ইউক্রেনের ৪টি অঞ্চল রাশিয়াকে দিতে চান ট্রাম্প
উইটকফ মনে করেন, ইউক্রেনের পূর্বদিকের চারটি অঞ্চলকে নিজেদের মালিকানায় আনতে রাশিয়া যে কৌশল নিয়েছে, তাকে সমর্থন দেয়াটাই ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার একটি দ্রুততম উপায়। সূত্র : নয়া দিগন্ত, ১৩ এপ্রিল ২০২৫

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে হোয়াইট হাউজে বৈঠক করেছেন মস্কোর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনায় নেতৃত্বদানকারী বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ। তিনি ট্রাম্পের সাথে বৈঠকে একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন। উইটকফ মনে করেন, ইউক্রেনের পূর্বদিকের চারটি অঞ্চলকে নিজেদের মালিকানায় আনতে রাশিয়া যে কৌশল নিয়েছে, তাকে সমর্থন দেয়াটাই ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার একটি দ্রুততম উপায়। খবর : রয়টার্স।
দুই মার্কিন কর্মকর্তা এবং ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট আরো পাঁচ ব্যক্তি রয়টার্সকে এ তথ্য জানিয়েছেন। ২০২২ সালে ইউক্রেনের ওই চার অঞ্চলকে রাশিয়া অবৈধভাবে নিজেদের সাথে যুক্ত করার চেষ্টা চালিয়েছিল। এর আগেও উইটকফ একই ধরনের মনোভাব জানিয়েছিলেন। এমনকি গত মাসে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব টাকার কার্লসনকে দেয়া একটি পডকাস্ট সাক্ষাৎকারে প্রকাশ্যে তিনি এমন অভিমত জানিয়েছিলেন। তবে ইউক্রেন বারবারই এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের কেউ কেউ একে মূলত রাশিয়ার দাবি বলে উল্লেখ করেছেন।
ইউক্রেনে নিযুক্ত মার্কিন দূত জেনারেল কিথ কেলোগ ট্রাম্পের সাথে বৈঠকে উইটকফের বিরুদ্ধে পাল্টা যুক্তি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইউক্রেন বিবাদপূর্ণ ভূমিসংক্রান্ত কিছু শর্ত নিয়ে আলোচনা করতে ইচ্ছুক হলেও রাশিয়ার কাছে একতরফাভাবে অঞ্চলগুলোর সম্পূর্ণ মালিকানা হস্তান্তরে কখনোই রাজি হবে না। সংশ্লিষ্ট দু’টি সূত্র এ কথা জানিয়েছে। বৈঠকে মার্কিন কৌশল বদলানোর বিষয়ে ট্রাম্প কোনো সিদ্ধান্ত জানাননি। তার সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠকটি শেষ হয়। গত শুক্রবার পুতিনের সাথে বৈঠক করতে রাশিয়ায় সফর করেন উইটকফ।
ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে অচলাবস্থা কিভাবে ভাঙা যাবে, তা নিয়ে উইটকফের সাথে ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মতবিরোধ ক্রমাগত বাড়ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন কেলোগ। তিনি চান, ইউক্রেনকে আরো বেশি সরাসরি সমর্থন দেয়া হোক। সংশ্লিষ্ট মার্কিন কর্মকর্তা ও ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ থাকা চার পশ্চিমা কূটনীতিক সূত্রে এমন কথা জানা গেছে।
তা ছাড়া কেলোগ ইউক্রেনকে ভাগ করার প্রস্তাব দিয়েছেন বলে যে অভিযোগ উঠেছে তা অস্বীকার করেছেন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমসকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ব্রিটিশ ও ফরাসি সেনারা ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলে একটি ‘নিরাপত্তা বলয়’ গঠন করতে পারে, যেখানে রাশিয়ার সেনারা পূর্বাঞ্চলে অবস্থান করবে। এ প্রস্তাবকে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বার্লিনের সাথে তুলনা করেন। তবে পরে এক্সে (টুইটার) কেলগ লিখেছেন, আমি ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যুদ্ধবিরতি-পরবর্তী সহায়ক বাহিনীর কথা বলেছি, দেশটিকে ভাগ করার কথা বলিনি।
