ইউক্রেন যুদ্ধের লাগাম এখন ট্রাম্প-পুতিনের হাতে
ড. ফরিদুল আলম ।। সূত্র : কালের কণ্ঠ ২৭ নভেম্বর

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান পরবর্তীতে পশ্চিমাদের প্রত্যক্ষ মদদে যুদ্ধে রূপলাভ করে। এই যুদ্ধের শুরু থেকেই মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে ইউক্রেনকে সহায়তা অব্যাহত রাখতে থাকলেও সময়ের পরিক্রমায় এটি ক্রমেই বিস্তৃত হয়েছে। এর আগে আমরা দেখেছি যেকোনো বৈশ্বিক সংঘাতে যেখানে বড় এবং শক্তিশালী দেশগুলো মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে সংকট প্রশমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে চীন ছাড়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সব কয়টি দেশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। ফলে এই সংকট প্রশমনে কার্যত মধ্যস্থতাকারী দেশ হিসেবে এগিয়ে আসছে না কেউ।
এই অবস্থায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের একটি সিদ্ধান্তের কারণে গোটা পরিস্থিতি আবারও এক অনিশ্চিত অবস্থার দিকে মোড় নিল।
বাস্তবে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এ ধরনের পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে উত্তেজনা আরো বাড়বে কি না এর পুরোটাই অবশ্য নির্ভর করছে প্রেসিডেন্ট পুতিনের ওপর।
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধের যে ঘোষণা দিয়েছেন, তাতে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের দিক থেকে শেষ সময়ে এসে উসকানির মধ্য দিয়ে এটিকে আরো ক্ষতিকর দিকে নিয়ে যাওয়ার যে উদ্দেশ্য দেখানো হয়েছে, প্রেসিডেন্ট পুতিনের পরিণত রাজনৈতিক মেধা এটিকে রোধ করে দিতে পারে। যদিও এই যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই রাশিয়ার পক্ষ থেকে একাধিকবার পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহারের বিষয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছিল, তবে তা ছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্রদের তাদের তৈরি অস্ত্রের ব্যবহার রোধের বিষয়ে একধরনের হুঁশিয়ারি, এত দিন পর্যন্ত পশ্চিমারা এটিকে সচেতনভবেই এড়িয়ে এসেছে। তবে এই পর্যায়ে এসে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে তাদের এটিসিএমএস ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার মাধ্যমে জো বাইডেনের দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ডকেই প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে। এই এটিসিএমএস এমন এক প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে শত শত বোমা দিয়ে একটি ওয়ারহ্যাড বানানো হতে পারে, যা একটি বড় এলাকাজুড়ে হালকা সাঁজোয়া যান ধ্বংস করতে পারে। আর অপরটি হচ্ছে একটিমাত্র বোমা, যার মধ্যে উচ্চ মাত্রার বিস্ফোরক দিয়ে ২২৫ কেজি ওজনের বোমা তৈরি করা হয়, যার মাধ্যমে শত শত সামরিক স্থাপনা এবং অবকাঠামোর ব্যাপক ধ্বংস চালানো যেতে পারে।
সংগত কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সবুজ সংকেতে তাদের তৈরি এই বোমা দিয়ে যখন ইউক্রেনের তরফ থেকে রুশ ভূখণ্ডে হামলা পরিচালনা করা হয়, এটিকে মার্কিনদের তরফ থেকে রাশিয়ার প্রতি একটি আক্রমণ হিসেবে তুলনা করা হলো। তবে এর মাধ্যমে ইউক্রেন যে অব্যাহতভাবে এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা চালাতে থাকবে, সেটাও ভাবার অবকাশ নেই। কারণ এর পর্যাপ্ত মজুদ নেই তাদের কাছে। যুক্তরাষ্ট্র এই সময়ে ইউক্রেনকে এটি দিয়ে কতটুকু সক্ষম করতে চাইবে বা পারবে সেটাও এক প্রশ্নের বিষয়। এ ক্ষেত্রে সংগত কারণেই প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে কেন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে এ ধরনের হামলার বিষয়ে ইউক্রেনকে সবুজ সংকেত দেওয়া হলো। এর উত্তরে এটাই বলা যেতে পারে যে এই যুদ্ধের পেছনে বাইডেন প্রশাসনের ইচ্ছাকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং এই সময়ে এসে রাশিয়ার দিক থেকে এমন কিছু প্রতিক্রিয়া দেখতে চাওয়া, যা পরবর্তী প্রশাসনকে এই যুদ্ধটি চালিয়ে নিতে বাধ্য করবে এবং এর দ্বারা বাইডেনের সিদ্ধান্তের এক ধরনের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠিত হবে।
পুতিনের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এহেন পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, এমন মন্তব্য করা হলেও এখানে তার ধৈর্যচ্যুতি কিংবা বাইডেন প্রশাসনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়ার প্রচেষ্টা সত্যিই এক বিপর্যয়ের জন্ম দিতে পারে। তবে বাস্তবে এর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। যদিও এরই মধ্যে রাশিয়া প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে দিয়েছে। বিভিন্ন বিমান ঘাঁটিতে যুদ্ধবিমান মোতায়েনসহ সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করেছে তারা। বলা যায় সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছে তারা। প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার মেয়াদের শেষ দিন পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নেন সেটা বলা যাচ্ছে না—এমনটাই হয়তো আঁচ করছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। তবে তিনি নিশ্চয়ই ট্রাম্পের যুদ্ধ বন্ধের অঙ্গীকারের বিষয়ে আস্থাহীন হতে চাইবেন না। এ ক্ষেত্রে এই এটিসিএমএস-এর ব্যবহার প্রেসিডেন্ট পুতিনের জন্য কিছুটা নিবারক হিসেবে কাজ করতে পারে। কারণ এত দিন ধরে ইউক্রেনের উত্তরের অংশগুলো একের পর এক অভিযান করে দখলে নিচ্ছিল রুশ বাহিনী। এই এটিসিএমএস ব্যবহারের ফলে এখন তারা এর আরো ব্যবহারের ঝুঁকিতে রয়েছে, যা ইউক্রেনকে এক ধরনের সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে। ফলত প্রেসিডেন্ট বাইডেন যা চাচ্ছেন, অর্থাৎ পুতিন যেন আরো আগ্রাসী হয়ে কোনো বড় ধরনের ভুল করে বসেন, বাস্তবে তা না ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। আর এমনটা হলে বাইডেন নিজের অজান্তেই তার উত্তরসূরি ট্রাম্পের জন্য একটা উপকার করে দিলেন। কারণ এর মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের আগ পর্যন্ত রাশিয়া তাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাব্যবস্থা মজবুত করার স্বার্থে তাদের অভিযানের লাগাম টেনে ধরবে আর ট্রাম্প এসে যুদ্ধবিরতি প্রক্রিয়াকে আরো মসৃণভাবে এগিয়ে নিতে পারবেন।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়