কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

জিডিপির আকার ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিরঞ্জিত হতে পারে

ইয়াহইয়া নকিব । সূত্র : বণিক বার্তা, ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

জিডিপির আকার ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিরঞ্জিত হতে পারে

জিডিপির হিসাব অনেকটা জটিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখানে মূল্যস্ফীতির হিসাব আসবে। বিনিময় হারের হিসাব আসবে। মাথাপিছু আয় হিসাব করতে হবে। জনসংখ্যার হিসাবও আসবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, দেশের জিডিপির আকার ৪৫৯ বিলিয়ন ডলার। যদিও দেশী-বিদেশী বিভিন্ন নথিতে পাওয়া তথ্য এবং অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, বাংলাদেশের জিডিপির প্রকৃত আকার ৩০০ থেকে ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে হতে পারে। এলডিসি থেকে উত্তরণ ও উন্নয়নকে অতিরঞ্জিত করে দেখাতে গিয়ে বিগত সরকার দেশের জিডিপি পরিসংখ্যানকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়েছে। সরকারিভাবে এ তথ্যকে প্রকৃত পরিমাণের চেয়ে অন্তত ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়েছে, যাতে করে সরকার বিদেশ থেকে বেশি ঋণ নিতে পারে এবং জিডিপির তুলনায় ঋণের অনুপাত অনেক নিচে থাকে।

 

 


গত দেড় দশকের সরকারি পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অনেক। দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে সরকারের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারেননি দেশী-বিদেশী অর্থনীতিবিদ ও পর্যবেক্ষকরা। এ অবস্থায় দেশের জিডিপির প্রকৃত পরিমাণ জানতে অর্থনীতিবিদ, বেসরকারি সংস্থা ও পরিসংখ্যান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছে বণিক বার্তা। বাংলাদেশের জিডিপির আকার নিয়ে সরকারের দাবিকৃত ৪৫৯ বিলিয়ন ডলারের তথ্যটির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তাদের সবাই। দেশের অর্থনীতির প্রকৃত আকার নিয়ে তাদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে নানারকম অভিমত। তবে তা কোনোভাবেই ৩০০ থেকে ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি না বলে মনে করছেন তারা।

 

 


বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত সরকার জিডিপির আকার ও প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দেখালেও মূল্যস্ফীতি কমিয়ে দেখিয়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ এ পরিসংখ্যান ঠিক করতে একটি ডাটা কমিশন গঠনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল, যা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে সঠিক তথ্যের অভাবে চাহিদা ও বাজার নিয়ন্ত্রণসহ অর্থনীতির ব্যবস্থাপনাগত সব ক্ষেত্রেই বড় ধরনের ত্রুটি রয়ে গেছে। এ অবস্থায় বর্তমান প্রয়োজন অনুযায়ী জিডিপির প্রকৃত আকার নিরূপণে সরকারি পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য-উপাত্তের স্বচ্ছতা ও সঠিকতা নিশ্চিতেও আরো কঠোর অবস্থান নিতে হবে।

 

 

‘কান্ট্রি ইকোনমিক মেমোরেন্ডাম: চেঞ্জ অব ফ্যাব্রিক’ শিরোনামে ২০২২ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। এতে ১৩০টি দেশের ৩০ বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করা হয়। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশের গড় প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ বলা হলেও এর প্রকৃত হার ছিল ৪ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারি হিসাবে ১০ বছরে গড় প্রবৃদ্ধির হার বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে ২ দশমিক ৮ শতাংশীয় পয়েন্ট।

 

 

এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে ওই সময় বেশ চাপে পড়ে গিয়েছিল বহুজাতীয় সংস্থাটি। প্রতিবেদন তৈরির সংঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের তৎকালীন মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। এ বিষয়ে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গড়ে ২ দশমিক ৮ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে দেখানো হয়েছিল। ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের জিডিপিতে বাড়তি এ প্রবৃদ্ধি বাদ দিলে মূলত আকার দাঁড়ায় ৩২২ বিলিয়ন ডলারে। আসলে আমরা সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ ছিলাম না।’

