি এও ইঙ্গিত করেছেন, ইউরোপের সঙ্গে এক ধরনের দূরত্ব তৈরিতেও জেলেনস্কির দায় রয়েছে। একটি সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘এবার এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান ঘটা জরুরি। আমাদের শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ বিষয়ে আমরা বেশ কয়েকবার কথা বলেছি। রাশিয়াও এ আলোচনায় যুক্ত হয়েছে- …আমাদের লক্ষ্য যত দ্রুত সম্ভব একটি যুদ্ধবিরতি শুরু করা এবং অবশেষে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করা।’ তিনি এও বলেন, ‘যদি ইমানুয়েল একমত হন তাহলে আমরা আরও জরুরি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারব।’ ট্রাম্প ইউক্রেনের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তার বিষয়টিও আশ্বস্ত করেছেন।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টও জানিয়েছেন, ট্রাম্প এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিয়ে ফেলেছেন। তবে তিনি জানিয়েছেন, যুদ্ধবিরতি মানেই ইউক্রেনকে রাশিয়ার কাছে সমর্পণ করে দেওয়া নয়। এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার কাছ থেকে সব ধরনের নিশ্চয়তা পেলেই চুক্তি বাস্তবায়ন করা হবে। একই সময়ে পুতিনও ইঙ্গিত দিয়েছেন, এ যুদ্ধ বন্ধে ইউরোপের সংযুক্তি তিনি মন্দভাবে দেখছেন না। ফ্রান্স প্রেস নামক একটি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘শুধু ইউরোপীয় রাষ্ট্রই নয়, অন্য রাষ্ট্রও এখানে ইতিবাচক ভূমিকার জন্য যুক্ত হতে পারে।’ ট্রাম্প এবং তার দল ইউক্রেনের সঙ্গে খনিজ পদার্থ বণ্টনের বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। এভাবে বিগত প্রশাসন কিয়েভে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সহায়তা পাঠিয়ে যা খরচ করেছে, তার কিছুটা উদ্ধার করতে পারবে। ট্রাম্প এ ছাড়া দ্রুত যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নের জন্য জেলেনস্কির সঙ্গে আলাপের কথা জানিয়েছেন। এ আলোচনা শিগগির হতে পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। জেলেনস্কির সঙ্গে আলোচনার সময় তিনি পুতিনের সঙ্গেও আলাপ করবেন বলে জানিয়েছেন।
গত সপ্তাহে ইউক্রেনের কাছে যুক্তরাষ্ট্র ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিরল ও দামি খনিজ দাবি করে। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের যুদ্ধকালীন সহযোগিতার জন্য সামান্য এ অর্থ দাবি করে। তবে জেলেনস্কি এ দাবি মেনে নেননি। দ্রুতই তা নাকচ করে দেন। ট্রাম্প জেলেনস্কিকে এও বলে দিয়েছেন, এখনও ইউক্রেনকে সহায়তার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্ত দেয়নি। তাই জেলেনস্কিকে অনেক ভেবেই কোনো প্রস্তাব নাকচ করতে হবে। ইউরোপীয় নেতাদের মধ্যে মাখোঁই প্রথম ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করেছেন। ইউক্রেন নিয়ে জি-৭ জোটভুক্ত অন্য রাষ্ট্রগুলো আলোচনাও করেছে। দুজনই একই বিষয়ে একমত ছিলেন। যুদ্ধ থামাতে হবে। তবে ট্রাম্প একসময় যুদ্ধে অর্থায়ন নিয়ে মিথ্যা তথ্য দিলে মাখোঁকে দ্বিমত পোষণ করতে হয়।
তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, ইউক্রেনকে ইউরোপ যুদ্ধে কোনো সহযোগিতা দিচ্ছে না। তারা ইউক্রেনকে আপাতত ঋণ দিচ্ছে। অর্থাৎ সব মিলিয়েই জেলেনস্কি বিপদে। কারণ, ইউরোপের নেতারাও বুঝিয়ে দিয়েছেন, এখন পর্যন্ত ইউক্রেনকে দেওয়া সব অর্থই ইউরোপ ফিরিয়ে নেবে। এখন পর্যন্ত ইউক্রেন যুদ্ধের অর্থায়নে ইউরোপ ৬০ শতাংশ অবদান রেখেছে। তারাও যুক্তরাষ্ট্রের মতোই ইউক্রেনকে ঋণ দিয়েছে। তারা ঋণের বিনিময়ে নিশ্চয়তা আর অর্থ পেয়েছে। তবে এ ঋণকে তারা নিজস্ব বলেও মেনে নিচ্ছে না। এগুলোকে ফ্রোজেন বলে দাবি করা হয়েছে। অনেকের মতে, এ সবকিছুই সম্ভবত ইউক্রেনকে চুক্তি মেনে নিতে চাপ দেওয়ার জন্য করা হচ্ছে। এখনও ইউরোপের কাছে রাশিয়া থেকে জব্দ করা ২৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ ফ্রোজেন অ্যাসেট আছে।
ট্রাম্পও ইউরোপের এ কথাকেই টেনে জানিয়েছেন, ইউরোপের মতো যুক্তরাষ্ট্রও তাদের বিনিয়োগ করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে চায়। বিগত প্রশাসন এ কাজে ব্যর্থ হলেও ট্রাম্প এবার তা সফল করবেন; অন্তত এমনটিই তার কথায় প্রতীয়মান হচ্ছে। ট্রাম্পের ক্ষমতারোহণের আগে রাশিয়ার সঙ্গে দেশটির যোগাযোগ ছিল না বললেই চলে। ট্রাম্প ফেরার পর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আবার যুক্ত হয়। এর আগে রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কলই ধরছিল না। এদিকে ট্রাম্প জানাচ্ছেন, তিনি ক্ষমতায় ফিরে প্রথম কলেই পুতিনের সঙ্গে আলাপ করে ফেলেছেন। তারা দুজন একে অন্যকে যথেষ্ট আন্তরিকভাবেই সম্বোধন করেছেন। তারা দুজনই যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য আলোচনা করেছেন। আর এর পর থেকেই বিষয়টি বড় বিষয় হিসেবে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতে এখন যুদ্ধবিরতি করা মূলত পুতিনেরই স্বার্থ রক্ষা করবে। আর এ স্বার্থরক্ষা ইতিবাচকই হয়ে থাকবে।
অন্যদিকে, মাখোঁর মতে এ সময়ে ইউরোপে শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্পই নেই। কিন্তু তার জন্য প্রথমে করণীয় কী হতে পারে, এ বিষয়ে একটি দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি ছিল। এজন্য তাদের সব যাচাই এবং বিশ্লেষণ করে এগোতে হয়েছে। ইউরোপ এখন শান্তি চায়। তবে তারা দুর্বল কোনো চুক্তি স্বাক্ষর করতে রাজি নয়।
এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে, কিছু দিনের মধ্যেই যুদ্ধবিরতির রূপরেখা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে। ইউরোপ জেলেনস্কির নেতৃত্বকে প্রশংসার চোখেই দেখছে। তাই এখন ট্রাম্পের সঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের দেখা করার বিষয়েও তারা জোর দিয়ে চলেছে। অর্থাৎ রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের পথ না নিয়ে তারা ইউক্রেনকে পিছু হটার দিকটিতে জোর দিচ্ছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমারও অতি শিগগির ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করবেন। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের অবস্থান ব্রিটেন বেশ শক্ত হিসেবেই বিবেচনা করছে। তাদের মতে তিন বছর ধরে চলমান এ যুদ্ধের পেছনে রাশিয়ার প্রভাব ট্রাম্প যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে বিচার করছেন না। বিশেষত জাতিসংঘে এ সংঘাতের জন্য রাশিয়াকে দোষী করে একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করা হলেও যুক্তরাষ্ট্র এর পক্ষে ভোট দেয়নি। প্রস্তাবটি পাস হলে রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক মহল ইউক্রেনের দখল করা ভূমি ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে চাপ দিতে পারত। যুক্তরাষ্ট্র ও আর কটি দেশ বাদে অধিকাংশই এ বিলটি দ্বিধা ছাড়া পাস করে দিয়েছে।
ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে পরিচিত এক সিনেটর, শেলডন হুইটহাউস বলেছেন, এ ধরনের ভোট ন্যক্কারজনক। ট্রাম্প ইউক্রেনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাই করলেন। এ বিষয়ে তার ভ্রুক্ষেপও নেই। তার মতে, ট্রাম্প এমন এক মিত্রতা ধ্বংস করছেন যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রকে নিরাপদ রেখে চলেছে। তার মতে পুতিন একজন ধ্বংসকারী। তিনি শুধু রক্তপাত এবং ধ্বংস চান। এভাবে রাশিয়ার সঙ্গে আঁতাত গড়লে উল্টো যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে। অর্থাৎ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নতুন মেরুকরণ ঘটছে। এ অবস্থায় পরিস্থিতি কোথায় যাবে তা খুব দ্রুতই কিছুটা আভাস পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে।
- মার্কিন সাংবাদিক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ : আমিরুল আবেদিন