জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব কৃষিতে
অভিযোজন কৌশল ও জলবায়ু সহনশীল ফসল উৎপাদনে জোর দিতে হবে [আপডেট : বণিকবার্তা, ৪ ডিসেম্বর ২০২৫]

ফসল উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হলো জলবায়ু। যে কারণে অঞ্চলভেদে ফসল উৎপাদনে বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। যে অঞ্চলে বৃষ্টিপাত বেশি হয়, সেখানে বৃষ্টি অসহনশীল ফসল ফলানো হয় না। কৃষির ইতিহাস অন্তত সে কথাই বলে। তবে সময়ের পরিক্রমায় এ বাস্তবতার পরিবর্তন ঘটেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে কৃষি খাতে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। খরা, বৃষ্টি, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ করার কোনো উপায় নেই মানুষের হাতে। তবে জলবায়ু সহনশীল বীজ তৈরিতে কৃষিবিজ্ঞানীরা সফলতা দেখিয়েছেন। ফলে প্রতিকূল জলবায়ুতেও শস্য উৎপাদন সহজ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশও এক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়েছে।
প্রথমত, কৃষি উৎপাদন কমার অর্থ হলো ভবিষ্যতে দেশের জনগণের খাদ্যনিরাপত্তা বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়তে পারে। দ্বিতীয়ত, পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণে কৃষক প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হলে কৃষি পেশার প্রতি অনাগ্রহ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতেও ফসলের উৎপাদন কমতে পারে। কৃষির উৎপাদন কমে গেলে দেশের অর্থনীতিতে কৃষির অবদান হ্রাসেরও ঝুঁকি রয়েছে। এসব ঝুঁকি মোকাবেলায় কৃষি খাতের সুরক্ষা জরুরি। এজন্য জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কীভাবে অভিযোজন করা যায় সেদিকে জোর দিতে হবে। সেই সঙ্গে প্রশমনের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। তবে যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের কিছু বিষয় এ দেশের মানুষের আয়ত্বে নেই, সেটি বিবেচনায় জলবায়ু সহনশীল ফসল উৎপাদনে মনোযোগী হতে হবে। ফসল বহুমুখীকরণও এক্ষেত্রে ভালো সমাধান হতে পারে।
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু অভিযোজিত কৃষি সম্প্রসারণের কার্যকর উপায়গুলোর একটি হলো জলবায়ু সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন। উচ্চ তাপমাত্রা, লবণাক্ততা, বন্যা কিংবা খরা সহনশীল জাত এরই মধ্যে দেশে উদ্ভাবিত হলেও মাঠপর্যায়ে এখনো কাঙ্ক্ষিত প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না। তাই শুধু নতুন জাত উদ্ভাবন নয়, কৃষকের কাছে দ্রুত তা পৌঁছানো এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়াও জরুরি। এগুলোর জন্য কৃষি খাতে গবেষণায় জোর দিতে হবে। আর গবেষণা কেবল নতুন জাত উদ্ভাবনে সীমাবদ্ধ রাখলেই চলবে না। জলবায়ুনির্ভর কৃষি পরিকল্পনা নিতে হবে। কৃষিজমির পুষ্টিগুণ, পানি ব্যবস্থাপনা, কৃষিপ্রযুক্তির ব্যবহার, আধুনিক সেচ ব্যবস্থা, মৌসুম অনুযায়ী ফসল উৎপাদনের মতো কৌশল বাস্তবায়নও জরুরি। পাশাপাশি আধুনিক কৃষিযন্ত্র বা প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ জনবল তৈরির দিকেও মনোযোগ দিতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষিতে যে প্রভাব পড়ছে তা মোকাবেলায় ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার বা জলবায়ু অভিযোজিত, জলবায়ু সহনশীল কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহারের দিকে যেতে হবে। এটি এমন একটি কৌশল, যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করতে, এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে সাহায্য করে। এর মূলেও রয়েছে অভিযোজন ও প্রশমন কর্মসূচি। এর লক্ষ্য হচ্ছে কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, উৎপাদনের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা ও গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস।
কৃষির সুরক্ষায় প্রশমন কৌশল হিসেবে রাসায়নিক সার, পানি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি দিকেও নজর দেয়া প্রয়োজন। তবে প্রশমনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হতে হবে কৃষকের সুরক্ষা ঘিরে। ফসলের মাঠের অতিরিক্ত তাপ, বজ্রপাতসহ বৃষ্টি বা শিলাবৃষ্টির মতো দুর্যোগ থেকে কৃষকদের জন্য সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে কৃষকদের কিছুটা হলেও স্বস্তি ও সুরক্ষা দেয়া সম্ভব হবে। এছাড়া কৃষকদের জন্য সরকারের আর্থিক ও নীতিগত সহায়তাও বাড়াতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি এবং সহনশীল প্রযুক্তি সম্পর্কে কৃষকদের অবহিত করতে হবে। তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে অগ্রসরমাণ কৃষিপ্রযুক্তি সম্পর্কে। এক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। কেননা কৃষিতে নারীদের অংশগ্রহণও উল্লেখযোগ্য। পাশাপাশি কৃষকদেরও সচেতন করতে হবে যেন জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে এমন কৃষি পদ্ধতির প্রয়োগ থেকে তারা সরে আসেন। কিন্তু এ দায়িত্ব কেবল কৃষকদের নয়, দেশের আপামর জনসাধারণের মধ্যে এ সচেতনতা থাকা জরুরি।
কৃষি ও কৃষকের সুরক্ষায় পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা দূর করার পথেও হাঁটতে হবে। যেমন কৃষি জমির পরিমাণ দিন দিন কমছে। নদীভাঙনের মতো দুর্যোগের কারণে যেমন কমছে তেমনি নিয়ম-নীতির পরিপালন না থাকার কারণেও এটি হচ্ছে। কৃষিজমির ওপর স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। কৃষিজমির সুরক্ষায় দেশে, বিশেষ কোনো আইন নেই বা নজরদারিও নেই। এটিও কৃষির জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি। এছাড়া মিলার ও ব্যবসায়ীদের আধিপত্যে প্রায় সময় দেখা যায় কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য পান না। যদিও দিন দিন উৎপাদন ব্যয় বেড়ে চলেছে। এতেও কৃষিকাজের প্রতি অনাগ্রহ বাড়ছে। একসময় কৃষি খাতে শ্রমশক্তির বেশির ভাগ নিয়োজিত ছিল। কিন্তু তা কমে বর্তমানে প্রায় ৪৫ শতাংশে নেমেছে। কৃষি খাতের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এর জন্য দায়ী, যেখানে কৃষি শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি কাঠামোও নেই। আরো উদ্বেগজনক হলো কৃষি উৎপাদনের তথ্য নিয়েও নীতিনির্ধারকরা নিশ্চিত হতে পারেন না। এক্ষেত্রে পরিসংখ্যানগত সমস্যা রয়েছে। ফলে কার্যকর নীতি গ্রহণ ব্যাহত হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়। তার পরও আমদানির প্রয়োজন হয়। এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে না পারলে কেবল জলবায়ু অভিযোজিত ও সহনশীল কৃষি খাত গড়ে তুলেও খুব একটা সুফল আসবে না। কৃষি খাতকে সামগ্রিকভাবে স্থিতিশীল করে গড়ে তুলতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি না হয়।