কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ এখন ট্রাম্পের হাতে

ড. ফরিদুল আলম । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১৪ মার্চ, ২০২৫

ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ এখন ট্রাম্পের হাতে

তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসা যুদ্ধের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে আসা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধের অবসান চাইছে। পুরো বিষয়টির জন্য দায় চাপানো হচ্ছে ইউক্রেনের বর্তমান নেতৃত্বের ওপর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপের দেশগুলোও এই যুদ্ধে সহায়তা দিয়েছে, যদিও তা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় কম, তবে তারা এখনো ইউক্রেন এবং এই যুদ্ধের বৈধতার পক্ষে তাদের তৎপরতা চালাচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের মধ্যে কৌশলগত স্বার্থের জায়গায় বড় ধরনের চিড় ধরার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

 

 

 
ইউরোপের এ ধরনের তৎপরতা যে ট্রাম্প ভালোভাবে নেননি, সেটির জানান দিতে বিলম্ব করেননি তিনি। প্রথমে ইউক্রেনে সামরিক এবং পরে গোয়েন্দা সহায়তা বন্ধের ঘোষণা দেন। এর মাধ্যমে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হলো যে এই যুদ্ধে তিনি ইউক্রেনের পক্ষ ত্যাগ করেছেন।

ভীষণ এক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এখন ইউক্রেন এবং গোটা ইউরোপ।

 
 
 
 

 

আসলে এই যুদ্ধ শুরুর আগেই এমন ধরনের ফলাফল লিখিত হয়ে গিয়েছিল। মার্কিন প্রশাসন এত ব্যয় করে এই যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে যদি রাশিয়ার বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার চিন্তা করে থাকে, তবে সেটি মস্ত বড় একটি ভুল ছিল। এখানে বাইডেনের পরিকল্পনা এবং এর যথার্থতা নিয়ে আলোচনা করার আর কোনো অবকাশ নেই। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাট তথা বাইডেন প্রশাসন বিদায়ের পর ট্রাম্পের নেতৃত্বে রিপাবলিকান প্রশাসন এত দিন ধরে চলে আসা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে এক বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে, আর তা হচ্ছে তারা একচেটিয়াভাবে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থকে সর্বাগ্রে নিশ্চিত করতে চাইছে। এত দিন ধরে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইউরোপের সঙ্গে যেসব বিষয় নিয়ে অভিন্ন স্বার্থ জড়িত ছিল, সে জায়গা থেকে তারা অনেকটাই সরে গিয়ে বর্তমানে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ইউক্রেনের বিরল খনিজ পদার্থে নিজেদের ভাগ বসানোর কাজে। এর মধ্য দিয়ে রাশিয়ার শক্তি বৃদ্ধি এবং ভবিষ্যত্ হুমকির বিষয়টি তিনি কিভাবে মোকাবেলা করবেন, সেসব এখনো স্পষ্ট নয়। তবে যে বিষয়টি স্পষ্ট, তা হচ্ছে ইউরোপের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়তে যাচ্ছে এবং আগামী দিনগুলোতে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের একত্রে চলার নীতি অনেকটাই শ্লথ হয়ে যাবে। এ বিষয়ে এরই মধ্যে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ তাঁর এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপের দূরত্ব বৃদ্ধি পেতে যাচ্ছে।’

 

 

এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কোনো অভিপ্রায় ট্রাম্পের রয়েছে—এমন মনে হচ্ছে না, বরং বিষয়টি তাঁর সমন্বিত পরিকল্পনার অংশ বলেই মনে হচ্ছে। ট্রাম্প এর আগের মেয়াদে (২০১৬-২০২০) যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন বহুপক্ষীয় সংস্থাগুলোতে থাকার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অনেক বেশি মূল্য চোকাতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করে এলেও এবার নির্বাচিত হওয়ার আগেই নির্বাচনী প্রচারণাগুলোতে স্পষ্টভাবে ন্যাটো থেকে বের হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিলেন। আর এ ধরনের প্রচ্ছন্ন হুমকির একটি বড় কারণ হলো ন্যাটোতে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সামরিক ও আর্থিক সহায়তা ইউরোপীয় দেশগুলোর তুলনায় দ্বিগুণ এবং এর মধ্য দিয়ে মূলত ইউরোপীয় দেশগুলোই যুক্তরাষ্ট্রের অবদানের মধ্য দিয়ে সুরক্ষা পেয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য লাভের একমাত্র জায়গা হচ্ছে এই সামরিক সংস্থার আর্টিকল ৫, যেখানে এটি নিশ্চিত করা হয়েছে যে ন্যাটোভুক্ত কোনো দেশ আক্রান্ত হলে পুরো সংস্থা তার প্রতিরক্ষায় সমন্বিতভাবে কাজ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের হয়তো এই বোধোদয় হচ্ছে যে ১৯৪৯ সালে ন্যাটো প্রতিষ্ঠার যে প্রেক্ষাপট ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর বর্তমান সময় পর্যন্ত মার্কিন নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি করার মতো কোনো রাষ্ট্র এখন পর্যন্ত নেই। সে ক্ষেত্রে তারা কেনই বা তাদের অর্থে ইউরোপকে সুরক্ষা দিয়ে যাবে? এমন প্রশ্ন থেকেই ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যগুলোকে তাদের জিডিপির ৫ শতাংশ ন্যাটোতে বরাদ্দ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের এখন পর্যন্ত এই সংস্থায় থেকে যাওয়ার প্রাসঙ্গিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। ট্রাম্প নিজ দেশের নিরাপত্তা নিয়ে যতটা আত্মবিশ্বাস ধারণ করেন, ইউরোপীয় দেশগুলো এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনকে সমন্বিত নিরাপত্তা নিশ্চিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে।

