জলবায়ু পরিবর্তন এক বৈশ্বিক বাস্তবতা
কর্নেল আবু মোহাম্মদ সিদ্দিক আলম [প্রকাশ: যুগান্তর, ২২ জুন ২০২৫]

বর্তমানে পৃথিবী এক অভূতপূর্ব সংকটের মুখোমুখি-জলবায়ু পরিবর্তন। এ পরিবর্তন কেবল প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যকেই বিঘ্নিত করছে না, বরং মানবসভ্যতার সবচেয়ে মৌলিক চাহিদা খাদ্যনিরাপত্তার ওপরও মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। কৃষিব্যবস্থা, যা আবহাওয়া ও জলবায়ুর ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসাবে এ পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব সরাসরি অনুভব করছে। এ প্রবন্ধে জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে কৃষির ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করছে, এর বর্তমান প্রভাব, ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ এবং এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় অভিযোজন ও প্রশমন কৌশলগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে।
বৈশ্বিক বাস্তবতা
জলবায়ু পরিবর্তন বলতে পৃথিবীর দীর্ঘমেয়াদি গড় তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহ এবং অন্যান্য জলবায়ুগত প্যাটার্নের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনকে বোঝায়। শিল্পবিপ্লবের পর থেকে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যাপক ব্যবহার, বনায়ন হ্রাস এবং অন্যান্য মানবসৃষ্ট কার্যকলাপ বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের (যেমন কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন) ঘনত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে, যা পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। আন্তর্জাতিক প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (IPCC) রিপোর্ট অনুযায়ী, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা শিল্পপূর্ব সময়ের তুলনায় ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ২১০০ সাল নাগাদ ১.৮ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে। এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া যেমন-বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, আকস্মিক বন্যা এবং তাপপ্রবাহের মতো ঘটনাগুলো আরও ঘন ঘন ও তীব্র হচ্ছে।
কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাব
কৃষিব্যবস্থা সরাসরি প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় এটি জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা খাতগুলোর অন্যতম। বাংলাদেশের কৃষি জলবায়ু পরিবর্তনের বহুমুখী প্রভাবের সম্মুখীন হচ্ছে।
১. তাপমাত্রা বৃদ্ধি : ফসলের বৃদ্ধি এবং ফলনের জন্য একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার পরিসর প্রয়োজন। অতিরিক্ত তাপমাত্রা বিশেষ করে ধানের মতো প্রধান ফসলের পরাগায়ণকে বাধাগ্রস্ত করে, যা ফলন হ্রাস করে। খুলনা অঞ্চলের মতো উষ্ণ এলাকাগুলোতে গড় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাচ্ছে, যা ধান উৎপাদন ৮ শতাংশ এবং গমের উৎপাদন ৩২ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে বলে সম্প্রতি এক সেমিনারে উল্লেখ করা হয়েছে। অতিরিক্ত তাপপ্রবাহ গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির স্বাস্থ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তাদের উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দেয়।
২. বৃষ্টিপাতের ধরনে পরিবর্তন : জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের অনিয়মিত এবং চরম ধরন দেখা যাচ্ছে। কিছু এলাকায় দীর্ঘস্থায়ী খরা দেখা দিচ্ছে, যেখানে বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে বা দেরিতে হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩০ থেকে ৪০ লাখ হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রার খরায় আক্রান্ত হয়, বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে খরার তীব্রতা বাড়ছে। অন্যদিকে, কিছু এলাকায় অতিবৃষ্টি এবং আকস্মিক বন্যা দেখা দিচ্ছে, যা ফসল ডুবিয়ে দেয় এবং এর ব্যাপক ক্ষতি করে। এ অপ্রত্যাশিত বৃষ্টিপাত কৃষকের জন্য ফসল পরিকল্পনা এবং বীজ বপনের সময় নির্ধারণে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
৩. লবণাক্ততা : দেশের উপকূলীয় অঞ্চল, বিশেষ করে খুলনা বিভাগের মতো অঞ্চলগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। লবণাক্ত জলের অনুপ্রবেশ ভূগর্ভস্থ জল এবং কৃষিজমিতে ছড়িয়ে পড়ছে, যা ফসলের উৎপাদন ক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে হ্রাস করছে। বর্তমানে উপকূলের প্রায় ৪ লাখ হেক্টর জমি জলমগ্নতা ও লবণাক্ততার শিকার, যেখানে শস্যের নিবিড়তা দেশের গড় ২০০ শতাংশের তুলনায় মাত্র ১৩৩ শতাংশ। লবণাক্ততা-সহনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করা হলেও লবণাক্ততার মাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এটি কৃষকের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৪. ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস : বাংলাদেশ ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের শিকার হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আরও তীব্র হচ্ছে। সিডর, আইলা, ফণি, আম্ফান, সিত্রাংয়ের মতো ঘূর্ণিঝড়গুলো উপকূলীয় কৃষিজমিতে লবণাক্ত জলের প্রবেশ ঘটিয়ে, অবকাঠামো ধ্বংস করে জীবন-জীবিকার ব্যাপক ক্ষতি করে। এ প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি উভয় প্রকারেই কৃষিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
