জেন জি ও বিশ্ব শ্রমবাজার ড. তৌহিদ হোসেন খান
জেনারেশন জেড বর্তমান বিশ্বে বহুল আলোচিত একটি শব্দ। মূলত ২০১০-এর শুরুর দিকে জন্ম নেওয়া শিশুরা এই প্রজন্মের অন্তর্ভুক্ত, যারা ‘জেনারেশন জি’ নামেও পরিচিত। বর্তমান বিশ্বের সমগ্র জনসংখ্যার প্রায় ২৬ শতাংশ এই প্রজন্মের অংশ। এরাই সমাজের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিকসহ সমস্ত জায়গায় নিজেদের চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পূর্ববর্তী প্রজন্মের স্থলাভিষিক্ত হওয়া শুরু করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে শ্রমবাজারের প্রবেশ স্তরসহ সমাজের সব স্তরে জেনারেশন জেড নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করবে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই প্রজন্মকে নিয়ে নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। কারণ তারাই বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতার কারিগর। তাই আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর জেনারেশন জেড সম্পর্কে সাধারণের জানার আগ্রহ, তাদের স্বতন্ত্র চিন্তাভাবনা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন বিষয় বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমিতে আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে।

মূলত প্রত্যেকটি প্রজন্মের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা তাদের অন্য প্রজন্ম থেকে পৃথক করে। এর কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় এ প্রজন্মের স্বতন্ত্র চিন্তাধারা, ঘনিষ্ঠ ও আবেগপ্রবণ সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে ভিন্নতা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্ক, পেশা নির্ধারণে পূর্ববর্তী প্রজন্মের অনুসরণ না করা, লেখাপড়া ও শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্য কিংবা আর্থিক লেনদেন ও সামাজিক সচেতনতার ক্ষেত্রে তারা প্রকৃত অর্থেই স্বতন্ত্র। এই প্রজন্মটি হাইপার কানেক্টেড কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে অনিশ্চিত একটা সমাজ কাঠামোতে বেড়ে ওঠায় তারা বাস্তবমুখী, সামাজিকভাবে যথেষ্ট সচেতন ও প্রযুক্তিনির্ভর। ফলে এ প্রজন্মটি একটি প্রভাবশালী ডিসকোর্স যেমন আমরা প্রায়শ বলে থাকি যে, বর্তমান প্রজন্ম রাজনীতিবিমুখ ও আত্মকেন্দ্রিক এই বিষয়টি মিথ্যা প্রমাণ করেছে। প্রকৃতপক্ষে তারা রাজনীতিবিমুখ নয় বরং সমাজের প্রতি তাদের দর্শন ভিন্ন। তারা ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী এবং রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণাও গতানুগতিক নয়। প্রায়ই তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবারভিত্তিক বা বংশপরম্পরায় চলে আসা নিয়মের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বরং রাজনীতির মাঠে সাধারণ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে সামাজিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে তারা। সমাজে সাধারণ মানুষের চাওয়া সম্পর্কে জানতে তারা অনলাইন মাধ্যমগুলোতে কাজ করে এবং জনগণ থেকে প্রাপ্ত মতামত অনুযায়ী কাজ করে।
পশ্চিমা বিশ্বে জেনারেশন জেড নিয়ে চর্চা অনেক আগে শুরু হয়েছে। আগামীর দিনগুলোতে সমাজের দায়িত্ব গ্রহণে শ্রমবাজারে এ প্রজন্মের ভূমিকা ও তাদের কাজ পছন্দ করণে বিশেষ মনোযোগ রয়েছে। এছাড়াও তাদের পেশাগত স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, পেশাগত উন্নয়ন এবং আরও অনেক বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তবে একটি টেকসই শ্রমবাজার নিশ্চিত করতে উন্নত ও উন্নয়নশীলসহ সব দেশে শ্রমবাজারের সঙ্গে যারা যুক্ত বিশেষত সরকার, নিয়োগকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রশিক্ষণ প্রদানকারী, নীতিনির্ধারক ও বাস্তবায়নকারী তাদের সবাইকে এ প্রজন্ম সম্পর্কে চিন্তা করেই যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সমীচীন হবে। শ্রমবাজারে জেনারেশন জেড পূর্ববর্তী জেনারেশনগুলো থেকে ভিন্ন। তারা কাজ পছন্দ করার ক্ষেত্রে বেতন, সুযোগ-সুবিধা, প্রতিষ্ঠানের সুনামের পাশাপাশি নৈতিক ব্যবসা অনুশীলন, টেকসই মনোভাব, সমাজের ওপর উক্ত প্রতিষ্ঠানের প্রভাব, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সবার অংশগ্রহণের সুযোগের মতো বিষয়গুলো খেয়াল করে। এ প্রজন্ম চাকরি পছন্দ করতে গিয়ে বর্ণভিত্তিক ন্যায়বিচার, লিঙ্গ সমতা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। তারা এমন চাকরিদাতা পছন্দ করে, যারা করপোরেট দায়িত্ব ও স্বচ্ছতার সঙ্গে আপস করে না। তারা যেকোনো ফ্লেক্সিবল কাজকে প্রাধান্য দেয় যাতে ব্যক্তিগত জীবন ও কর্মঘণ্টার মধ্যে ভারসাম্য ধরে রাখতে পারে। কভিড-১৯ কালে এ ধরনের কাজের ওপর এ প্রজন্মের অধিক গুরুত্বারোপ লক্ষ করা যায়। সে কারণেই ঐ সময়ের বহুসংখ্যক যুবক-যুবতী বিভিন্ন ধরনের কাজে যুক্ত হয়। যেমন রাইড শেয়ারিং, ফুড ডেলিভারি ইত্যাদি। এ প্রজন্মের অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, তারা সব সময় শিক্ষা গ্রহণের মধ্যে থাকতে পছন্দ করে এবং পেশাগত উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য তারা ইউটিউব, ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে। তারা প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে বিভিন্ন ক্ষেত্র যেমন আউটসোর্সিং, কনটেন্ট তৈরি, অনলাইন বেচাকেনার মতো বিষয়গুলোর ওপর দক্ষতা অর্জনের জন্য স্বল্প ব্যয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হয়। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণে তারা নিজেদের দক্ষ করতে চায় এবং সেজন্য তারা পেশাগত উন্নয়ন, পরামর্শ প্রদান এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করে এমন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত রাখে। এ প্রজন্মকে বলা হয় ‘বিশ্বশিশু’ যারা তাদের পেশাগত অর্জনকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আবদ্ধ না রেখে তাদের যোগ্যতা সমগ্র বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করে। তাই তারা নিজেদের সব ধরনের দক্ষতার সঙ্গে যুক্ত রাখতে চেষ্টা করে। একইভাবে, দূরবর্তী স্থানে কাজ করার সুযোগ তৈরি হওয়ায় জেনারেশন জেড-এর অনেকে একইসঙ্গে কয়েকটি স্থানে কাজ করে। আবার অনেকে বিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে অনলাইনের মাধ্যমে একাধিক পেশায় যুক্ত হচ্ছে। এই প্রবণতা ক্রমবর্ধমান আকারে জনপ্রিয় হচ্ছে, কারণ প্রযুক্তি দেশের গণ্ডির বাইরে বিরামহীন যোগাযোগ এবং সহযোগিতা করতে সক্ষম।
বিভিন্ন অর্থনৈতিক মন্দা এবং সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার পর জেনারেশন জেড-এর অনেকেই আর্থিক স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার দেয়। সমস্যার কথা বিবেচনা করে তারা প্রয়োজন মাফিক খরচ করতে পছন্দ করে এবং পূর্ববর্তী জেনারেশনের তুলনায় যথেষ্ট হিসাবি। তাছাড়া অবসর পরিকল্পনা, স্বাস্থ্য বীমা এবং প্রতিযোগিতামূলক বেতনের মতো সুবিধাগুলো তারা মনোযোগের সঙ্গে বিবেচনা করে। মজার বিষয় হলো, বেশ কয়েকটি গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী এটি প্রতীয়মান হয়েছে যে, তারা সবসময় চাকরি পরিবর্তন করতে প্রস্তুত থাকে যদি সেটি তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী সন্তোষজনক না হয়। জেনারেশন জেড-এর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তির উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা রয়েছে