জলবায়ু পরিবর্তনের নতুন মাত্রা দাবানল
ড. মো. আবদুল বাকী চৌধুরী নবাব । সূত্র : সময়ের আলো, ২১ জানুয়ারি ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় স্মরণকালে বড় দাবানলের তাণ্ডব চলছে। বস্তুত দাবানল হলো বনে অগ্নিসংযোগ। ‘দাব’ এর অন্য বাংলা অর্থ হলো বন বা অরণ্য। আর অনল হলো ‘আগুন’। তা হলে সন্ধিবিচ্ছেদে দাব+অনল=দাবানল। ইংরেজিতে হলো ওয়াইল্ডফায়ার। সাধারণত বনে আগুন লাগার ক্ষেত্রে সূর্যের তাপের আওতায় ডালে ডালে ঘর্ষণ, অগ্ন্যুাৎপাত ও বজ্রপাতসহ প্রাকৃতিক কারণ মাত্র পাঁচ ভাগের এক ভাগ। বাকি চার ভাগের জন্য দায়ী মানুষ; যেমন-মানুষের অসতর্কতা, ইচ্ছাকৃত আগুন লাগানো, আতশবাজি, সিগারেটের অবশিষ্টাংশ, ক্যাম্প ফায়ার, বনভোজন ইত্যাদি।
বস্তুত পাহাড়িয়া অঞ্চলে দাবানলের ইন্ধন কিছুটা বেশি। কেন উষ্ণ তাপশিখা ক্রমশ ওপরের দিকে উঠতে থাকে আর পোড়াতে থাকে বন। এদিকে উঁচু গাছের ক্যানপির আগুন অনায়াসে উড়তে থাকে যত্রতত্র। এসব আগুন নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন হয়ে পড়ে।
কারণ আগুন থামার জন্য সহজে কোনো ব্ল্যাঙ্ক করিডোর তৈরি করা যায় না, যাতে সেখান থেকে স্তূপ, ঝরা পাতা, ভেষজ দাহ্যবস্তুসমূহ দ্রুত সরিয়ে ফেলা যায়। তাই যতক্ষণ খুশি আপন মনে জ্বলতে থাকে সেই আগুন। আর একবার আগুন লাগলে প্রকৃতিও তাকে ইন্ধন জোগায় পাগলের মতো। ফায়ার স্টর্ম, আগুনে-সাইক্লোন ও অগ্নি-টর্নেডোর রূপ নিয়ে দিগবিদিক ছড়িয়ে পড়ে, চলে একের পর এক করাল গ্রাস। তা ছাড়া শুষ্ক বায়ুপ্রবাহ অগ্নি স্ফুলিঙ্গকে মাইলকে মাইল দূরে অনায়াসে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। তাই এর বিপর্যয়ের আওতায় ধ্বংসযজ্ঞ দূর-দূরান্তে সহজে ছড়িয়ে পড়ে।
৭ জানুয়ারি (২০২৫) থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যার্লিফোনিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসে চলমান দাবানল ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে। এতে ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেস, আনাহেইম, রিভারসাইড, স্যান বারনারডিনো, অক্সনার্ডসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং তাদের জীবন রক্ষা করতে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে সিএনএন। এ পর্যন্ত দাবানলে অন্তত ২৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে এবং আরও অনেকের জীবন এখনও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এদিকে দাবানল নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য শত শত দমকলকর্মী দিনরাত কাজ করে চলেছেন।
তবে তীব্র বাতাস পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে। ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসে প্যালিসেডস ও ইটন দাবানল দুটি এখন সবচেয়ে বিধ্বংসী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং দূষণের কারণে আগুনের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। চারদিকে শুকিয়ে খটখটে হয়ে থাকা পরিবেশের মধ্যে মরুভূমির ন্যায় আগুন আরও উসকে ওঠার মতো বিপজ্জনক অবস্থায় বিরাজ করছে। তবে দমকলকর্মীদের অক্লান্ত চেষ্টায় দাবানল আর তেমন ছড়াতে পারেনি। উল্টো দাবানলের ওপর নিয়ন্ত্রণ কিছুটা হলেও বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত সাতটি অঙ্গরাজ্য ও দুটি বিদেশি রাষ্ট্রের প্রায় ৮ হাজার ৫০০ দমকলকর্মী লস অ্যাঞ্জেলেসের দাবানলগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছেন। তারা দাবানলগুলোকে আর তেমন বাড়তে দেননি। তবে ৭ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এই দাবানলের থাবায় ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির প্রায় সমপরিমাণ এলাকা ধ্বংস হয়ে গেছে। আকাশযানের একটি বহর শুকিয়ে রুক্ষ হয়ে থাকা পাহাড়গুলোতে পানি ঢালছে এবং যুগপৎ আগুন নিরোধক ছিটাচ্ছে। নিচে স্থলে থাকা দমকলকর্মীরা পানির পাইপ ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি নিয়ে ২৪ ঘণ্টা আগুনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তীব্র ঝড়ো বাতাসের কারণে আকাশযানগুলো কখনো কখনো নিচে নামিয়ে রাখতে হচ্ছে।
লস অ্যাঞ্জেলেস নগরীর পশ্চিম প্রান্তের দাবানলটিই সবচেয়ে বড়। এই প্যালিসেইডস আগুন ৯৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা পুড়িয়ে দিয়েছে। যদিও দমকলকর্মীরা এটিকে এই সীমার মধ্যেই আটকে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। আর তাদের নিয়ন্ত্রণ ৩ শতাংশ বাড়িয়ে মোট ১৭ শতাংশে উন্নীত করতে পেরেছেন। নগরীর পূর্ব প্রান্তের পাহাড়গুলোর পাদদেশের ইটন আগুন ৫৭ বর্গকিলোমিটারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। এই দাবানলের ওপর নিয়ন্ত্রণ ২ শতাংশ বেড়ে ৩৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলে গত এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত তেমন কোনো বৃষ্টি হয়নি। এতে পাহাড়ি ঝোপঝাড়গুলো শুষ্ক খড়কুটোর মতো হয়ে আছে, যা আগুন লাগা এবং ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে কয়েক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে।
দাবানল নতুন কিছু নয়। স্মরণকাল থেকে দাবানল চলে আসছে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলেই দেখা যায় এ ধরনের দাবানল। যেখানে শুষ্ক আবহাওয়া ও প্রচুর গাছপালা থাকে, সাধারণত সেসব এলাকাগুলোতে বেশি দাবানলের ঘটনা ঘটে। আগে দাবানলের ঘটনা ঘটেছে, এমন এলাকায় দাবানল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া, ওরিগন, ওয়াশিংটন, নেভাদা ও অ্যারিজোনার কিছু অংশ দাবানলের জন্য পরিচিত।
এখানে শুষ্ক গ্রীষ্ম, তীব্র বাতাস এবং বিস্তৃত বনাঞ্চল থাকায় দাবানলের ঝুঁকি অনেক বেশি। তা ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে গ্রীষ্মকালে মারাত্মক দাবানল দেখা যায়। এই দেশটির ইতিহাসে ভয়াবহ দাবানলের ঘটনা অনেক দীর্ঘ। এ ছাড়া স্পেন, পর্তুগাল, ইতালি এবং গ্রিসের মতো দেশগুলোতে গরম ও শুষ্ক গ্রীষ্মকাল হওয়ায় প্রায়ই দাবানলের ঘটনা ঘটে। বন নিধন ও জমি পরিষ্কার করতে মানুষের নানা কার্যকলাপের কারণে ব্রাজিলের আমাজন অঞ্চলে দাবানল ঘটে।
সাইবেরিয়া এবং রাশিয়ার কিছু বনাঞ্চলে গ্রীষ্মকালে দাবানল লাগে; বিশেষ করে সেখানে যখন গাছপালা খুব শুকিয়ে যায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও দেখা যায় দাবানল। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের কিছু অংশে দাবানল দেখা যায়। অবশ্য চাষের জন্য জমি পরিষ্কার করতে ব্যবহৃত ‘স্ল্যাশ-অ্যান্ড-বার্ন’ পদ্ধতির সঙ্গে এই অঞ্চলের দাবানল লাগার সম্পর্ক রয়েছে।
