কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

জিয়াউর রহমান : একটি অন্তর্ভেদী অবলোকন

নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ [সূত্র :যুগান্তর, ৩১ মে ২০২৫]

জিয়াউর রহমান : একটি অন্তর্ভেদী অবলোকন

মহাপুরুষ, মহানায়ক, মহামতি, যা কোনো ব্যক্তির নামের সঙ্গে যখন শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়, তা একান্ত ও অকৃত্রিমভাবে তার কর্ম, দেশ-জাতি-সমাজ ও সভ্যতার কল্যাণে তার অবদানের স্বতঃস্ফূর্ত স্বীকৃতি। দেশ-মাটি-মানুষের কল্যাণে আত্মনিবেদনের মধ্য দিয়ে একজন মানুষ তার জন্মের সার্থকতা লাভ করে, সভ্যতার ইতিহাসে নাম লেখায়, মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকে হাজার বছর, অনিঃশেষ মহাকাব্য হয়, কালোত্তীর্ণ অনুকরণীয়-অনুসরণীয় বাক্তিত্বে পরিণত হয়। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাদেরই একজন। স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়েই যার যাত্রা শুরু, পরে রাষ্ট্রনায়ক, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা। এই মহানায়ক বেঁচেছিলেন মাত্র ৪৫ বছর। কিন্তু কবি আব্দুল মান্নান সৈয়দের ভাষায় বলতে হয় ‘জীবনানন্দ দাশ পঞ্চান্ন বছর বেঁচে হেঁটেছিলেন হাজার বছর’। জিয়াউর রহমানের এই স্বল্পদৈর্ঘ্য কর্মমুখর জীবনের দিকে অন্তর্দৃষ্টি দিলে সেই অমোঘ সত্যটি প্রতিভাত হয়।

 

 

 

সুজলা-সুফলা এই ছোট্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে জনপ্রিয়। তার এই জনপ্রিয়তার কারণ নির্ভেজাল দেশপ্রেম, মাটি ও মানুষের জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা, দেশ-জাতির কল্যাণ ও উন্নয়নে ঐকান্তিক আত্মনিবেদন। এই ছোট্ট লেখনীতে তার কর্মময় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় আলোকপাত করা হলো।

 

 

১.

একটি জাতির উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে। স্বাধীনতার ইতিহাস জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়। ১৯৭১ সালে দেশ ও জাতি যখন চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিল, তাদের সামনে কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা ছিল না, তারা যখন অপেক্ষা করছিল কোনো মহানায়কের মহাবাণী শ্রবণের, যা তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করবে শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে, উদ্বেলিত করবে বিজয় ছিনিয়ে আনার দুর্মর প্রেরণায়, ঠিক এমনই এক প্রয়োজনীয় মুহূর্তে ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। এটা সর্বজনস্বীকৃত, সেদিনের সেই ঘোষণা সমগ্র জাতিকে শত্রুর বিরুদ্ধে রণসজ্জায় প্রস্তুত হওয়ার শপথে বাধ্য করেছিল। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে নাম লিখিয়েছিলেন। শুধু ঘোষণার মধ্যেই শেষ ছিল না তার কর্ম, সেদিন তিনি তার অধীনস্থ সেনাবাহিনীর সদস্যদের সংঘবদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।

 

 

সুদীর্ঘ নয় মাস মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি সৈনিক বেশে আবার ব্যারাকে ফিরে গিয়েছিলেন। এদিক দিয়ে শহীদ জিয়ার চরিত্র ছিল সাধারণ রাজনৈতিক নেতাদের থেকে ভিন্নতর। মাতৃভূমির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসায় তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, তার কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ বা ক্ষমতার মোহ ছিল না। এটা দ্বিধাহীন চিত্তে বলা যায়, পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি না হলেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মধ্য দিয়ে এদেশের মানুষের মুখে অনন্তকাল তার নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হতো।

 

 

২.

কী ছিল মুক্তিযুদ্ধের সেন্টিমেন্ট? কেন এদেশের মানুষ রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এদেশকে স্বাধীন করেছিল? আমাদের সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে এর উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র হবে গণতান্ত্রিক। যেখানে সব মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে, মানবসত্তার মর্যাদা-মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হবে। অর্থাৎ ১৯৭১ সালে এদেশের জনগণ শোষণহীন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমের জন্য যুদ্ধ করেছিল, যেখানে সামাজিক, রাজনৈতিক, ক্ষুধামুক্ত, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারসহ সব মানবিক অধিকার নিশ্চিত হবে; বঞ্চনামুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে; জীবনের সব নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী তদানীন্তন আওয়ামী সরকার মুক্তিযুদ্ধের এই মহান উদ্দেশ্যকে ভূলুণ্ঠিত করেছিল। বিশেষ করে, চতুর্থ সংশোধনী পাশের পর মুক্তিযুদ্ধের এই মহান উদ্দেশ্য ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল।

 

 

এর মাধ্যমে গণতন্ত্রকে হত্যা করে একদলীয় বাকশাল বাবস্থা চালু করা হয়, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্বসহ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয়। এরই ক্রমধারায় ’৭৫-এর রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে। ’৭৫-এর রাজনৈতিক পরিবর্তনের কিছুকাল পরে আবার ’৭১-এর মতো সময়ের দাবি পূরণার্থে এদেশের লাখো-কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রেক্ষাপটে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেন। জিয়াউর রহমান তার ৫ বছরের ক্ষমতাকালে আমার দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় যে কাজটি করেছিলেন, তা হলো গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার। অর্থাৎ বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তনের মাধ্যমেই তিনি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল মন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। কারণ, একটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ছাড়া কোনোক্রমেই মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। যদিও সামরিক শাসক হিসাবে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেছিলেন; কিন্তু তার মধ্যে সর্বদাই গণতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হওয়ার একটি প্রবণতা ছিল। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা তথা সব দল ও মতাদর্শের অনুসারীদের রাজনীতি করার অধিকার দেওয়ার পেছনে জিয়াউর রহমানের উদ্দেশ্য ছিল-জনগণই বেছে নেবে তারা কোনদিকে যাবে, জনগণই তাদের নেতা নির্ধারণ করবে। কারণ, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। বর্তমান আধুনিক বিশ্বের উন্নয়নের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। এখানে কোনো বিশেষ দল ও গোত্রের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার সুযোগ নেই। জনগণই তাদের নিজস্ব ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করবে। এই অমোঘ সত্যটি জিয়াউর রহমান উপলব্ধি করেছিলেন।

 

 

৩.

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবর্তন করেন। ইতঃপূর্বে ১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতির মধ্যে জাতীয়তাবাদ বলতে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বোঝানো হতো। তার শাসনামলে সংবিধানে এক সংশোধনীর মাধামে জাতীয়তাবাদের ব্যাখ্যায় ‘বাংলাদেশি’ শব্দকে সংযোজন করা হয়। শহীদ জিয়াউর রহমানের দৃষ্টিতে জাতীয়তাবাদ তথা আমাদের জাতীয়তা, জাতীয় পরিচয় ও সত্তা হলো বাংলাদেশকেন্দ্রিক। আমাদের পরিচয়, ঐতিহ্য-ইতিহাস এদেশের মাটি-মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত, হাজার বছরের পুরোনো। এই পরিচয়ের মধ্যে একটি ভৌগোলিক অখণ্ডতা, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার বৈশিষ্ট্য নিহিত, যা জাতি হিসাবে আমরা ‘বাঙালি’, এই পরিচয় অনুপস্থিত। ‘বাঙালি’ পরিচয় আমাদের সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক অবস্থান, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব নির্দেশ করে না। এছাড়া ‘বাংলাদেশি’ পরিচয়ের মধ্যে ধর্ম-ভাষা-বর্ণতিত্তিক সব জাতির সংমিশ্রণ বর্তমান। ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ আমাদের সুদৃঢ় ঐক্যের সবচেয়ে বড় ভিত্তি। আর জাতীয় ঐক্য ছাড়া কোনো উন্নয়নই সম্ভব নয়। এ সত্যকে উপলব্ধি করেই শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জাতীয় ঐক্যের চাবিকাঠি ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ প্রবর্তন করেন। ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ আমাদের নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তা ‘বাঙালি’-এর বিরোধী নয়। আর বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ মানে এই নয় যে, আমরা বাঙালি হিসাবে আমাদের যে হাজার বছরের সংস্কৃতি, তার বিপক্ষে অবস্থান। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের দিকে দৃষ্টি দিলে আমাদের কাছে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। যেমন: আমেরিকায় বহু নৃতাত্ত্বিক জাতির বাস; কিন্তু তাদের জাতীয়তা আমেরিকান। বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তালুকদার মনিরুজ্জামানের ভাষায় : জিয়াউর রহমান সকল প্রকার আধিপত্যবাদবিরোধী এবং সার্বভৌম বাংলাদেশের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের অবতারণা করেন, যা একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। জিয়াউর রহমানের মতে, আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি সবকিছুর ভিত্তি হবে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ।

 

 

৪.

