জীববৈচিত্র্য সংকট ও সাম্প্রতিক গবেষণা
বিধান চন্দ্র দাস । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১৮ এপ্রিল ২০২৫

পৃথিবীব্যাপী জীববৈচিত্র্য এখন গভীর সংকটে। মূলত তা মানবসৃষ্ট কারণে। ইউরোপের চারটি দেশের ১৬ জন বিজ্ঞানীর লেখা এক প্রবন্ধে পৃথিবীর নানা স্থানে জীববৈচিত্র্য সংকটের জন্য মানুষের কর্মকাণ্ডকে দায়ী করা হয়েছে। প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে কয়েক দিন আগে, ২৬ মার্চ ২০২৫ তারিখে, পৃথিবীর অন্যতম প্রভাবশালী জার্নাল নেচারে।
এই প্রবন্ধে লেখকরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় এক লাখ আবাসস্থলের (স্থলভূমি, মিঠা পানি ও সমুদ্র) মধ্যে বসবাসকারী জীববৈচিত্র্যের ওপর পরিচালিত আনুমানিক দুই হাজার ১০০ গবেষণা কর্মের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছেন। এই বিশ্লেষণে তাঁরা দেখিয়েছেন যে মানুষের কর্মকাণ্ডপীড়িত জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থলগুলোতে মানুষের কর্মকাণ্ডশূন্য আবাসস্থলগুলোর তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ জীববৈচিত্র্য হ্রাস পেয়েছে। উল্লিখিত গবেষকরা জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থলগুলোতে মানুষের দ্বারা সংঘটিত কর্মকাণ্ডজনিত পাঁচটি অভিঘাত চিহ্নিত করেছেন। এই অভিঘাতগুলো হচ্ছে : আবাসস্থল পরিবর্তন, প্রত্যক্ষ আহরণ, জলবায়ু পরিবর্তন, আগ্রাসী প্রজাতির আক্রমণ এবং দূষণ।
গবেষকদের এই কাজকে যুগান্তকারী হিসেবে বর্ণনা করা যায় এই কারণে যে এত বেশি তথ্য ও উপাত্ত নিয়ে এই ধরনের কোনো গবেষণা এর আগে করা হয়নি।
এর আগে এই একই জার্নালে প্রকাশিত (নেচার, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫) একটি গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছিল যে মানুষের কর্মকাণ্ডজনিত অভিঘাতে প্রজাতির জেনেটিক বৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। জেনেটিক বৈচিত্র্য বলতে একটি প্রজাতির মধ্যে জিনের বা জিনগত গঠনের ভিন্নতা বোঝানো হয়ে থাকে। একই প্রজাতির জীবের মধ্যে যেসব পার্থক্য দেখা যায়; যেমন—মানুষের ক্ষেত্রে চেহারা, উচ্চতা, চোখের রং, শরীরের গঠন ইত্যাদির যে ভিন্নতা, তা মানুষের জেনেটিক বৈচিত্র্যের কারণে হয়ে থাকে।
এই বৈচিত্র্য জিনের মাধ্যমে এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয় এবং এটি প্রকৃতিতে জীবের বেঁচে থাকা ও তার পরিবর্তনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো প্রজাতির মধ্যে জেনেটিক বৈচিত্র্য নষ্ট হলে সেই প্রজাতিটির বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। গবেষকরা বলছেন যে মানুষের কর্মকাণ্ডজনিত অভিঘাতে বহু প্রজাতির জেনেটিক বৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে এবং এর ফলে তাদের বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
পৃথিবীর আরেকটি অন্যতম প্রভাবশালী জার্নাল সায়েন্সে (২৫ এপ্রিল ২০২৪) জীববৈচিত্র্যের হ্রাসমান বাস্তুতান্ত্রিক সেবাগুলো (ইকোসিস্টেম সার্ভিসেস) সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এই প্রবন্ধে ভূমি ব্যবহার ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিগত শতকে বাস্তুতান্ত্রিক সেবাগুলো কিভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে কিভাবে পরিবর্তিত হবে সে সম্পর্কে বলা হয়েছে।
বাস্তুতান্ত্রিক সেবা বলতে প্রকৃতি বা পরিবেশ থেকে উৎপন্ন বা প্রাপ্ত সুবিধাগুলোকে বোঝানো হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞরা এই সুবিধাগুলোকে সামগ্রিকভাবে প্রধান চারটি শিরোনামে ভাগ করেন। প্রতিটি ভাগেই রয়েছে অনেক ধরনের সেবা। ভাগ চারটি হচ্ছে : ১. বস্তুগত সেবা (প্রোভিশনিং সার্ভিসেস—শস্য, মাছ, কাঠ ইত্যাদি); ২. নিয়ামক সেবা (রেগুলেটিং সার্ভিসেস—কার্বন জমাকরণ, পরাগায়ণ, পানি বিশুদ্ধকরণ ইত্যাদি); ৩. সহায়ক সেবা (সাপোর্টিং সার্ভিসেস—মাটি গঠন, পুষ্টিচক্র, সালোকসংশ্লেষণ ইত্যাদি) এবং ৪. সাংস্কৃতিক সেবা (কালচারাল সার্ভিসেস—অরণ্য, নদী, সমুদ্র, পাহাড় ইত্যাদির নৈসর্গিক দৃশ্য)। উপরোক্ত প্রবন্ধে গবেষকরা মোট ৯ ধরনের সেবা (শস্য, পশুখাদ্য, পশুপালন, কাঠ, মৎস্য, পানি, কার্বন জমাকরণ, পরাগায়ণ, মাটির উর্বরতা) উল্লেখপূর্বক বলেছেন যে ১৯০০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে সেগুলো দুর্বল হয়েছে এবং আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন জমাকরণ, পরাগায়ণসহ বাস্তুতন্ত্রের উপরোক্ত ৯টি সেবা হ্রাস পাবে।
গত ২২ জানুয়ারি ২০২৫ আইবিপিএস (ইন্টারগভর্নমেন্টাল সায়েন্স-পলিসি প্ল্যাটফর্ম অন বায়োডাইভার্সিটি অ্যান্ড ইকোসিস্টেম সার্ভিসেস : আন্তর্জাতিক সংস্থা) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনের মূল বার্তা হচ্ছে, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি রোধ করার জন্য প্রযুক্তিগত সমাধানের চেয়ে আরো বেশি কিছু প্রয়োজন। প্রতিবেদন অনুযায়ী জীববৈচিত্র্য রক্ষায় মানুষের চিন্তা-ভাবনার বড় ধরনের গভীর পরিবর্তন দরকার। মূলত জীববৈচিত্র্য রক্ষা বিষয়ক নীতিনির্ধারকদের জন্যই এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এই প্রতিবেদন তৈরিতে প্রায় সাত হাজারেরও বেশি রেফারেন্স ব্যবহৃত হয়েছে এবং ৪২টি দেশের শতাধিক বিজ্ঞানী মিলে তৈরি করেছেন এই প্রতিবেদন। নামিবিয়ার রাজধানী উইন্ডহুকে অনুষ্ঠিত আইবিপিএসের ১১তম অধিবেশনে এই প্রতিবেদন অনুমোদিত হয়।
উল্লেখ্য, কয়েক বছর আগে ২০১৯ সালে আইবিপিএসের বৈশ্বিক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, মানুষের কার্যকলাপের কারণে প্রায় ১০ লাখ প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে এবং জীববৈচিত্র্য হ্রাসের হার ইতিহাসে এর আগে কখনো এত দ্রুত ছিল না। আইবিপিএস প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১২ সালে। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো জীববৈচিত্র্য এবং বাস্তুতান্ত্রিক সেবা সম্পর্কিত বিজ্ঞান ও নীতির মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করা, যাতে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, সুস্থায়ী ব্যবহার, মানবকল্যাণ এবং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়। আইবিপিএস বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীদের দিয়ে জীববৈচিত্র্যবিষয়ক সংকটগুলো চিহ্নিত করে এবং তা সমাধানের জন্য সুপারিশও তৈরি করে। সিবিডি (কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভার্সিটি) আইবিপিএস থেকে এগুলো নিয়ে তার সদস্য দেশগুলোর জন্য আইন/নিয়ম তৈরি করে। কাজেই সেই হিসেবে আইবিপিএসের সাম্প্রতিক (২২ জানুয়ারি ২০২৫) প্রতিবেদনটি প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রে জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
উপরোক্ত তিনটি গবেষণাপত্র এবং আইবিপিএসের প্রতিবেদনের সারমর্ম অনুযায়ী জীববৈচিত্র্য রক্ষায় করণীয় হচ্ছে—আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন, পরিবেশের ওপর মানবসৃষ্ট চাপ (আবাসস্থল নষ্ট, দূষণ) কমানো, জিনগত বৈচিত্র্য রক্ষায় আক্রান্ত প্রজাতি দ্রুত শনাক্তকরণপূর্বক তার সংরক্ষণ, জলবায়ুসহিষ্ণুতা সম্পর্কিত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ, সমন্বিত পদক্ষেপ, নিবিড় গবেষণা, জ্ঞান বিনিময়, সম্পদের ভাগ, গবেষণা লব্ধ তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ, কাজের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি।
বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্য রক্ষার চ্যালেঞ্জ বহুমাত্রিক। আবাসস্থল (অরণ্য, তৃণভূমি ও জলাশয়) ধ্বংস, জলবায়ু পরিবর্তন, অতি আহরণ, মাটি অবনয়ন, দূষণ, আগ্রাসী প্রজাতি, আর্থ-সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি ছাড়াও এখানে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাবও প্রকট। কিছু ব্যতিক্রম বাদে বাংলাদেশের সবাই জীববৈচিত্র্য বলতে বড় বড় বিভাময় চতুষ্পদ প্রাণী (স্তন্যপায়ী, পাখি, সরীসৃপ ও উভচর) আর বড় বড় বৃক্ষ বুঝে থাকে। জীবজগতের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ হচ্ছে অমেরুদণ্ডী প্রাণী প্রজাতি। বাংলাদেশে তাদের সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুবই দুর্বল। মাটিতে বসবাসকারী অণুজীবদের সম্পর্কেও আমাদের ধারণা পরিষ্কার নয়। অথচ অণুজীবদের বাদ দিয়ে মাটির উর্বরতা কল্পনাই করা যায় না। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাব অনুযায়ী এক টেবিল চামচ পরিমাণ মাটিতে প্রায় ৮০০ কোটি অতি ক্ষুদ্র জীব (অণুজীব ও অন্যান্য) বসবাস করে। বিশাল এই অণুজীবজগতের ওপর নির্ভরশীল অন্যান্য অসংখ্য জীব প্রজাতি। নির্ভরশীল মাটির স্বাস্থ্যও। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় জীবজগতের বিশাল অংশ অমেরুদণ্ডী প্রাণী ও অণুজীবদের বিবেচনায় নেওয়া হয় না। অর্থাৎ দৃষ্টিভঙ্গি সামগ্রিকভাবে ‘জীবকেন্দ্রিক’ (বায়োসেন্ট্রিক) নয়।
বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যকে রক্ষার জন্য উপরোক্ত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলাসহ দেশের সমগ্র জীব প্রজাতির নথিভুক্তকরণ, তাদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, তাদের আবাসস্থল তথা বাস্তুতন্ত্রের ওপর হুমকিগুলো চিহ্নিতকরণ এবং সেই মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। পৃথিবীর বহু দেশে এই কাজগুলো করার জন্য নির্দিষ্ট ও স্থায়ী প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
বাংলাদেশেও এ ধরনের স্থায়ী প্রতিষ্ঠান করা প্রয়োজন। দেশের জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করতে হলে জরুরিভাবে কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক (প্রশাসনিক বিভাগভিত্তিক) জীববৈচিত্র্য গবেষণা কেন্দ্র কিংবা ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম নামে প্রতিষ্ঠান করা দরকার। এগুলোর অভ্যন্তরে থাকবে জীববৈচিত্র্য তথা দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ সংক্রান্ত উন্নতমানের পৃথক গবেষণা ইউনিটগুলো। প্রতিটি কেন্দ্র (কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক) সংশ্লিষ্ট বিভাগ/অঞ্চলের সব জীববৈচিত্র্য তথা প্রাকৃতিক সম্পদ শনাক্তকরণ, ডেটাবেইস তৈরি, ভাউচার নমুনা রক্ষণাবেক্ষণ, পর্যবেক্ষণ ও অধ্যয়ন এবং প্রজাতিভিত্তিক সংরক্ষণের ব্যাপারে প্রতিনিয়ত কাজ করবে। জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কিংবা অন্য কোনো কারণে দেশের বিপদাপন্ন প্রজাতিদের সংরক্ষণে (প্রাকৃতিক পরিবেশে রেখে কিংবা সেখান থেকে বাইরে এনে) প্রতিটি কেন্দ্র কার্যকর ভূমিকা রাখবে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তথা দেশের সাধারণ মানুষের জীববৈচিত্র্য তথা প্রাকৃতিক সম্পদ সম্পর্কে শিক্ষা, ভালোবাসা ও সচেতনতা তৈরির জন্য প্রতিটি কেন্দ্রের বছরব্যাপী কর্মসূচি থাকবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়