জেন-জিরা এখন কর্মযজ্ঞে
ছন্দা চক্রবর্ত্তী। সূত্র : কালবেলা, ২১ এপ্রিল ২০২৫

সৃষ্টি প্রক্রিয়া থেমে নেই, নিরন্তর চলছে এ মহাযজ্ঞ। সেই আদিম কাল থেকেই যুগ যুগ ধরে সারা বিশ্বে প্রতিমুহূর্তে জন্ম হচ্ছে সৃষ্টির সেরা জীব, মানব গোষ্ঠীর। প্রতিটি মানুষের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তাদের উপস্থিতি বিশ্বের বুকে নথিবদ্ধ হয়ে যায়। নথিবদ্ধ হয় জন্মের সময়, দিন, মাস বা সাল। জন্মের সময়টায় যে প্রকৃতি, পরিবেশ, সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যবিধি প্রচলিত থাকে; সেসবের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে একেকটা প্রজন্ম এবং সেই প্রজন্মের বৈশিষ্ট্য, স্বভাব, চরিত্র, চিন্তা, চেতনা ইত্যাদি।
ইদানীং জেন-জি নামক একটা প্রজন্মের কথা আমরা খুব বেশি করে শুনতে পাচ্ছি। জেন-জি মানে জেনারেশন জুমার্স, যাদের জন্ম ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে, যারা জুম ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা আয়ত্ত করে নিতে সক্ষম। যারা তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোত্তম সুবিধা নিতে জানে এবং সারা বিশ্বে এ প্রজন্ম অভাবনীয় কিছু সাফল্য করতে সমর্থ হয়েছে বলে মনে করা হয়। এ বহুল প্রচারিত প্রজন্ম জেন-জিদের আবির্ভাবকাল শেষ। ২০১২ সালের জন্ম নেওয়া শিশুটার বয়স এখন ১৩ বছর। এরই মধ্যে জেন-জির পরবর্তী প্রজন্ম ‘জেন-আলফা’ প্রজন্মের জন্মানোর সময়ও শেষ হয়ে গেল।
২০১৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত জন্ম নেওয়া শিশুদের ‘জেন-আলফা’ প্রজন্মের সদস্য হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এদের মা-বাবারা ‘জেনারেশন ওয়াই প্রজন্ম’ বা ‘মিলেনিয়াল প্রজন্মের’ সদস্য। এরা মাত্র বয়সের টিন ধাপে প্রবেশ করেছে। আলফা প্রজন্মকে নিয়ে অর্থাৎ তাদের বৈশিষ্ট্য, আচরণ, গতিবিধি বা স্বভাব চরিত্র ইত্যাদি সম্পর্কে এখনো তেমনভাবে গবেষণায় উঠে আসেনি। কেননা এরা এখনো কাজ করার যোগ্য বয়সে পৌঁছেনি। আলফা প্রজন্মের পরের প্রজন্ম, যারা ২০২৫ সাল থেকে জন্ম নেওয়া শুরু করেছে তাদের ‘জেন-বিটা’ প্রজন্ম বা বিটা জেনারেশন নামে অভিহিত করা হয়েছে। যেহেতু রোমান সংখ্যা আলফার পরে বিটা আসে, তাই ২০২৫ থেকে ২০৩৯ সাল পর্যন্ত জন্ম নেওয়া শিশুরা বিটা জেনারেশন নামেই পরিচিত হবে।
আলফা জেনারেশন ও বিটা জেনারেশনের সদস্যরা বেড়ে উঠবে তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধার মধ্য দিয়ে। তাদের লড়াই করতে হবে এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স)-এর সঙ্গে। ধারণা করা যায়, এ প্রজন্মের সদস্যদের শিক্ষাক্ষেত্র পরিচালিত হবে মূলত ‘এআই’ দ্বারা আর সেজন্যই তাদের সৃজনশীলতার অভাব দেখা দিতে পারে। বিটা প্রজন্মের শেষের দিকে যাদের জন্ম হবে তারা ২২ শতককে স্বাগত জানাতে পারবে।
সাধারণত ২০ থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত অর্থাৎ দুই যুগের মতো সময় ধরে একটি প্রজন্ম গড়ে ওঠে। এ হিসাব সাধারণত সময়ের জন্ম নেওয়া শিশুর ওপর প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, প্রযুক্তির ক্রমবিবর্তন, বিশ্বায়ন এবং সভ্যতার উন্নয়ন, পরিসংখ্যান ও তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের ওপর নির্ভর করেই একেকটি প্রজন্মের নামকরণ করা হয়। প্রকৃতপক্ষে এ নামকরণ প্রথা কোনো সরকারি কমিশন বা গোষ্ঠী সিদ্ধান্ত নেয় না। বরং বিভিন্ন নাম ও জন্মসাল হিসাব করে প্রস্তাব করা হয় এবং কিছুটা এলোমেলোভাবে মিডিয়া ও জনপ্রিয় কথাবার্তার মাধ্যমে ধীরে ধীরে ঐক্যমত গড়ে ওঠে। আসলে প্রজন্মের ওপর কোনো প্রভাবশালী ঘটনা অতিবাহিত হওয়ার পর বহুল জনপ্রিয়তার সংযোগের ফলে গঠিত হয়ে যায়। তাই এদের মান ও সময় এক দেশ থেকে অন্য দেশে পৃথকও হতে পারে।
সম্প্রতি মার্কিন সংবাদমাধ্যম ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে’ কর্মক্ষেত্রে জেন-জি প্রজন্মের সদস্যদের আচরণের ওপর একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে জেন-জি সদস্যরা সহকর্মী এবং বস হিসেবে তাদের কার্যধারা সম্পর্কিত অনেক জানা-অজানা তথ্য প্রকাশ পায়। একাধিক গবেষণায় প্রকাশ পাওয়া তথ্যমতে, জেন-জি সদস্যরা কর্মক্ষেত্রের প্রথাগত অনেক ধ্যান-ধারণাকে গুরুত্ব দেন না। তাদের মতে, কর্মজীবন ও ব্যক্তিগত জীবনের ভারসাম্যহীনতা, কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য চাহিদার প্রতি উদাসীন নিয়োগ কর্তারা তাদের হতাশ করেছেন। তবে ২০২৪ সালে এসে জেন-জির সদস্যরা ‘বস’ হতে শুরু করেছেন এবং তাদের সামনে কর্মক্ষেত্র নিজেদের পছন্দ ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বদলে দেওয়ার সুযোগ এসেছে।
জনকণ্ঠের অনলাইন প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এডিপি রিচার্স ইনস্টিটিউটের দেওয়া তথ্য হলো, জেন-জি প্রজন্মের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ ১৬.৮ শতাংশে পৌঁছেছে। অন্যান্য প্রজন্মের তুলনায় তাদের ক্যারিয়ার দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে জেন-জির সদস্যরা এক-দ্বিগুণ বেশি পদোন্নতি পেয়ে প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনায় জায়গা করে নিয়েছেন।
একটি জরিপে দেখা গেছে, জেন-জি প্রজন্মের সদস্যদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে অন্যান্য প্রজন্মের সদস্যরা বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। এক অনলাইন ডেটা বিশ্লেষকের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১ হাজার ৩৪৪ ম্যানেজারের মধ্যে ৭৪ শতাংশ মনে করেন যে, জেন-জিদের সঙ্গে কাজ করা তুলনামূলক বেশি ঝামেলাপূর্ণ। এ ছাড়া ৫৮ শতাংশ নিয়োগকর্তা বলেন, জেন-জিরা অফিসের পরিবেশের জন্য অনুপযুক্ত পোশাক পরেন, ৫৭ শতাংশ বলেন, তাদের চোখে চোখ রেখে কথা বলা কঠিন এবং ৪৮ শতাংশ বলেছেন, তারা তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যোগ্যতার চেয়ে বেশি বেতন দাবি করেন। তবে এ বিষয়গুলো যাদের জন্য দুর্বলতা মনে হয়, তাদের জন্য জেন-জিরা সেগুলোকে শক্তিশালী নেতৃত্বের ইঙ্গিত হিসেবে দেখেন। এক্সিকিউটিভ প্রশিক্ষকের মতে, জেন-জিরা কাজ করতে চান না, এমনটা নয়। তারা সবার সঙ্গেই একইরকম আগ্রহ ও উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করতে চান।
আমাদের বাংলাদেশের জেন-জিরা কী করছে একটু ভাবা যাক। বাংলাদেশের জেন-জিরা তো বিশ্ব থেকে একধাপ এগিয়ে, তারা যে হুজুগে বাঙালির বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। ইতিমধ্যে তারা জুলাই বিপ্লব ঘটিয়ে সরকার পতনের মতো কৃতিত্ব আয়ত্ত করে নিয়েছে। এ কঠিন ও অসম্ভব কাজে সফলতা আনা যদি জেন-জিদের নিজস্ব মেধা, পরিকল্পনা, আর্থিক বিনিয়োগ ও দক্ষতায় হয়ে থাকে তবে সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। সাধারণ জনগণ নতুন বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারে ইতিবাচক প্রচেষ্টায় সাফল্য পেলেই এই জেন-জিদের অবদান প্রশংসিত হবে বলে ধারণা করা যায়। বাংলাদেশের সহজ-সরল জনসাধারণ অনেক ঠকেছে, আর ঠকতে চায় না। তারা বিশ্বাস করতে চায়, যা হবে ভালোই হবে। নতুন বাংলাদেশ নতুন ভাবে এগিয়ে যাবে।
বিশ্বের জেন-জিদের মতো বাংলাদেশের জেন-জিরাও রাজনৈতিকসচেতন প্রজন্ম। তারা সাইলেন্ট প্রজন্ম, বেবি বুমার্স প্রজন্ম, অ্যানালগ প্রজন্ম, মিলিনিয়াল প্রজন্ম এবং এক্স প্রজন্ম থেকে অনেক বেশি পরিমাণে মেধামননে বুদ্ধিতে বা দক্ষতায় এগিয়ে থাকা প্রজন্ম। তারা এরই মধ্যে মেধাবী প্রজন্ম বলে পরিচিতি পেয়েছে। তারা আগেকার সব প্রজন্ম থেকে রাজনৈতিক সচেতন প্রজন্মও বটে, ইতিমধ্যে তারা রাজনৈতিক দলও গঠন করে ফেলেছে, এটাও ইতিবাচক দিক। তরুন প্রজন্মনির্ভর রাজনৈতিক দলের দুর্নীতিপরায়ণ দেশে ইতিবাচকতা রয়েছে। বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশের আইনশৃঙ্খলার উন্নতিকে বিশেষ নজরে রাখাও প্রয়োজন। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের সহজ-সরল গরিব-দুঃখী মানুষ, যারা বারবার ঘুরে দাঁড়ানো মানুষ, তারা বুক বেঁধে আছেন, হয়তো ভালো কিছু হবে।
বিশ্বের অন্যসব জেন-জির মতো আমাদের বাংলাদেশের জেন-জিরা দেশের অগ্রযাত্রায় সারথি হয়ে সংস্কারের মাধ্যমে সত্যিকারের দেশ গড়ার কাজে ব্রতী হবে, এ বিশ্বাসে বাংলাদেশের অন্য সব প্রজন্ম অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছেন জেন-জিদের আন্তরিক প্রচেষ্টার ওপর। জয় হোক জেন-জিদের কর্মতৎপরতার এবং কর্মক্ষমতা পূর্ণ কর্মযজ্ঞের।
সূত্র: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত, বিভিন্ন অনলাইন প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য সংযুক্ত করা হয়েছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