কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ইউনূস সরকারের ৩০০ দিন : পুনর্মিলন নাকি বিভাজন, কোন পথে বাংলাদেশ

উম্মে ওয়ারা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক [সূত্র : প্রথম আলো, ১৮ জুন ২০২৫]

ইউনূস সরকারের ৩০০ দিন : পুনর্মিলন নাকি বিভাজন, কোন পথে বাংলাদেশ

সহিংস ও কর্তৃত্ববাদী শাসন দমনের পর বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সমাজে শান্তি-সহাবস্থান পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করা হয়। একে বলে ট্রানজিশনাল জাস্টিস বা ক্রান্তিকালীন বিচার। ক্রান্তিকালীন বিচারের আওতাধীন মূল প্রক্রিয়া পাঁচটি। সেগুলো হলো আদালতের বিচার, সত্য উদ্‌ঘাটন ও পুনর্মিলন, ক্ষতিপূরণ প্রদান, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং স্মৃতিচারণামূলক পদক্ষেপ। তবে এ প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে কোনটি কোন সমাজে প্রাধান্য পাবে, তা নির্ভর করে একটি দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ও অন্যান্য পরিস্থিতির ওপর।

 

 

জুলাই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আপামর জনসাধারণ বৈষম্যহীন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের ১০ মাসের খেরোখাতায় সেই হিসাব মেলাতে পারছেন না অনেকেই। একদিকে রয়েছে তৌহিদি জনতা আর মব সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য দমনে সরকারের দৃশ্যত অনিচ্ছা বা অপারগতার অভিযোগ; অন্যদিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার ও নির্বাচন বিষয়ে দীর্ঘসূত্রতা বর্তমান বাংলাদেশকে নানাভাবে বিভাজিত করে চলেছে। এ পরিস্থিতিতে ‘রিকনসিলিয়েশন’ বা সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সহাবস্থানের পুনঃপ্রতিষ্ঠা সবচেয়ে বেশি জরুরি।

 

 


রিকনসিলিয়েশনের আক্ষরিক অনুবাদ হলো পুনর্মিলন বা মিটমাট করা। মূলত সহিংসতা-পরবর্তী সময়ে বিভাজিত বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে মতবিনিময়, ক্ষমা প্রদান বা অন্যান্য প্রাসঙ্গিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সমাজে শান্তি ও সহাবস্থান পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই এর উদ্দেশ্য। আদালতে বিচার, ভিকটিমের ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হলেও পুনর্মিলনের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। অপরাধ দমনে ও আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আদালতে বিচার কার্যকর হলেও সমাজে পুনর্মিলনের ক্ষেত্রে এর তেমন ভূমিকা নেই। তাই সহিংসতা-পরবর্তী সময়ে আদালতে বিচারের পাশাপাশি ট্রুথ ও রিকনসিলিয়েশন কমিশনের প্রচলন ও প্রয়োজন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই দেখা গেছে।

 

 

জুলাই-পরবর্তী বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আইসিটি আদালতের কার্যক্রম আবার শুরু হওয়ার প্রাক্কালে আইন উপদেষ্টা বলেছিলেন, ‘আমরা এই সমাজে আর ক্ষত চাই না। বিভাজন চাই না। বিচারের মধ্য দিয়ে একটা রিকনসিলিয়েশন (পুনর্মিলন) প্রসেসের (প্রক্রিয়া) শুরু করতে চাই।’ (প্রথম আলো, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪)। এরপর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে গত ১০ মে ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ (সত্য ও পুনর্মিলন) কমিশন গঠন করা হবে বলে তিনি জানান।

 

 

তিনি বলেন, ‘গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো ঘৃণ্য অপরাধীরা সংখ্যায় খুব বেশি নয়। তাদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে। তারা (অপরাধীরা) যে এ জাতির মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন, সেটা প্রতিষ্ঠা করার জন্য হলেও ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন করতে হবে।’ এ বক্তব্যে তিনি সত্য উদ্‌ঘাটন ও বিচারের মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার দিকে জোর দিলেও অভ্যুত্থান-পরবর্তী বিভাজিত বাংলাদেশে ‘পুনর্মিলন’ কীভাবে হবে, সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা দেননি। অথচ এই আলাপ বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত জরুরি।

 

 

এখন প্রশ্ন হলো কাদের মধ্যে এই পুনর্মিলন হবে? শুধুই কি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে? নাকি সামাজিক বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যেও বিভাজন দূর করা প্রয়োজন? বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারের এই ১০ মাস সময়ে নারীদের ওপর সহিংসতা, মোর‍াল পুলিশিংসহ নানা পরিসরে হেনস্তা ও অত্যাচারের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বা মুন্সিগঞ্জ লঞ্চে নারীদের হেনস্তার কারণে গ্রেপ্তার করা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জামিনের পর ফুলেল সংবর্ধনা দেওয়ার মতো দুঃখজনক ঘটনাও আমাদের দেখতে হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত এক শর বেশি মাজার ভাঙা, জাতীয় সংগীতের অবমাননা, লালন মেলা অথবা শতবর্ষী কুণ্ডুবাড়ি মেলা বন্ধ হয়েছে।

 

 

অতিসম্প্রতি তৌহিদি জনতার হুমকির কারণে টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে সিনেমা প্রদর্শন ও সিলেটে পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ করা হয়েছে। এসব কারণে ‘ধর্মপ্রাণ মুসলমান পুরুষদের’ নিয়ে সমাজে একটি ভুল ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অথচ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের এই দেশে, ধর্মপ্রাণ পুরুষেরা নারীর স্বাধীনতা ও সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার প্রতি বরাবরই শ্রদ্ধাশীল। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সৃষ্ট এসব ব্যবধান কমাতে না পারলে অন্তর্বর্তী সরকার তার দায় কিছুতেই এড়াতে পারবে না।

 

 

এবার দেখা যাক রাজনৈতিক বিভিন্ন দলের মধ্যে পুনর্মিলনের সম্ভাব্যতা বিচারে বর্তমান সরকার কতখানি আশাবাদী করতে পেরেছে আমাদের।

 

 

আইন উপদেষ্টা ট্রুথ ও রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠনের ঘোষণা যেদিন দিলেন, সেদিন রাতেই এক জরুরি বৈঠকের মাধ্যমে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি সংশোধন এনে সিদ্ধান্ত জানানো হলো, যত দিন আইসিটি ট্রাইব্যুনালে বিচার চলবে, দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। শুধু তা-ই নয়, অনলাইনে দলটির পক্ষে কোনো বিবৃতি বা বক্তব্যও একই সঙ্গে নিষিদ্ধ করা হয়।

 

 

এ সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ‘এর মাধ্যমে দলটির সমর্থকদের কথা বলার স্বাধীনতা ও সমাবেশের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে।’ 

 

 

এ ছাড়া কার্যক্রম স্থগিতের পরপরই নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করেছে। এটি বোধ হয় মনে রাখা দরকার, চব্বিশে পতিত আওয়ামী সরকার ও আওয়ামী লীগ দল এক সত্তা নয়। তাই আওয়ামী লীগ দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামীপন্থী সমর্থক-কর্মীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ না থাকাটিও সমাজে পুনর্মিলনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে।

 

 

গত ২৭ মে আইসিটি ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতা এ টি এম আজহার মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস পাওয়ায় আইন উপদেষ্টা তাঁর সামাজিক গণমাধ্যমের ভেরিফায়েড পেজে লেখেন, ‘এই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টির কৃতিত্ব জুলাই গণ-আন্দোলনের অকুতোভয় নেতৃত্বের।’

 

 

এ ঘটনার এক দিন আগেই আইসিটি ট্রাইব্যুনালে জুলাই আন্দোলনে সংঘটিত অপরাধের অভিযোগ আমলে নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ‘বিচার শুরু’ শিরোনামের লেখায় উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, ‘ইনশা আল্লাহ, ড. ইউনূস স্যার-এর সরকারের শাসনামলেই এই বিচারের রায় পেয়ে যাব আমরা।’ সরকারের নির্বাহী বিভাগের একজন উপদেষ্টা হয়ে বিচার বিভাগের মামলার রায় ও সময়কাল নিয়ে তাঁর এ দুটি মন্তব্যে সমালোচনার ঝড় ওঠে।

 

 

মনে রাখা প্রয়োজন, সরকার গঠনের দিন প্রধান উপদেষ্টাসহ প্রত্যেক উপদেষ্টা শপথ গ্রহণকালে পাঠ করেছেন, ‘আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব।’ (বাংলাদেশ সংবিধান, তৃতীয় তফসিল)।

 


অথচ ঈদ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে ভাষণ প্রদানকালে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বন্দরব্যবস্থার উদ্যোগে আপনাদের দৃঢ় সমর্থন অব্যাহত রাখুন। যারা বিরোধিতা করছে, তাদেরকে প্রতিহত করুন।’ শান্তিতে নোবেল বিজয়ী একজন সরকারপ্রধান যখন সমাজের ভীষণ নাজুক পরিস্থিতিতে জনগণের এক অংশ দ্বারা আরেক অংশের গণতান্ত্রিক চর্চাকে প্রতিহত করার এমন নির্দেশ দেন, তখন সে সমাজে বিভাজন সৃষ্টির বদলে পুনর্মিলন কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে, সে আশঙ্কা থেকেই যায়।

 

 

এটি সত্য যে জুলাই আন্দোলনের কারণেই পূর্ববর্তী সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। কিন্তু নানা সময়ে এর পুরো কৃতিত্ব গুটিকয়েক ছাত্রদের দেওয়া হয়েছে, যাদের নেতৃত্বে সম্প্রতি এনসিপি নামের একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। কিন্তু আমরা দেখেছি, বিভিন্ন মতাদর্শের ছাত্র, জনতা ও পেশাজীবীদের সম্মিলিত ফসলই হলো জুলাই অভ্যুত্থান। কিন্তু নানা সময়ে, এখনো অনিবন্ধিত এই রাজনৈতিক দলকে অন্য অনেক বড় রাজনৈতিক দলের চেয়ে অগ্রাধিকার দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে। অথচ উপদেষ্টারা কোনো নির্দিষ্ট দল বা মতাদর্শের সমর্থকদের সরকার নন। তাঁরা দেশের সব মানুষের সরকার।

 

 

সবকিছু বিবেচনায়, অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে যে বিভাজন তৈরি হয়েছে, সেগুলো সমাধানকল্পে রিকনসিলিয়েশন বা পুনর্মিলন প্রতিষ্ঠা করাই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ব্রত হওয়া দরকার। 

 

 

● উম্মে ওয়ারা সহযোগী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়