৫. কীটপতঙ্গ ও রোগের বিস্তার : তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার পরিবর্তন বিভিন্ন নতুন কীটপতঙ্গ এবং ফসলের রোগের বিস্তারে সহায়ক। উষ্ণ আবহাওয়া কীটপতঙ্গের বিপাকীয় হার এবং প্রজননচক্র বাড়িয়ে দিতে পারে, যা ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে। এর ফলে কৃষকের কীটনাশক ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে, যা পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি করছে।
৬. মাটির উর্বরতা হ্রাস : খরা, বন্যা ও লবণাক্ততার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো মাটির গঠন ও উর্বরতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। মাটির পুষ্টি উপাদানের ভারসাম্যহীনতা এবং জৈব পদার্থের হ্রাস ফসলের ফলন কমিয়ে দেয়।
৭. খাদ্যশস্যের পুষ্টিগুণ হ্রাস : গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব বৃদ্ধি কিছু ফসলের পুষ্টিগুণ কমিয়ে দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, গমে প্রোটিন ও খনিজ পদার্থ কম তৈরি হতে পারে। খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে প্রোটিন, আয়রন ও জিঙ্কের পরিমাণ ৩ থেকে ১৭ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে খাদ্যনিরাপত্তা এবং জনস্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অভিযোজন ও প্রশমন কৌশল
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব না হলেও এর ক্ষতিকর প্রভাবগুলো হ্রাস করতে এবং কৃষিকে জলবায়ু সহনশীল করে তুলতে বিভিন্ন অভিযোজন (Adaptation) ও প্রশমন (Mitigation) কৌশল গ্রহণ করা অপরিহার্য। অভিযোজন কৌশলগুলো কৃষককে জলবায়ু পরিবর্তনের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করে।
১. জলবায়ু সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ : এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিযোজন কৌশলগুলোর একটি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং অন্যান্য কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে খরা, লবণাক্ততা, বন্যা ও তাপ সহনশীল বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন করেছে। যেমন, বিআর-১১, বিআর-২৩, ব্রি ধান-২৯, ব্রি ধান-৪৯, ব্রি ধান-৫১, ব্রি ধান-৫২, ব্রি ধান-৬৭, ব্রি ধান-৭১, ব্রি ধান-৭৩, ব্রি ধান-৭৬, ব্রি ধান-৭৮, ব্রি ধান-৯৯ এবং বিআরআরআই সরিষা-৯-এর মতো জাতগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ জাতগুলো কৃষকের মধ্যে আরও বেশি করে সম্প্রসারিত করতে হবে।
২. পরিবর্তিত ফসল বিন্যাস : জলবায়ুর পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে ফসল বিন্যাসে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। যেমন, খরাপ্রবণ এলাকায় স্বল্পমেয়াদি ও কম জল প্রয়োজন হয় এমন ফসলের চাষ, বা লবণাক্ত এলাকায় লবণাক্ততা সহনশীল ফসলের চাষ। উপকূলীয় অঞ্চলে সমন্বিত কৃষি যেমন-ধান-মাছ-সবজি চাষকে জনপ্রিয় করা যেতে পারে।
৩. উন্নত জল ব্যবস্থাপনা : খরাপ্রবণ এলাকায় বৃষ্টির জল সংরক্ষণ, ভূগর্ভস্থ জলের সাশ্রয়ী ব্যবহার, সোলার সেচ পাম্পের ব্যবহার এবং আধুনিক সেচ পদ্ধতি (যেমন ডিপ ইরিগেশন) ব্যবহার করা জরুরি। বন্যাপ্রবণ এলাকায় ভাসমান কৃষিপদ্ধতি এবং উঁচু বেডে সবজি চাষের মতো কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে।
৪. কৃষি-আবহাওয়া তথ্য সেবা : কৃষকের কাছে কৃষি আবহাওয়াসংক্রান্ত সঠিক ও সময়োপযোগী তথ্য পৌঁছে দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ কৃষি আবহাওয়া তথ্য সেবার মতো উদ্যোগগুলো কৃষকের আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং জলবায়ুসংক্রান্ত ঝুঁকি সম্পর্কে অবহিত করে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করতে পারে।
৫. মাটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা : মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি, সারের সুষম ব্যবহার এবং ভূমিক্ষয় রোধের মাধ্যমে মাটির উর্বরতা বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। জৈব সার ও কম্পোস্ট সারের ব্যবহার রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ সীমিত করতে পারে।
৬. গবাদিপশু ও মৎস্য খাতে অভিযোজন : তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগিকে তাপপ্রবাহ থেকে রক্ষা করার কৌশল, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং মাছ চাষে নতুন প্রজাতির ব্যবহার প্রয়োজন, যা উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল।
৭. প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রস্তুতি : ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, দুর্যোগ সহনশীল অবকাঠামো তৈরি এবং আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা জোরদার করা প্রয়োজন, যাতে কৃষক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পারে। ম্যানগ্রোভ রোপণ এবং আবাসস্থল সংরক্ষণ উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক সুরক্ষা বলয় তৈরি করতে পারে।
প্রশমন কৌশল