 

 

জিডিপির হিসাব অনেকটা জটিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখানে মূল্যস্ফীতির হিসাব আসবে। বিনিময় হারের হিসাব আসবে। মাথাপিছু আয় হিসাব করতে হবে। জনসংখ্যার হিসাবও আসবে। কিন্তু সরকারের এসব পরিসংখ্যান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। আবার বিগত সময় প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দেখানোর পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি কমিয়ে দেখানোর কথা বলা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কতটা কমানো বা বাড়ানো হয়েছিল। এর হিসাব করাটা বেশ জটিল। আবার সরকারিভাবে হিসাব করা না হলে তা গ্রহণযোগ্যতাও পাবে না। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কাজ করে সরকারি পরিসংখ্যান নিয়ে। তাই জিডিপির প্রকৃত আকারের হিসাবটা সরকারকেই করতে হবে।’

 

 

জিডিপির প্রকৃত পরিমাণ বের হলে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোয়ও বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপির পরিমাণ যদি ৩৫০ বিলিয়ন ডলার হয়, তাহলে দেশের জিডিপির বিপরীতে বিদেশী ঋণের অনুপাত বেড়ে দাঁড়াবে ২৯ দশমিক ৬৫ শতাংশে, যা বর্তমান হিসাব অনুযায়ী ২২ দশমিক ৬ শতাংশ। আর মোট ঋণের ক্ষেত্রে এ অনুপাত ৩৬ দশমিক ৩০ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৪ দশমিক ৫৭ শতাংশে (২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে সরকারের দেশী-বিদেশী মোট ঋণ ছিল প্রায় ১৫৬ বিলিয়ন ডলার)। মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ আবার সরকারের হিসাব করা ২ হাজার ৬৭৫ ডলার থেকে কমে নেমে আসবে প্রায় ২ হাজার ৪০ ডলারে।

 

 

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, সমসাময়িক প্রতিযোগী অর্থনীতিগুলোর তুলনায় বিনিয়োগ, রফতানি, মানবসম্পদ উন্নয়ন, বিদেশী বিনিয়োগ ও ব্যবসার পরিবেশসহ বিভিন্ন সূচকেই পিছিয়ে বাংলাদেশ। দেশের অর্থনীতি যেভাবে প্রসারিত হওয়ার দাবি করা হয়েছে, তা সঠিক হলে এসব সূচকে এতটা পিছিয়ে থাকার কথা না বাংলাদেশের। এমনকি স্যাটেলাইট ইমেজের মাধ্যমে আলোকছটা বিশ্লেষণেও দেশের অর্থনীতির আকার প্রসারিত হওয়ার আলামত পাওয়া যায়নি।

 

 

জিডিপি প্রবৃদ্ধি নির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ্ধতি হলো ‘সিজি মডেল’। জটিল এ মডেলে গুটিকয়েক পারদর্শীর অন্যতম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. বজলুল হক খন্দকার। বিগত সরকারের সময়ে বিভিন্ন পরিসংখ্যান তৈরির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। দেশের জিডিপির আকার বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে বলে মনে করছেন তিনিও। তবে কতটা বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে তা নিরূপণের জন্য একটি খসড়া পরিসংখ্যান তৈরির চেষ্টা করেছেন তিনি। তবে কয়েকদিন কাজ করেও এ নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি তার নেতৃত্বাধীন বিশেষজ্ঞ দলটি।

 

 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিগত সরকার বছরে নমিনাল প্রবৃদ্ধি দেখাত ১৩-১৪ শতাংশ পর্যন্ত। কিন্তু ২০২৩-২৪ পর্যন্ত এটা হয়তো ১০-১১ শতাংশ হতে পারে। সে হিসাবে জিডিপির নমিনাল প্রবৃদ্ধি ৩-৪ শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি দেখানো হয়েছে। এটা হয় ২০১৩ সাল থেকে এভাবে দেখানো হতে পারে। সে হিসাবে ৪০ বিলিয়ন ডলারের মতো একটি গ্যাপ তৈরি হয়ে থাকতে পারে। এতে জিডিপির আকার ৪০০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসতে পারে। কেউ কেউ ৩০০ বিলিয়ন ডলার বলছেন। তবে আমার মনে হয় না তা এতটা কম।

 

 

অন্যদিকে সিটি ব্যাংক ক্যাপিটাল রিসোর্সেসের হিসাবে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রকৃত জিডিপির আকার ছিল প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার। ব্যাংকটির ‘‌ম্যাক্রো ইকোনমিক আউটলুক ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ অঞ্চলে বিদ্যুৎ ব্যবহারের বিপরীতে অর্থনৈতিক উৎপাদনের তুলনা করে জিডিপির এ হিসাব করা হয়েছে।

 

 

আওয়ামী লীগ আমলে বাংলাদেশ সরকার প্রকাশিত জিডিপি-সংক্রান্ত পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রতিষ্ঠানটি বলছে, প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহারের বিপরীতে বাংলাদেশ কীভাবে ভারত, পাকিস্তান বা চীনের চেয়ে ৫০-৬০ শতাংশ বেশি অর্থনৈতিক উৎপাদন দেখাতে পারে? বাংলাদেশের জিডিপির হিসাব নতুন করে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।

 

 

সিটি ব্যাংক ক্যাপিটালের ভাষ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে ঋণ-জিডিপির অনুপাত ৩৬ শতাংশের কিছু বেশি বলে যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, জিডিপির পরিমাণ নতুন করে হিসাব করা হলে তা ৫৫ শতাংশে পৌঁছাতে পারে (৩০০ বিলিয়ন ধরলে)।

 

 

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠনের পাশাপাশি দেশের আর্থিক খাতের অবস্থা নিরূপণের জন্য শ্বেতপত্র কমিটি গঠন করে। যেখানে দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদরা তিন মাস কাজ শেষ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। প্রতিবেদনেও বিগত সময় পরিসংখ্যান কারসাজির মাধ্যমে উন্নয়নের বয়ান তৈরির অভিযোগ আনা হয়। এতে বলা হয়, ২০১০-১৯ সাল পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দেখানো হলেও কীসের ভিত্তিতে এ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে তার কোনো ব্যাখ্যা ছিল না। এমনকি একটি মডেলে ২০১৩ সালের পর থেকে দেশের প্রবৃদ্ধি নামতে থাকলেও সরকারের ঘোষিত প্রবৃদ্ধির হার ছিল ঊর্ধ্বমুখী। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রবৃদ্ধির উপস্থাপিত তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার এমন ব্যবধান শুধু বাড়ছিল।

 

 

এ বিষয়ে শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মন্তব্য জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি দেশের বাইরে থাকায় তাৎক্ষণিকভাবে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে কমিটির গুরুত্বপূর্ণ আরেক সদস্য বণিক বার্তাকে বলেন, ‘হিসাব না করে এভাবে এটা বলা যাবে না। তবে জিডিপির আকার ৩০০-৩৫০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে থাকতে পারে। মাথাপিছু ১ হাজার ৯০০ ডলার হিসাব করলে এমনটাই হয়।’

 

 

জিডিপির প্রকৃত পরিমাণ নিরূপণ করতে হলে এখন তা বিবিএসকে দিয়েই করতে হবে বলে মনে করছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘গত ১০ বছর ধরে হয়তো প্রবৃদ্ধিটা বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। সেটা বাদ দিয়ে ১০ বছর আগের একটি বছরকে ভিত্তি ধরে হিসাব করা যায়। এখন আমরা প্রবৃদ্ধিটা ধরতে পারছি। তবে জিডিপির আকার জানতে হলে নতুন করে একটা খানাভিত্তিক আয়-ব্যয় জরিপ পরিচালনা করতে হবে। এটা বিবিএসকেই করতে হবে।’

 

 

বিগত সময়ে রফতানি তথ্যের মধ্যেও ছিল বাড়িয়ে দেখার প্রবণতা। এ বিষয়ে প্রশ্ন বাড়তে থাকায় অবশেষে গত বছর ইপিবির রফতানির তথ্য থেকে এক ধাক্কায় ১৩ দশমিক ৮০ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩৮০ কোটি ডলার বাদ দিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। একই ভাবে এনবিআর ও সিজিএর রাজস্ব আহরণের তথ্যে পার্থক্য দেখা দেয় ৯৭ হাজার ২৮০ কোটি টাকার বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের রাজস্ব আয় নিয়ে এমন গরমিল দেখা দেয়ায় প্রশ্ন ওঠায় হিসাব পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনে এনবিআর।

 

 

বিবিএস থেকে বুধবার প্রকাশিত অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪-এর তথ্যও বলছে, বিগত এক দশকে দেশে তেমন শিল্পায়ন ঘটেনি। সরকারের পক্ষ থেকে বিপুল বিনিয়োগ ও বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও এসবের সুফল মেলেনি অর্থনীতিতে। ২০০১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দেশে ১০০ শতাংশ শিল্পের প্রসার ঘটলেও গত ২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ বিগত এক দশকে শিল্পায়নের হারও থমকে ছিল।

 

 

তবে শিল্প খাত থমকে থাকলেও বিগত সময় থেকেই দেশের অর্থনীতিতে সেবা খাতের অবদান সবচে বড় করে দেখানো হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও জিডিপিতে সেবা খাতের অবদান দেখানো হয়েছে ৫২ দশমিক ৭২ শতাংশ। অর্থাৎ টাকার হিসাবে এ খাতের আকার প্রায় ২৫ লাখ কোটি টাকার বেশি। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করছেন, সেবা খাতের সঠিক আকার হিসাব করা কঠিন। এর সুযোগ নিয়ে খাতটিকে বড় করে দেখিয়ে জিডিপির আকার বড় দেখানো হয়েছে।

 

 

বাংলাদেশে জিডিপির আকার একটি রাজনৈতিক সংখ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করলেন খোদ পরিসংখ্যান বিভাগের সাবেক সচিব রীতি ইব্রাহীম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সরকার যেভাবে চায় বিবিএস সেভাবেই জিডিপির সংখ্যা নির্ধারণ করে থাকে। এটি মূলত সরকারের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। এখানে অর্থনীতির সঠিক চিত্র উঠে আসে না। এখানে মাথাপিছু আয় অনেক বেশি দেখানো হয়। কিন্তু খানা আয়-ব্যয় জরিপে আমরা দেখি মানুষের আয় অনেক কম।’

 

 

গত ২০১৪ সালে পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামাল দায়িত্ব নেয়ার পর পরিসংখ্যান বিভ্রাট প্রকট হতে থাকে। জিডিপি ও মূল্যস্ফীতিসহ সরকারি সব ধরনের পরিসংখ্যান তৈরি হয় অবিশ্বাস। বিগত সরকারের শেষ সময় পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত ছিল। তবে বানোয়াট এসব পরিসংখ্যানের পেছনের কারিকরদের বিগত সরকার নানাভাবে পুরস্কৃত করেছিল। বলা হয়, ডাটা কারসাজির সুবাদেই পরিকল্পনা থেকে অর্থমন্ত্রীর পদে যেতে পেরেছিলেন আ হ ম মুস্তফা কামাল।

 

 

সরকারি হিসাবে প্রায় এক দশক ধরে দেশের প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল ৭ শতাংশের ওপরে, যা ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, চীন ও ভারতসহ উন্নয়নশীল প্রায় সব দেশের প্রবৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে যায়। এর সুবাদে বাংলাদেশকে ‘এশিয়ান টাইগার’ খেতাবও দেয়া হয়। কিন্তু প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকলেও সে অনুপাতে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বাড়েনি। শিল্পের প্রসারও সেভাবে চোখে পড়েনি। আবার বিশ্বব্যাংক ও এডিবিরি মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের প্রবৃদ্ধি নিয়ে নানা সময়ে প্রশ্ন তুলেছিল। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যেই গড়ে সাড়ে ৩ শতাংশীয় পয়েন্টের বেশি প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছিল।

 

 

২০১৪ সালের পর থেকে বিবিএসের ডাটার মান নিয়েও প্রশ্ন বাড়তে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পরিসংখ্যানগত পারফরম্যান্স বিবেচনায় স্কোর প্রকাশ করে থাকে বিশ্বব্যাংক। ২৫টি সূচক বিবেচনায় এমন তালিকা তৈরি হয়। ২০১৪ সালে প্রকাশিত স্ট্যাটিস্টিক্যাল ক্যাপাসিটি ইন্ডিকেটরে বাংলাদেশের সার্বিক স্কোর ছিল একশর মধ্যে ৮০ আর পদ্ধতিগত স্কোর ৭০। কিন্তু এরপর থেকে দুটি স্কোরই ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। ২০১৮ সালে সার্বিক স্কোর দ্রুত হ্রাস পেয়ে ৬২-তে নেমে যায়। ২০২০ সালে নেমে আসে ৬০-এ, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার গড় স্কোর ছিল ৬৯। সে সময় মেথডোলজি বা পদ্ধতিগত সূচকে সবচেয়ে বড় পতনের মুখে পড়ে বাংলাদেশ। এ সূচকে ২০১৪ সালের ৭০ স্কোর থেকে ২০২০ সালে তা অর্ধেকের বেশি কমে ৩০-এ নেমে আসে।

 

 

সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিসংখ্যান কারসাজির বিষয়টি বড় আকারে সামনে আসে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকেও বানোয়াট পরিসংখ্যান তৈরির অভিযোগ তোলা হচ্ছে। খোদ প্রধান উপদেষ্টাও বিভিন্ন সময় দেশের অর্থনীতির আকার ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। আবার বিবিএস পরিচালিত ‘ব্যবহারকারী সন্তুষ্টি জরিপ-২০২৪’-এ বলা হয়, সংস্থাটির তথ্যকে নির্ভরযোগ্য মনে করেন না এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি ব্যবহারকারী। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি পরিসংখ্যান নিয়ে তাদের মধ্যে অবিশ্বাস সবচেয়ে বেশি। এরপরই ২৬ শতাংশ মানুষ ন্যাশনাল অ্যাকাউন্ট পরিসংখ্যান (যার মাধ্যমে জিডিপির হিসাব-নিকাশ করা হয়) নিয়ে সন্দিহান।

 

 

এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এরই মধ্যে জিডিপি বা অন্যান্য পরিসংখ্যান নিয়ে নানা জায়গা থেকে আলাপ হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তর বা পরিকল্পনা উপদেষ্টা ভালো বলতে পারবেন।’

 

 

তবে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য পরিকল্পনা উপদেষ্টার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

আর বিবিএসের মহাপরিচালক মিজানুর রহমান গত সপ্তাহে বণিক বার্তাকে বলেছিলেন, ‘জিডিপির হিসাব বা পরিসংখ্যানে ডাটা সংশোধনের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনা পাইনি আমরা। নির্দেশনা পেলে তখন বিবেচনা করা যাবে। তবে আমরা মূল্যস্ফীতি ও জিডিপি নিয়ে যারা কথা বলে, তাদের সঙ্গে বসছি। আমাদের পদ্ধতিগত বিষয়গুলো ওয়ার্কশপের মাধ্যমে জানাচ্ছি।’