যদিও উদ্যোক্তা হওয়ার মনোভাব সমাজবিজ্ঞানী এবং রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদদের দ্বারা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকে নিজস্ব ব্যবসা তৈরি করতে, ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করতে বা খুব দ্রুত কোনো পেশায় যুক্ত হতে আগ্রহী। অন্যদিকে ইউটিউব, টিকটক এবং ই-কমার্সের মতো প্লাটফর্মের উত্থান তাদের জন্য অল্প বয়সে উদ্যোক্তা হওয়ার পথ সুগম করেছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে সফল তরুণদের অসংখ্য গল্প রয়েছে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের উপার্জনের চেয়ে অনেক বেশি উপার্জন করেন।
জেনারেশন জেড এখন পর্যন্ত জাতিগতভাবে সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় প্রজন্ম এবং তারা এই বৈচিত্র্যময়তা কর্মক্ষেত্রে প্রতিফলিত করতে চায়। তারা অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ চায় যেখানে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ একত্র হবে। সেক্ষেত্রে যে কোম্পানিগুলো কর্মক্ষেত্রে বৈচিত্র্য এবং অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয় তাদের জেনারেশন জেড-এর মধ্যে প্রতিভাবানদের আকৃষ্ট করতে এবং ধরে রাখতে বেগ পেতে হয়। জেনারেশন জেড-এর কাছে মানসিক স্বাস্থ্য অগ্রাধিকার পায়। তারা আশা করে যে, নিয়োগকর্তারা মানসিক সুস্থতাকে সমর্থন করবেন। তারা পূর্ববর্তী প্রজন্মগুলোর তুলনায় মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারে আরও বেশি সজাগ এবং সুস্থতাবিষয়ক প্রোগ্রাম, স্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শ গ্রহণের মতো বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। তবে অত্যন্ত স্বাধীন মনোভাব থাকা সত্ত্বেও এই প্রজন্ম ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের থেকে সহযোগিতা এবং নিয়মিত পরামর্শ ও ভুলের সংশোধনী পেতে প্রশংসা করে। কাজের ক্ষেত্রে তারা একটি টিম-এর অংশ হয়ে কাজ করতে চায় এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা পছন্দ করে। তারা এমন একটি প্রাতিষ্ঠানিক শ্রেণিবিন্যাস আশা করে, যেখানে স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করার সুযোগ রয়েছে।
সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে জেনারেশন জেড-এর ধারণা, আদর্শ কিংবা চাহিদার সঙ্গে পূর্ববর্তী জেনারেশনের ব্যবধান রয়েছে। অথচ অধিকাংশ জায়গায় পূর্ববর্তী জেনারেশনগুলো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে। এই ধরনের ব্যবধান মূলত নীতিনির্ধারক, শিক্ষাবিদ এবং নিয়োগকর্তাদের জেনারেশন জেড-এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করার ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করে। জেনারেশন জেড-এর অগ্রাধিকার সম্পর্কে সঠিক ধারণা এবং কোন বিষয়গুলো এই ধারণাকে গঠন করে সে সম্পর্কে শিক্ষক, নিয়োগকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর যথাযথ বোধগম্যতা জরুরি। এটি উচ্চশিক্ষার নেতৃত্বের বিষয়ে বুঝতে সাহায্য করে এবং একইভাবে তাদের কাজের ক্ষেত্রে আরও ভালোভাবে প্রস্তুত করে নিয়োগকারীদের জন্য জেনারেশন জেড-এর চাহিদার প্রতি পর্যাপ্ত মনোযোগ সৃষ্টি করতে পারলে, এই প্রজন্ম থেকে মানসম্মত প্রার্থীদের নিয়োগ এবং কাজের ক্ষেত্রে ধরে রাখা সুবিধাজনক হবে। বাংলাদেশে যেখানে বেসরকারি কাজের ব্যাপক প্রচলনের কারণে সরকারি চাকরির প্রথাগত পছন্দকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে, সেখানে জেনারেশন জেড-এর কাজের পছন্দ বোঝা শিক্ষক-প্রশিক্ষক, সরকারি সংস্থা এবং ব্যবসায়ীদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ , জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়