বস্তুত আগুন প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম যেভাবেই লাগুক। এক পর্যায়ে এটি ক্ষতিকর রূপ নিলেও এর ভেতর কিছু কল্যাণকর দিকও আছে। প্রকৃত প্রস্তাবে, মাঝেমধ্যে আগুন না লাগলে বনাঞ্চলের ন্যাচারাল ইকোসিস্টেম নষ্ট হয়ে যায়। এ প্রেক্ষাপটে মৃত ও পচনশীল দ্রব্যাদি পুড়ে গিয়ে শুদ্ধ হয় পরিবেশ, গাছের কাণ্ডে জমে থাকা পুষ্টি, অগ্নিকাণ্ডের পরে আবার ফেরত আসে জমিতে। তা ছাড়া যাবতীয় ক্ষতিকর পোকামাকড় ধ্বংস হয় এবং এতে রোগশোকের জীবাণুও নষ্ট হয়ে যায়। এদিকে উঁচু গাছের শামিয়ানা পুড়ে গেলে অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে বনের উঠানে সূর্যের আলো ঢুকে পড়ে। তখন ছাইয়ের গাদায় শুরু হয় নতুন জীবন। প্রথমে তৃণ, তারপর বড় গাছ এবং ক্রমশ নিবিড় অরণ্য। আর এটাই চিরাচরিত চক্র।
এবার আসুন বাংলাদেশের কথা বলা যাক। বাংলাদেশের ১১ শতাংশ বনাঞ্চলে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা নগণ্য। এর একটি কারণ, বনাঞ্চলের বড় গাছগুলোর ক্যানপি বা শামিয়ানাগুলো লাগাতার নয়, খণ্ড খণ্ড। এসব খণ্ড বনে দাহ্য বস্তুর অভাবহেতুও অগ্নিকাণ্ড সহজে ভয়াবহ রূপ নিতে পারে না। এদিকে ভারতের ১৯ শতাংশ বনাঞ্চলের প্রায় ৫০ শতাংশ নিবিড় বন। শুষ্ক আবহাওয়ায় জল স্বল্পতার কারণে পত্রমোচী গাছ পাতা ঝরিয়ে দেয়। সেই ঝরা পাতা আর শুকনো গুল্ম থেকে আগুন লেগে বিস্তৃত হয়ে পড়ে বনানীতে। উল্লেখ্য যে, ১৯৯৫ সনে উত্তর প্রদেশ এবং হিমাচল প্রদেশে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে গেছে ৭ লাখ একর জমির বনাঞ্চল, যার ক্ষতিপূরণ হতে দীর্ঘদিন লেগে যায়।
মূলত ভারত ও বাংলাদেশের প্রায় সব আগুনই মানুষের অবহেলাজনিত কারণে লেগে থাকে, প্রাকৃতিক কারণে নয়। প্রসঙ্গক্রমে যেসব কারণে বনে দাবানল হয় এবং শহর পুড়ে যায়। তার বেশ কটি অবস্থা এখনও বিদ্যমান আমাদের উপমহাদেশে। তাই যথাযথভাবে সাবধান না হলে আমরা অগ্নিকবলিত হতে পারি, রোম বা লন্ডনের মতো জ্বলে যেতে পারে আমাদের ঠাসা বস্তি-শহর, জ্বলে যেতে পারে অবশিষ্ট বনজ সম্পদ। সেহেতু সংশ্লিষ্ট সবাইকে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে, যাতে এই দাবানলের বিপর্যয়ের মধ্যে না পড়ি।
পৃথিবীর ক্ষুদ্র-বৃহৎ বনাঞ্চলগুলোতে দাবানলের ঘটনা অহরহ ঘটেই থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে দেখা যায়, বিজ্ঞানের এই চরম উন্নতির যুগেও মানুষ দাবানলের কাছে হেরে যাচ্ছে। শত চেষ্টা-তদবির করেও দাবানলের আগুন নেভানো সম্ভব হয় না বা আগুনকে আয়ত্তে আনা যায় না। এ ক্ষেত্রে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানল, আমাজন অঞ্চলের দাবানল, চিলির দাবানল, ব্রাজিলের দাবানল এবং অস্ট্রেলিয়ার দাবানল এ কথারই চূড়ান্ত সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তথাকথিত সভ্য প্রায় ৮০০ কোটি মানুষকূলকে বুঝিয়ে দিচ্ছে কীসের এত অহঙ্কার এবং কীসের এত বাড়াবাড়ি। তবে মানুষসৃষ্ট দাবানল থেকে সতর্ক থাকতে হবে।
সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়