প্রশমন কৌশলগুলো গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের গতি হ্রাস করতে সাহায্য করে। কৃষি খাত নিজেও কিছু গ্রিনহাউস গ্যাস (যেমন মিথেন) নিঃসরণ করে, যা কমানো সম্ভব।
১. মিথেন নিঃসরণ হ্রাস : ধান চাষের সময় জলাবদ্ধতার কারণে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। বিকল্প ভেটিং ও ড্রেনিং (Alternate Wetting and Drying - AWD) পদ্ধতির মতো আধুনিক ধানচাষ পদ্ধতি ব্যবহার করে জলের ব্যবহার কমানো এবং মিথেন নিঃসরণ হ্রাস করা সম্ভব।
২. সার ও কীটনাশকের সঠিক ব্যবহার : রাসায়নিক সারের অতিরিক্ত ব্যবহার নাইট্রাস অক্সাইড নিঃসরণ করে, যা একটি শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস। সারের সুষম ও সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং জৈব সারের ব্যবহার উৎসাহিত করা উচিত। কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে জৈবিক বা সমন্বিত বালাই দমন (Integrated Pest Management-IPM) পদ্ধতি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
৩. বনায়ন ও কৃষি বনায়ন : কৃষিজমিতে বা তার আশপাশে গাছ লাগানো হলে তা কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে বায়ুমণ্ডল থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস সরাতে সাহায্য করে। কৃষি বনায়ন (Agroforestry) পদ্ধতি খাদ্য উৎপাদন ও পরিবেশগত সুবিধা উভয়ই প্রদান করতে পারে।
৪. নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার : কৃষিকাজে নবায়নযোগ্য শক্তি, যেমন সোলার পাম্প ব্যবহার করে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো যেতে পারে।
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ ও গবেষণার ভূমিকা
বাংলাদেশ সরকার জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা এবং বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান ২০০৯-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ নীতি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করে নিজস্ব তহবিলের মাধ্যমে জলবায়ু প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এসব প্রকল্পে উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ, বনায়ন কর্মসূচি, সাইক্লোন শেল্টার স্থাপন এবং জলবায়ু সহনশীল কৃষিপ্রযুক্তি উন্নয়নসহ নানা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো (BARI, BRRI, BINA), কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং এনজিওগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তারা নতুন জাত উদ্ভাবন, উন্নত কৃষিপ্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা, কৃষকের প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে। বিশেষ করে জলবায়ু-স্মার্ট কৃষির (CSA) মতো ধারণাগুলো দেশে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, যা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন এবং গ্রিনহাউস গ্যাস প্রশমন-এ তিনটি স্তম্ভের ওপর জোর দেয়।
তবে, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং পর্যাপ্ত অর্থায়নের অভাব প্রায়ই এ উদ্যোগগুলোকে বাধাগ্রস্ত করছে। উন্নত দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণ কমাতে চাপ দেওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি।
খুলনার প্রেক্ষাপটে জলবায়ু পরিবর্তন ও কৃষি
খুলনা বিভাগ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস এখানকার কৃষিব্যবস্থাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। ধানের উৎপাদন কমছে এবং অনেক কৃষিজমি পতিত থাকছে। এ অঞ্চলের কৃষকদের লবণাক্ততা সহনশীল ধান, তরমুজ, ডালজাতীয় ফসল এবং অন্যান্য লবণ সহনশীল সবজি চাষে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ছোট পুকুর এবং সমন্বিত কৃষির মতো প্রযুক্তিগুলো খুলনার কৃষকের জন্য লাভজনক প্রমাণিত হতে পারে।
উপসংহার
জলবায়ু পরিবর্তন মানবজাতির সামনে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার ওপর। কৃষিব্যবস্থার ভবিষ্যৎ এ পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে মানুষ কতটা সক্ষম হবে, তার ওপর নির্ভর করছে কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা। বাংলাদেশসহ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
জলবায়ু সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ, উন্নত জলব্যবস্থাপনা, পরিবর্তিত ফসল বিন্যাস, কৃষি-আবহাওয়া তথ্য সেবা এবং পরিবেশবান্ধব কৃষিপদ্ধতির প্রচলন-এগুলোই হতে পারে কৃষির ভবিষ্যতের মূল চালিকাশক্তি। একইসঙ্গে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর জন্য প্রশমন কৌশলগুলোকেও গুরুত্ব দিতে হবে। সরকার, কৃষিবিজ্ঞানী, কৃষক এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়-সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সমন্বিত উদ্যোগই কেবল কৃষিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করতে পারে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুরক্ষিত খাদ্যব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে। এটি কেবল একটি প্রযুক্তিগত বা বৈজ্ঞানিক লড়াই নয়, এটি মানবজাতির অস্তিত্বের লড়াই, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কর্নেল আবু মোহাম্মদ সিদ্দিক আলম : বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত