কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

জাতীয় নাগরিক পার্টির কাছে প্রত্যাশা

ড. আলী রেজা । সূত্র : সময়ের আলো, ৫ মার্চ ২০২৫

জাতীয় নাগরিক পার্টির কাছে প্রত্যাশা
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হলো। দলটির প্রতিষ্ঠা নিয়ে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছিল। এখনও চলছে। আলোচনার একটি প্রধান কারণ হলো দলটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের নেতাকর্মী ও ছাত্র-সমন্বয়করা। একটি বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে ছাত্ররা আন্দোলনে নেমেছিল। আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে ছাত্রদের সঙ্গে তাদের অভিভাবক ও সাধারণ মানুষ যুক্ত হওয়ার ফলে এবং রাজনৈতিক দলগুলো সমর্থন দেওয়ায় আন্দোলনে ঐতিহাসিক বিজয় অর্জিত হয়েছে। 
 
 


এ বিজয়কে ছাত্র-জনতার বিজয় বলে আখ্যায়িত করেছে দেশের সব রাজনৈতিক দল। অর্জিত বিজয়ের সুফল জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রবল আকাক্সক্ষা থেকে ছাত্ররা সংগঠিত থেকেছে। সংগঠিত থেকে জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনকে জনগণের চেতনায় বহমান রাখার জন্য ছাত্ররা জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠন করে। জাতীয় নাগরিক কমিটির সাংগঠনিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে তারা প্রথমে ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ’ গঠন করে। তারপর গঠিত করে রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’। ছাত্রদের নেতৃত্বে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার কথা জানা গিয়েছিল বেশ আগেই।
 


ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ও তাদের দোসরদের বিচার, রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার, জুলাই-আগস্ট শহিদদের ক্ষতিপূরণ ও আহতদের সুচিকিৎসার দাবিতে সোচ্চার ছাত্রসমাজ এমন একটি নতুন ব্যবস্থার দাবি করে আসছিল যার মাধ্যমে একটি বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ নির্মিত হবে। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কেমন হবে তা নিয়ে নতুন দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে দলের শীর্ষনেতারা যে বক্তব্য পেশ করেছেন তাতে জনমনে নতুন কিছু প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছে। তাদের সেøাগানগুলোতেও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ইঙ্গিত মেলে। 
 
 


নতুন দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম তার বক্তব্যে বলেছেন, একটি দলকে বিদায় করে আর একটি দলকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য জুলাই বিপ্লব হয়নি। ভারতপন্থি কিংবা পাকিস্তানপন্থি রাজনীতি নয়, বাংলাদেশপন্থি রাজনীতির কথা বলেছেন। তারা বিদেশি আধিপত্যবাদ মেনে নিতে চান না। এ বাংলাদেশপন্থি রাজনীতির কথা বলাটা একটি চমৎকার বিষয়। বাংলাদেশের দলীয় রাজনৈতিক ইতিহাসের গতি-প্রকৃতি থেকে জনগণের মনে এমন একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে যার ফলে তারা কোনো দলকে ভারতপন্থি মনে করে, কোনো দলকে পাকিস্তানপন্থি মনে করে, আবার কোনো দলকে চীন-রাশিয়া কিংবা আমেরিকাপন্থি মনে করে। নতুন দলের বাংলাদেশপন্থি বক্তব্যে জনমনে বদ্ধমূল এ ধারণাটি বদলে দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা আছে। তারা দৃঢ়ভাবে বলার চেষ্টা করেছেন যে, পরিবারতন্ত্রের বদলে রাজনৈতিক দলের পদপ্রাপ্তি নির্ধারিত হবে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে। 
 


নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে ভারত ও পাকিস্তানপন্থার বিলোপ ঘটাতে পারবে কি না, সেটি ভবিষ্যতে দেখার বিষয়। তবে তারা যে বাংলাদেশকে সামনে রেখে, বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থকে সামনে রেখে রাষ্ট্রকে বিনির্মাণ করতে চায় এই চিন্তা ইতিবাচক এবং সাধারণ মানুষ সেটিকে সমর্থন না করার কোনো কারণ নেই। রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে ২৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে ছাত্র-জনতার যে উচ্ছ্বাস দেখা গেছে তা নিকট অতীতে অন্য কোনো দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি। ফলে দলটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে বলে মনে করা যায়।
 
 
 
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতা ও রাজনীতি সচেতন মানুষ দীর্ঘদিন ধরে একটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছে। পেছনের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ হলেও পেছনের ইতিহাসকে পুঁজি করে রাজনৈতিক সুবিধা ভোগ করার অপসংস্কৃতি থেকে মানুষ বের হয়ে আসতে চেয়েছে। ফলে নতুন দলটি যখন বলে, আমরা সামনের কথা বলতে চাই। পেছনের ইতিহাস অতিক্রম করে সম্ভাবনার বাংলাদেশের কথা বলতে চাই-তখন সাধারণ মানুষ তো সে কথাকে স্বাগত জানাবেই। কারণ তারা ইতিহাসকে অস্বীকার করেনি, ইতিহাসকে অতিক্রম করার কথা বলেছে। অস্বীকার করা আর অতিক্রম করা এককথা নয়। মানুষ পরিবর্তন চেয়েছিল। কিন্তু বিকল্প চেয়েছিল কি? হয়তো চেয়েছিল। এ কারণে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে ‘তুমি কে আমি কে, বিকল্প বিকল্প’ স্লোগানটিও জনপ্রিয় হয়েছিল। এই বিকল্পের জায়গা থেকে নতুন দলটির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। বাংলাদেশের রাজনীতির দুয়ারে এই নতুন অতিথি এসে শপথ করে বলেছে, বাংলাদেশকে বিভাজিত করা যাবে না। 
 
 


বাংলাদেশ যে আদর্শিকভাবে বিভাজিত ছিল এবং আছে এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। তবে এই বিভাজনকে ঐক্যে পরিণত করা সহজ কাজ নয়। এটি করতে পারলে সেটিই হবে নতুন বাংলাদেশের বিনির্মাণ।
 
 
 
 
আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম দলটির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে কিছু তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি এই বঙ্গীয় বদ্বীপের হাজার বছরের সমৃদ্ধ ও স্বকীয় সংস্কৃতির কথা বলেছেন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের কথা বলেছেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের কথা বলেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ের কথা বলেছেন। ১৯৯০ সালের ছাত্র-জনতা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে স্বৈরাচারকে হটিয়েছে। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলেও দেশে গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়নি। শোষণ ও বৈষম্য থেকে এ দেশের গণমানুষের মুক্তি মেলেনি। নতুন দলকে এমন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করতে হবে যেখানে গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। শোষণ ও বৈষম্য থেকে গণমানুষের মুক্তি মিলবে। 
 
 
 
 
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও ছিল শোষণ ও বৈষম্য থেকে গণমানুষের মুক্তি কথা। কিন্তু পাঁচ দশকেও সে চেতনার বাস্তবায়ন হয়নি। বরং গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থে বেপরোয়াভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও অর্থপাচার, বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে একটি নিষ্ঠুর ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছিল। জুলাই-আগস্ট ২৪ এ ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দীর্ঘ দেড় দশক ধরে জেঁকে বসা ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটলে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা একটি নতুন বাংলাদেশ নির্মাণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের ওপর দাঁড়িয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি একটি গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক, মানবিক মর্যাদাভিত্তিক নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করবে বলে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে। নতুন দলকে সাধারণ মানুষের এ বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে হবে।
 
 


অস্বীকার করার উপায় নেই যে, গত দেড় দশকে দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো অগণতান্ত্রিক হয়ে উঠেছিল। এসব প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক চরিত্র ফিরিয়ে আনতে হবে। পুরোনো ও কায়েমি স্বার্থবাদী রাজনীতি দিয়ে নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। সবাই নতুনভাবে চিন্তা করলেই কেবল পুরোনো ব্যবস্থার পরিবর্তন সম্ভব। জাতীয় নাগরিক পার্টির চিন্তায় নতুনত্ব আছে। দেশের মানুষের সামনে তারা নতুন প্রত্যাশার দুয়ার উন্মুক্ত করেছে। ফলে তাদের পরবর্তী কার্যক্রমের ওপর দেশের মানুষের বিশেষ নজর থাকবে।
 
 
 

সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বিভেদের বদলে ঐক্য, প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার বদলে ন্যায়বিচার, মেধা ও যোগ্যতার মানদণ্ড প্রতিষ্ঠিত হোক-এটা সব মানুষের প্রত্যাশা। রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের নির্বিচার চর্চা গণতন্ত্র বিকাশের ক্ষেত্রে অনেক সময় প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পরিবারতন্ত্রের বিপক্ষে নতুন দলের অবস্থানকে সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ স্বাগত জানাতে পারে। কারণ বিগত দিনে পরিবারতন্ত্রের নির্বিচার চর্চার ফলে মেধা ও যোগ্যতার মানদণ্ড গুরুত্ব পায়নি। তবে মেধা ও যোগ্যতার মানদণ্ডে পরিবারতন্ত্রের যৌক্তিক চর্চা দোষের কিছু নয়। এ বিষয়ে নতুন দলকে তাদের যৌক্তিক অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে।
 


জাতীয় নাগরিক পার্টি সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় তুলে আনতে চায়। সাধারণ মানুষকে সব ক্ষমতার উৎস করতে চায় এবং সাধারণ মানুষের সব প্রকার গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা দিতে চায়। বিদ্যমান ব্যবস্থায় এসব কিছুই বলা আছে। কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এর কোনো প্রয়োগ ছিল না। জনগণ সব ক্ষমতার উৎস-একথা শুধু মুখে উচ্চারিত হয়। 
 
 
 
 
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, জনগণ রাষ্ট্রের সর্বনিম্ন পদস্থ আমলার সামনেও কত অসহায়। জনগণের অর্থে পরিচালিত রাষ্ট্রীয় সেবা গ্রহণের সময় সাধারণ মানুষকে ভিখারির সমতুল্য মনে হয়। নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি সাধারণ নাগরিকের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছে। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলেই কেবল সে অঙ্গীকার পূরণ করা সম্ভব। ভোটাধিকার নাগরিকের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার। এ অধিকারের মাধ্যমে একজন নাগরিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পায়। তবে অন্যান্য অধিকারও গুরুত্বপূর্ণ। বেঁচে থাকার অধিকার, ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার, নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার, নিরাপদ খাদ্য লাভের অধিকার, সুশিক্ষা ও সুচিকিৎসার অধিকার-এসব মিলেই নাগরিক অধিকার তথা মানবাধিকার। জাতীয় নাগরিক পার্টি নাগরিক অধিকার তথা মানবাধিকার রক্ষায় সর্বদা সচেষ্ট থাকবে-এটাই সর্বস্তরের মানুষের প্রত্যাশা।