 

 

পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে বৈশ্বিক বিষয়ে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ইউরোপের দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক মিলছে না। ট্রাম্পের কথার যৌক্তিকতা রয়েছে। তিনি সম্প্রতি এটিও বলেছেন, সব ইউরোপীয় দেশকে যুক্তরাষ্ট্র যে সহায়তা করে, এর চেয়েও বেশি সহায়তা করতে হয়েছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনকে, যার ফলাফল ‘শূন্য’। তিনি এ ধরনের যুদ্ধ চালাতে চাইছেন না। সে ক্ষেত্রে রাশিয়ার যে আগ্রাসী মনোভাব, সেটিকে কি তবে তিনি প্রশ্রয় দিচ্ছেন? এই যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে গোটা পশ্চিমা বিশ্বের সম্পৃক্ততা থাকা সত্ত্বেও রাশিয়া ইউক্রেনের ২০ শতাংশ ভূমির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, যা জেলেনস্কির সঙ্গে ট্রাম্পের বাগবিতণ্ডার পর আরো সম্প্রসারিত হচ্ছে। তবে কি তিনি নীরবে রাশিয়াকে ইউক্রেনের ভূমি দখলে সম্মতি দিচ্ছেন? এই জায়গাটিতে সম্প্রতি নীরবতা ভঙ্গ করেছেন ট্রাম্প। তিনি জানিয়েছেন যে শান্তিচুক্তি না হওয়া পর্যন্ত রাশিয়া যদি তার আধিপত্য ধরে রাখে, এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার বিরুদ্ধেও নতুন করে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি তিনি বিবেচনা করছেন।

 

 

এরই মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ একটি সুবিধাজনক স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিদের দুই দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। আগামী সপ্তাহে আরেকটি বৈঠকের মধ্য দিয়ে যুদ্ধবিরতির বিষয়টি নিয়ে একটি ধারণায় আসা সম্ভব হতে পারে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে আসার পর ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তাঁদের কাছ থেকে নতুন করে আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি পেলেও তিনি এবং তাঁর ইউরোপীয় মিত্ররা এটি নিশ্চিত জানেন যে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাঁরা কিছুই করতে পারবেন না। তা ছাড়া শুরু থেকেই এই যুদ্ধে রাশিয়া অনেকটা সুবিধাজনক জায়গায় রয়েছে। এমন বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর সব রাগ, ক্ষোভ ভুলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং যেকোনো শর্তে এই যুদ্ধ বন্ধে আবার আলোচনায় বসতে আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, সব পক্ষই এখন ট্রাম্পকে গুরুত্ব দিচ্ছে।

 

 

ট্রাম্প এখন সবচেয়ে সুবিধাজনক জায়গায় রয়েছেন এবং এই যুদ্ধ বন্ধে তাঁর যেকোনো উদ্যোগ ইউরোপের মেনে নেওয়া ছাড়া পথ নেই। এরই মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলেনস্কির সঙ্গে ফের আলোচনায় বসার বিষয়ে অনাগ্রহের কথা জানানো ছাড়াও তাঁকে তাঁর পদ থেকে সরে যাওয়ার বার্তা দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি এখন এমন যে যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে জেলেনস্কি যদি সত্বর দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সে ক্ষেত্রে রাশিয়ার সঙ্গে বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি সামনে চলে আসতে পারে, তা হচ্ছে ইউক্রেনের খনিজ পদার্থে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে তারা, বিনিময়ে দনবাস অঞ্চলে রাশিয়ার আধিপত্যের স্বীকৃতি মিলতে পারে। সব শেষে ইউক্রনের জন্য এই যুদ্ধ একটি বড় ট্র্যাজেডি!

 

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়