সাধারণ নিরাপত্তাবিধি ভেঙে রাশিয়ার বিশেষ দূত কিরিল দিমিত্রিয়েভকে নিজের ব্যক্তিগত বাসভবনে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন উইটকফ। এরপর হোয়াইট হাউজে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। তবে সংশ্লিষ্ট দুই ব্যক্তি বলেছেন, হোয়াইট হাউজ ও পররাষ্ট্র দফতর থেকে এ ব্যাপারে উইটকফকে সতর্ক করা হয়। সাধারণত মার্কিন কর্মকর্তারা রাশিয়া থেকে আসা কর্মকর্তাদের নিজেদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়টি এড়িয়ে চলেন।
শেষ পর্যন্ত উইটকফের বাড়িতে আর নৈশভোজ হয়নি, বরং হোয়াইট হাউজেই এর আয়োজন করা হয়। উইটকফ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অনেক দিনের বন্ধু। গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বিজয় অর্জনে তিনি ট্রাম্পকে সহযোগিতা করেছেন। ইউক্রেনকে নিয়ে সংশয়বাদী কিছু রিপাবলিকান সদস্য উইটকফকে সমর্থন দিলেও তার প্রস্তাবের বিষয়ে অন্য রিপাবলিকানরা ক্ষোভ জানিয়েছেন। এসব রিপাবলিকান সদস্যের ধারণা, ট্রাম্প প্রশাসন ব্যাপকভাবে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েছে।
কার্লসনের সাথে সাক্ষাৎকারে উইটকফ রাশিয়াপন্থী যে অবস্থান দেখিয়েছেন, তাতে মার্কিন কংগ্রেসের কিছু রিপাবলিকান সদস্য এতটাই উদ্বিগ্ন হয়েছেন যে তারা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়ালৎস এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর প্রতি আহ্বান জানান। গত জানুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণের পর ট্রাম্প মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন এনেছেন।
যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হতে তিনি ইউক্রেনকে চাপ দিচ্ছেন। পাশাপাশি ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরু হওয়ার পর বাইডেন প্রশাসন ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে যেসব শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছিল, তার অনেকগুলোই ট্রাম্প শিথিল করে দিয়েছেন। উইটকফ ট্রাম্পের কৌশল অনুসরণ করায় মার্কিন ও ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের কেউ কেউ উদ্বেগে পড়েছেন।
তাদের আশঙ্কা, আলোচনার টেবিলে বসার মতো যথেষ্ট অভিজ্ঞতা তার না থাকায় রুশ পক্ষ এর ফায়দা নিতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জানাশোনা থাকা দুই কর্মকর্তা এবং আরো কয়েকজন ব্যক্তির সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে। গত ২৬ মার্চ রিপাবলিকান দলের গুরুত্বপূর্ণ অনুদানকারী এরিক লেভিনের লেখা এক চিঠিতে বলা হয়, ‘উইটকফকে সরতে হবে, তার জায়গায় রুবিওকে দায়িত্ব নিতে হবে।’
রিপাবলিকান দলের অনুদানকারীরাসহ কয়েকজনের কাছে চিঠিটি পাঠানো হয়। চিঠিটি লেখা হয়েছে কার্লসনকে সাক্ষাৎকার দেয়া এবং ফক্স নিউজে উইটকফের উপস্থিতির পর। পুতিনের প্রশংসা করায় চিঠিতে উইটকফের সমালোচনাও করা হয়েছে। ট্রাম্প বারবারই বলেছেন, তিনি চান, মে মাস নাগাদ ইউক্রেনে একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হোক। তবে আংশিকভাবে হওয়া দু’টি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্থবির হয়ে আছে। সেগুলোর একটি জ্বালানি অবকাঠামো এবং অপরটি কৃষ্ণসাগর নিয়ে হওয়ার কথা ছিল। এ ক্ষেত্রে তেমন একটা অগ্রগতি না হওয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হতাশা প্রকাশ করেছেন।
