জলবায়ু সম্মেলন কপ৩০ থেকে বাংলাদেশ কী পেল
আবুল কালাম আজাদ [প্রকাশ : সমকাল, ০২ ডিসেম্বর ২০২৫]

এবারের জলবায়ু সম্মেলন থেকে বাংলাদেশ কী পেল? তার আগে বলা দরকার, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো বৈশ্বিক জলবায়ু রাজনীতিকে অদ্যাবধি তাদের জাতীয় রাজনীতিতে অঙ্গীভূত করতে সক্ষম হয়নি। জাতীয় রাজনীতিতে তার কোনো প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় না। রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহার ও কর্মসূচিতেও জলবায়ু রাজনীতি অনুপস্থিত। রাজনীতির মাঠে এ বিষয়ক কোনো বিতর্ক বা প্রচারণাও পরিলক্ষিত হয় না। বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য ফি-বছর বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণ একটি নিয়ম রক্ষার কার্যক্রমের মতো। কিছু নগদ প্রাপ্তির আশায় নামমাত্র প্রতিনিধি দল পাঠানো হয়। প্রতিবছর কপ ভেন্যুতে একটি নিয়ম রক্ষার প্যাভিলিয়ন করা হয়। সেখানে বাংলাদেশকে যথাযথভাবে তুলে ধরা হয় না। ফলে বাংলাদেশে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন নিয়ে আলাপচারিতার কেন্দ্রে থাকে, বাংলাদেশ কী পেল? আর নির্দিষ্ট করে বললে, নগদ কী পেল?
অথচ কপ প্রক্রিয়ায় একটি একক দেশের আলাদাভাবে কোনো কিছু পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নগদ প্রাপ্তির তো প্রশ্নই আসে না। কারণ এটা যৌথ দরকষাকষির পাটাতন, যা ঐকমত্যের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। টেকনিক্যালি কোনো একক দেশ কোনো এজেন্ডা প্রস্তাব করতে পারে এবং সেটা এজেন্ডাভুক্তও হতে পারে। আবার কোনো একক দেশ ভেটো দিয়ে কোনো প্রস্তাব বাতিলও করতে পারে। কিন্তু কোনো দেশই কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগ করতে পারে না। যে কারণে কপ প্রক্রিয়ায় দেখা যায়, সমস্বার্থসংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সমন্বয়ে অনেক রাজনৈতিক ব্লক গড়ে উঠেছে। যেমন- জি৭৭+চায়না, এওএসআইএস, এলডিসি গ্রুপ, এলএমডিসি, ইইউ। অনেক সময় তাৎক্ষণিক কোনো বিশেষ ইস্যুতে অনানুষ্ঠানিক আমব্রেলা গ্রুপও গড়ে ওঠে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহৎ জোট হলো ১৯৬৪ সালে গঠিত বর্তমানে ১৩৪টি সদস্য রাষ্ট্রের জোট জি৭৭।
বাংলাদেশ সাধারণত এলডিসি গ্রুপের সদস্য হিসেবে কপে অংশগ্রহণ করে থাকে। বাংলাদেশ গত বছর থেকে একটি নতুন কোয়ালিশন গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এই কোয়ালিশনে আছে বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটান। মূলত কাছাকাছি আর্থসামাজিক অবস্থা, ভৌগোলিক অবস্থান এবং এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনকে ভিত্তি ধরে জরুরি জলবায়ু পদক্ষেপের জন্য কৌশলগত সহযোগিতার অংশ হিসেবে এই কোয়ালিশন গঠিত হয়েছে। এ বছর এই কোয়ালিশন যৌথভাবে দরকষাকষিতে অংশগ্রহণ করছে। পাশাপাশি এই জোট খসড়া ন্যূনতম সম্মত কর্মসূচিও গ্রহণ করেছে। এই দলিল চূড়ান্ত হওয়ার আগে সরকার নিশ্চয় যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করবে এবং স্থানীয় নাগরিক সমাজ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ গ্রহণ করবে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে এটি একটি সম্ভাবনাময়ী জোট হয়ে উঠতে পারে। যদি আরও কিছু সমস্বার্থ ও সমমনা দেশকে এর অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তাহলে কপের দরকষাকষিতে এই জোট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
কপ একটি বিশ্বমঞ্চ। পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্র এখানে অংশগ্রহণ করে থাকে। পাশাপাশি দাতাগোষ্ঠী, বৃহৎ করপোরেট ব্যবসায়ী, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও সংবাদকর্মীরাও ব্যাপকভাবে কপে আসেন বা যুক্ত থাকেন। ফলে এখানে নিজের দেশকে, দেশের কাজ ও সফলতাকে যথাযথভাবে তুলে ধরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ সেটা কতটা পারছে? গত দুটি কপের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, বাংলাদেশ সেটা পারছে না। দেশকে তুলে ধরার জন্য বাংলাদেশের যে প্যাভিলিয়ন করা হয়, সেটা খুবই সাদামাটা হয়ে থাকে। এবার কপে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন ছিল খুবই হতাশাজনক এবং এটা নিয়ে এমনকি গণমাধ্যমেও নেতিবাচক সংবাদ হয়। অথচ বাংলাদেশের তুলে ধরার মতো অনেক কিছু আছে।
মন্ত্রণালয় যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করলে, অন্যান্য অংশগ্রহণকারী পক্ষের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করলে বাংলাদেশও কপে নিজেকে সুন্দর ও আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরতে এবং অন্যদের আকৃষ্ট করতে পারে, যা সত্যিকার অর্থে প্রাপ্তির সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।
কারণ কপ অত্যন্ত ধীর প্রক্রিয়া; পা টিপে টিপে এগোচ্ছে। গত ৩০ বছরের কপ প্রক্রিয়ায় জলবায়ু ন্যায়বিচার খুব বেশি অগ্রসর হতে পারেনি। তার একটি বড় কারণ জটিল দরকষাকষি প্রক্রিয়া এবং বিষম স্বার্থসংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য ও সম্মতি সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। মনে হয় একটা চক্রের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে কপ প্রক্রিয়া, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। বছর বছর কপে নতুন নতুন প্রতিশ্রুতি আসছে; নতুন পাঠ্য ও শব্দভান্ডার তৈরি হচ্ছে এবং নতুন নতুন সংখ্যার আর্বিভাব ঘটছে। কিন্তু কাঠামোগত কোনো মৌলিক পরিবর্তন হচ্ছে না। অনেকটা পুরোনো পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আরও গভীর শোষণমূলক নব্য উদারবাদী ব্যবস্থায় বিকশিত হওয়ার মতো এগোচ্ছে।
কপে অংশগ্রহণকারী অনেকে এই পুনরাবৃত্তিমূলক চক্রে হতাশ। এই চক্র ভাঙতে হলে স্থানীয়ভাবে উদ্যোগ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। ক্ষতিগ্রস্ত ও স্থানীয় মানুষকে সংগঠিত করা; সম্মিলিত বোঝাপড়া জোরদার করা ও নিজেদের সামর্থ্য বাড়ানো। যাতে জলবায়ুর জন্য ক্ষতিকারক আর্থিক প্রবাহকে চ্যালেঞ্জ জানানো যায়; মানুষ ও প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকর প্রকল্পগুলো আটকে দেওয়া যায়। নব্য উদারনীতিবাদের নীতি ও কাঠামোর বিপরীতে এমন কাঠামো তৈরি করতে হবে যা সত্যিকার অর্থে মানুষ এবং আমাদের প্রাণপ্রিয় গ্রহের সেবা, জলবায়ু সুবিচার ও প্রাণ-প্রকৃতির সুরক্ষা নিশ্চিত করে। এবার কপে নাগরিক সমাজ থেকে যে স্লোগানটি বারবার উচ্চারিত হয়েছে তা হলো– জনগণের ক্ষমতায়ন। এবার এই স্লোগান আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছে আমার কাছে, বিশেষত বাংলাদেশের জন্য। বাংলাদেশের মতো দেশগুলো এই প্রক্রিয়ায় একেবারে তৃণমূল থেকে জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে এবং বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের মতো বিশ্ব দরবারে নিজেকে তুলে ধরতে ও নিজের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে পারে।
আবুল কালাম আজাদ: ম্যানেজার, জাস্ট এনার্জি ট্রানজিশান, একশনএইড বাংলাদেশ