১৯৭২ সালের সংবিধানে চার মূলনীতির একটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। ১৯৭৭ সালের এক ঘোষণার মাধ্যমে সংবিধানে সংশোধনী এনে ‘আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস হবে সকল কাজের ভিত্তি’-এ প্রত্যয়টি সংশোধিত হয়। ধর্মনিরপেক্ষতা নীতিটি তদানীন্তন আধিপত্যবাদী ভারতের অনুপ্রেরণায় চার মৌলনীতিতে স্থান পেয়েছিল। কেউ কেউ ধর্মনিরপেক্ষতাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হিসাবে দাঁড় করানোর অপপ্রয়াস চালান। মূলত ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনানির্ভর হয়ে কেউই মুক্তিযুদ্ধ করেনি। মুক্তিযুদ্ধের পেছনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনই সক্রিয় অবদান রেখেছিল। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আনীত সাংবিধানিক সংশোধনী ‘আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা’ প্রত্যয়টি কোনো জাতির ধর্মীয় চেতনার বিরোধী নয়, বরং এর মধ্যে একটি সর্বময়তা বিদ্যমান। এ প্রত্যয়ের নিগূঢ় ও তাত্ত্বিক অর্থ সব কাজে-কর্মে আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস আমাদের প্রেরণা জোগাবে। এটাই সব ধর্মের মৌল বাণী।

 

 

৫.

জিয়াউর রহমান ছিলেন কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী। কথায় ও কাজে তার ছিল অপূর্ব মিল। তিনি যা বলতেন, তা বিশ্বাস করতেন। তিনি যখন রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন, তখন বংলাদেশের পথে-প্রান্তরে, গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-নগরে ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং সর্বস্তরের পেশাজীবী-শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে দেশের উন্নয়নের কর্মপন্থা নিয়ে মতবিনিময় করেছেন। সবাইকে তিনি একটি কথাই বলতেন-কাজ, কাজ আর কাজ। তিনি মনে করতেন, কৃষিনির্ভর এই বাংলাদেশের উন্নয়নের মূল ভিত্তি হলো গ্রাম, গ্রামের আর্থসামাজিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটলে বাংলাদেশ উন্নত হবে। এ লক্ষ্যে তিনি গ্রামসরকার ব্যবস্থা, সবুজ বিপ্লব, খাল খনন ইত্যাদি কার্যক্রম গ্রহণ করেন। তিনি বেশি বড়, লম্বা-চওড়া বক্তৃতা পছন্দ করতেন না।

 

 

৬.

শহীদ জিয়াউর রহমান বিশ্বাস করতেন, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ব্যতীত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সম্ভব নয়। তাই তিনি সর্বদা উৎপাদনের রাজনীতির কথা বলতেন। এর অর্থ হলো, রাজনীতির লক্ষ্য হবে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করা, শিল্পায়নে অগ্রসর করা, ক্ষুধাবঞ্চিত, শোষণ ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা কর। এ লক্ষ্য অর্জনে তিনি বেশকিছু অর্থনৈতিক সংস্কারের কাজ হাতে নিয়েছিলেন। তন্মধ্যে সবুজ বিপ্লব, খাল খনন ও শিল্প-কলকারখানা বিরাষ্ট্রীয়করণ অন্যতম। বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। কৃষিক্ষেত্রে অধিকতর উন্নয়নের মাধমে একটি স্বনির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি ‘সবুজ বিপ্লব’ কার্যক্রম গ্রহণ করেছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের আওয়ামী সরকার সব শিল্প-কলকারখানাকে রাষ্ট্রীয়করণ করে। এর ফলে শিল্প খাত ব্যাপক দুর্নীতি ও ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এ অবস্থা থেকে শিল্প খাতকে বাঁচানোর লক্ষ্যে তিনি বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতি গ্রহণ করেন।

 

 

৭.

নারীর ক্ষমতায়ন আজকের বাংলাদেশে একটি অগ্রগণ্য অলোচ্য বিষয় এবং সরকারও এ বিষয়ে তৎপর। নারীর ক্ষমতায়ন ছাড়া নারীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। নারীর ক্ষমতায়ন ব্যতিরেকে নারী রাষ্ট্র ও সমাজের সার্বিক উন্নয়নে যথাযথ ভূমিকা রাখতে অসমর্থ। এ সত্যটি উপলব্ধি করে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানই প্রথম মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন। নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী বা স্বনির্ভর না হলে নারীর ক্ষমতায়ন সঠিকভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বিধায় তিনি নারীদের পুরুষের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে যোগদানের ব্যবস্থা করেন। বিভিন্ন চাকরিতে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন। পারিবারিক পর্যায়ে হাঁস-মুরগির খামার প্রতিষ্ঠার জন্য ঋণব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার ব্যবস্থা করেন।

 

 

৮.

সাংস্কৃতিক উন্নতির মাধ্যমে একটি জাতি সভ্যতার দিকে অগ্রসর হয়। সংস্কৃত জাতিমাত্রই সভ্য। একটি জাতি কতটুকু সভ্য, তা তাদের সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে পরিস্ফুটিত হয়। প্রতিটি দেশ ও জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। সাংস্কৃতিক প্রাতিষ্ঠানিকতাই একটি জাতির স্বতন্ত্র আত্মপরিচয় তুলে ধরে। শহীদ জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ হবে সংস্কৃতির মূল ভিত্তি অর্থাৎ এদেশের মানুষের হাজার বছরের লালিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধরে রাখা ও সুষ্ঠুভাবে চর্চার মাধ্যমে এর উত্তরণের উন্নয়ন হবে আমাদের কাজ। তার মতে, সংস্কৃতি হবে দেশীয়, যার মধ্যে অনুকরণবৃত্তি থাকবে না, যার মধ্যে থাকবে আবহমানকালের ঐতিহ্যের স্পর্শ। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি ‘জাসাস’ বা জাতীয়তাবাদী সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।

 

 

৯.

আধুনিক বিশ্বে ‘উন্নয়নের ধারণা’ একটি ব্যাপকভিত্তিক মাত্রা লাভ করেছে। শুধু ‘অর্থনৈতিক উন্নতি’ তথা মাথাপিছু আয়ের মধ্যে উন্নয়নের সংজ্ঞা সীমিত নেই। বর্তমানে উন্নয়ন বলতে ‘টেকসই উন্নয়ন’কে বোঝায়, যা সব ক্ষেত্রে উন্নয়নকে অন্তর্ভুক্ত করে। মানবসম্পদের উন্নয়ন টেকসই উন্নয়নের অন্যতম উপাদান। দক্ষ ও যোগ্য মানবগোষ্ঠী জাতীয় উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলদেশের যুবসমাজকে দক্ষ-যোগ্য ও আত্মনির্ভরশীল গোষ্ঠীতে পরিণত করার লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি যুব মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে এর আওতায় বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করেন। যুবকরা যাতে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে সে লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি এর আওতাভুক্ত করেন। শিশুর মেধা ও মননের যথোপযুক্ত বিকাশ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি শিশু একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। শিশুদের আগামী দিনের দেশের সংস্কৃতিমান সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তোলাই ছিল এর লক্ষ্য।

 

 

শেষ কথা

একজন রাষ্ট্রপতি হিসাবে জিয়াউর রহমানের কর্মময় জীবনকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তার মধ্যে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রনায়কের বৈশিষ্ট্যের অপূর্ব সম্মিলন ছিল। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তার মধ্যে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক মানসিকতা সক্রিয় ছিল, যা আজকের বিশ্বে সত্যই বিরল। এদেশের মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধের শ্রতি শ্রদ্ধা রেখে তিনি একটি গণতন্ত্রকামী কল্যাণমুখী সুশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমৃত্যু প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। আজকের বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা তার নীতি-আদর্শ অনুসরণ করলে সত্যিকার অর্থে একটি সুখী-সমৃদ্ধ-স্বনির্ভর-শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম হবে।


নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ : উপাচার্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া