উইটকফের পক্ষে-বিপক্ষে মত : ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতিতে উইটকফ একটি কেন্দ্রীয় ও ক্রমবর্ধমান ভূমিকা পালন করেন। ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের আগেও উইটকফ গাজায় দীর্ঘ প্রতীক্ষিত যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে সহযোগিতা করেছিলেন। যদিও গাজার সে যুদ্ধবিরতি তখন থেকে অমীমাংসিত অবস্থায় আছে। এরপর রাশিয়া থেকে মার্ক ফোগেল নামের এক মার্কিন নাগরিককে দেশে ফেরানোর জন্য আলোচনা করেছিলেন তিনি।
গত শুক্রবার পুতিনের সাথে বৈঠক করতে উইটকফ রাশিয়ায় যান এবং ইরানের সাথে আলোচনার জন্য আজ (গতকাল) শনিবার তার মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার কথা। এটি কার্যত উইটকফের জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত আরেকটি শীর্ষ অগ্রাধিকারের বিষয়। গত ২১ মার্চ কার্লসনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে উইটকফ চারটি ইউক্রেনীয় অঞ্চলকে রাশিয়ার কাছে হস্তান্তরের ধারণা প্রকাশ্যে উত্থাপন করেছিলেন।
এ চারটি অঞ্চল হলো লুহানস্ক, দোনেৎস্ক, জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসন। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চল সম্পর্কে উইটকফ বলেন, ‘তারা রুশভাষী। সেখানে অনুষ্ঠিত গণভোটে বিপুলসংখ্যক মানুষ ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তারা রাশিয়ার শাসনাধীন থাকতে চান।’
উইটকফের মন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের অনেক জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে হতবাক করেছে। তাদের মতে, বিশেষ দূতের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে রুশ কর্মকর্তাদের চাওয়ারই প্রতিফলন ঘটেছে। পশ্চিমা দেশগুলোর সরকার ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে তাড়াহুড়ো করে আয়োজিত ওই গণভোটকে একটি প্রহসন বলে অভিহিত করেছে। তারা এ গণভোটের ফলকে স্বীকৃতি না দেয়ার অঙ্গীকার করেছে।
কার্লসনকে উইটকফ সাক্ষাৎকার দেয়ার মাত্র কয়েক দিন পরে রুপার্ট মারডুকের নিউজ করপোরেশনের মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ‘স্টিভ উইটকফ টেকস দ্য ক্রেমলিনস সাইড’ বা ‘স্টিভ উইটকফ ক্রেমলিনের পক্ষ নিচ্ছেন’ শিরোনামে একটি উপসম্পাদকীয় প্রকাশ করে। ডেমোক্র্যাটরাও উইটকফের সমালোচনা করেছেন।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শাসন মেয়াদে পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী নেড প্রাইস বলেন, ‘উইটকফ ও ট্রাম্প এক বিশাল কূটনৈতিক পাপ করেছেন। একটি চুক্তির জন্য তাদের মরিয়া মনোভাব পুরোপুরি প্রকাশ করেছেন তারা।’ তবে প্রশাসনের ভেতর উইটকফের অনেক সমর্থকও আছেন। তারা বলেন, পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক কিছু কর্মকর্তা তার বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে কুৎসা রটাচ্ছেন।
কয়েকটি সূত্র বলেছে, উইটকফ ও ট্রাম্পের মধ্যে এখনো শক্তিশালী ব্যক্তিগত সম্পর্ক বজায় আছে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়ালৎস সংবাদমাধ্যম দ্য হিলকে পাঠানো এক বিবৃতিতে উইটকফের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন।