জেলেনস্কিকে ট্রাম্পের অপমান ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ কী?
সাখাওয়াত হোসেন সুজন । সূত্র : দেশ রূপান্তর, ০৩ মার্চ ২০২৫

শুক্রবার থেকে ১০ মিনিটের একটি বাকযুদ্ধের দিকে নজর সবার। হোয়াইট হাউজের মতো জায়গায় বিশ্বের ক্ষমতাধর তথা মোড়ল রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রা¤প আর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির মুখে মুখে তর্ক। সেখানে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সেরও সরব উপস্থিতি ইংরেজি না জানা মানুষকেও উৎসাহিত করে। আর এমন বিষয় নিয়ে বড় বড় বিশেষজ্ঞ যেমন মত দিতে পারেন, তেমনি বাংলাদেশের মিনি পার্লামেন্ট চায়ের দোকানে এক কাপ ধুমায়িত চা হাতে নিতান্ত একজন সাধারণ বাঙালিও কড়া মন্তব্য করতে পারেন। বিশে^র বড় বড় রাষ্ট্রের বিষয়েও তারা বলতে পারেন, ‘তোমরা বাপু এসব থামাও। আমাদের শান্তি দাও।
’ শুক্রবার জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকের সময় ট্রাম্প এবং মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স জেলেনস্কিকে ‘অকৃতজ্ঞ’ বলতেও ছাড়েননি। ট্রাম্প জেলেনস্কিকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের উসকানিদাতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বলেছেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়া খেলছেন আপনি। এ নিয়ে উভয় পক্ষের বাগবিতণ্ডার পর জেলেনস্কি ও তার প্রতিনিধি দলকে হোয়াইট হাউজ থেকে বের করে দেওয়া হয়। যদিও ট্রাম্পের প্রেস সচিব ভদ্রভাষায় জানিয়েছেন, ‘তাদের চলে যেতে বলা হয়’। কিন্তু এর অর্থটা সবাই বুঝে।
শুক্রবারের সেই বৈঠক নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ব্রায়ান ফিনুকেন বলেন, ‘শুক্রবারের বৈঠকের পুরোটা সময়ই উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। ওভাল অফিসে প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্টের আচরণ ছিল অপ্রত্যাশিত। যদিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা নিয়ে যা ভাবেন এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের বিষয়ে তিনি যে বর্ণনা প্রচার করেন তা সবারই জানা। তাই তাদের আচরণে খুব বেশি অবাক হওয়ারও কিছু নেই।’ ট্রাম্পের আচরণ থেকে এমন ইঙ্গিতই পাওয়া যায় যে, ‘বন্ধু’ পুতিনের সমালোচনায় নারাজ ট্রাম্প। এসব বুঝতে পেরেই জেলেনস্কি এবং ওয়াশিংটনের ইউরোপীয় বন্ধুরা যেকোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ট্রাম্পের প্রতি অনুরোধ জানাতে শুরু করেন। কিন্তু ট্রাম্প যেন জেদ ধরেছেন, তিনি এমন কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারবেন না। তার এক কথা, পুতিন তাকে ‘খুবই সম্মান’ করেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জেলেনস্কিকে এমন অপমান দুঃখজনক হলেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। আজ না হোক কাল, এমন বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতোই। জানুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েই ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে কথা বলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর ফলে এটা সহজেই অনুমান করা সম্ভব হয় যে, ইউক্রেনকে পাশ কাটিয়ে কিছু করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্পের এমন পরিকল্পনা, ইউক্রেন-ইউরোপ কেউই মেনে নিতে পারেনি। এর ফলে ‘ন্যাটো’ দুর্বল হতে পারে। যদিও সেদিনের সেই ঘটনায় জেলেনস্কি চলে যাওয়ার পরই ট্রাম্প নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানিয়েছেন ‘শান্তি চাইলে সে ফিরে আসবে।’ ঠিক যেন জীবনানন্দ দাশের ‘আকাশলীনা’ কবিতার বিখ্যাত পঙ্্তি ‘ফিরে এসো সুরঞ্জনার’ সুরে।
অন্যদিকে জেলেনস্কি এক্সে নিজের প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, ‘ধন্যবাদ আমেরিকা, তোমাদের সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ। এই সফরের জন্য ধন্যবাদ। ধন্যবাদ কংগ্রেস এবং মার্কিন জনগণ। ইউক্রেনের ন্যায্য এবং স্থায়ী শান্তি দরকার। আমরা ঠিক সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি।’ বিশ্বনেতারাও এই ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এক্সে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো জানিয়েছেন, রাশিয়া অবৈধ এবং অন্যায্যভাবে ইউক্রেন আক্রমণ করেছে। তিন বছর ধরে ইউক্রেনীয়রা সাহসের সঙ্গে লড়াই করেছে। গণতন্ত্র, স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের জন্য তাদের লড়াই আমাদের সবার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কানাডা ন্যায়সংগত এবং স্থায়ী শান্তি অর্জনে ইউক্রেন এবং ইউক্রেনীয়দের পাশে থাকবে। জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ জানিয়েছেন, ‘ইউক্রেনের নাগরিকদের চেয়ে বেশি শান্তি আর কেউ চায় না! সেই কারণেই আমরা যৌথভাবে একটি স্থায়ী এবং ন্যায়সংগত শান্তির পথ খুঁজছি। ইউক্রেন জার্মানির ওপর এবং ইউরোপের ওপর নির্ভর করতে পারে।’ ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েলে মাখোঁ রাশিয়ার ভূমিকার সমালোচনা করে বলেছেন, রাশিয়া হলো আগ্রাসক।
ইউক্রেনের জনগণও দমবার পাত্র নন। তিন বছর আগে আমরা ইউক্রেনকে সাহায্য করেছিলাম, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলাম এবং সেই সমর্থন আমরা অব্যাহত রেখেছি। ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিও মেলোনি অবশ্য জানিয়েছেন, পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিটি বিভাজন আমাদের সবাইকে দুর্বল করে তোলে এবং কেউই সভ্যতার পতন দেখতে চায় না। একটি বিভাজন কারও উপকার করবে না। আজকের বড় চ্যালেঞ্জ ইউক্রেনকে রক্ষা করা। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় রাষ্ট্র এবং মিত্রদের মধ্যে একটি তাৎক্ষণিক শীর্ষ সম্মেলন প্রয়োজন। আগামী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ইতালি তার অংশীদারদের কাছে এই প্রস্তাবটি উপস্থাপন করতে চায়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্র জানিয়েছেন, কিয়ের স্টারমার ইউক্রেনের প্রতি তার সমর্থন বজায় রাখার বিষয়ে অটল আছেন। ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার ওপর ভিত্তি করে একটি স্থায়ী শান্তির পথ খুঁজে বের করার জন্য তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবেনিস বলেছেন, যত দিন সময় লাগে আমরা ইউক্রেনের পাশে থাকব।
এদিকে এ ঘটনার পর সবচেয়ে ফুরফুরে অবস্থায় আছে রাশিয়া। তারাও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বাগযুদ্ধের এ ঘটনা ব্যাপক মনে ধরেছে রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমানে দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের ডেপুটি চেয়ারম্যান দিমিত্রি মেদভেদেভের। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি লিখেছেন, ট্রাম্প ইউক্রেনের গালে কড়া করে একটা থাপ্পড় মেরেছেন। সে সঙ্গে জেলেনস্কিকে ‘কোকেনসেবী ভাঁড়’ ও ‘উদ্ধত শুয়োর’ বলে আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রথমবারের মতো, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কোকেনসেবী ভাঁড়ের মুখের ওপর সত্য কথা বলেছেন।
এই উদ্ধত শুয়োর শেষ পর্যন্ত ওভাল অফিসে একটি যথাযথ চপেটাঘাত পেয়েছে এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প ঠিক কথা বলেছেন, কিয়েভের সরকার তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়া খেলছে।’ এই ঘটনার পর ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে ঐতিহাসিক চুক্তি হওয়ার কথা ছিল সেটি বাতিল হয়ে যায়। ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মধ্যে বাগবিতণ্ডার পর প্রশ্ন উঠেছে, ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে। শোনা যাচ্ছে, ট্রাম্পের সঙ্গে জেলেনস্কির বাগবিতণ্ডার পর মার্কিন প্রশাসন হয়তো ইউক্রেনকে সামরিক সহযোগিতা কমিয়ে দেবে। যে যাই বলুক, এর ফলে নিশ্চিত হতে পারে, ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ জয়।
লেখক : সাংবাদিক