জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় দক্ষিণ এশীয় প্রয়াস
আয়শা খান [প্রকাশ : সমকাল, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫]

দক্ষিণ এশিয়া জলবায়ু সংকটের সীমান্তে এবং নিজের ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। প্রায় ২০০ কোটি মানুষের আবাসস্থল এই অঞ্চল ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতার মধ্যে আটকে আছে। তৃতীয় মেরুর হিমবাহগুলো দ্রুত গলে যাচ্ছে, যা পাকিস্তান ও ভারত উভয়ের পানি নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে। বারবার খরার ফলে অভিবাসন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আফগানিস্তানে দারিদ্র্য আরও বাড়ছে। হিমবাহের হ্রদের আবির্ভাবের ফলে নেপালে পাহাড়ি সম্প্রদায় হুমকির সম্মুখীন। অন্যদিকে বাংলাদেশ সমুদ্রতল উত্থানের কারণে তার এক-পঞ্চমাংশ ভূমি হারাতে পারে।
কয়েক দশক ধরে সীমান্ত বিরোধ, পরিচয় রাজনীতি এবং ঐতিহাসিক অভিযোগের কারণে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক শক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। যদি জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের ভূমিকে বসবাসের অযোগ্য এবং অর্থনীতিকে অযোগ্য করে তোলে, তাহলে এসব প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোনো মানে থাকবে না।
বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদন অনুসারে, দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে। তাই এ অঞ্চল আরও এক শতাব্দী ঘৃণা ও শত্রুতার ভার বহন করতে পারে না।
এ অঞ্চলের হিমবাহগুলো ছোট হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিন্ধু, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মতো আন্তঃসীমান্ত নদীগুলো ক্রমশ দুর্বোধ্য হয়ে উঠছে। এই প্রেক্ষাপটে পানি কেবল সম্পদ থাকছে না, বরং একটি সম্ভাব্য ফল্ট লাইন বা বিপদ রেখাও হয়ে উঠছে। পানিপ্রবাহ যত অনিয়মিত হচ্ছে, বাঁধ তৈরি ও পানি প্রত্যাহারের প্রলোভনও বাড়ছে।
বিশ্বব্যাংক বলছে, জলবায়ু প্রভাবের কারণে দক্ষিণ এশিয়া শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ তার জিডিপির ১০ শতাংশ পর্যন্ত হারাতে পারে। কৃষি, যে খাতে অঞ্চলের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা নিযুক্ত, তাপ-চাপ ও অপ্রত্যাশিত বৃষ্টিপাতের কবলে পড়বে। লাহোর, দিল্লি এবং ঢাকার মতো শহর ধোঁয়াশা ও পানির
ঘাটতিতে পড়তে যাচ্ছে। ভেক্টরবাহিত রোগ এবং তাপ সম্পর্কিত অসুস্থতার কারণে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে।
স্পষ্টত, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রতি আসল হুমকি সীমান্তের বাইরে নেই। এটি তার বায়ুমণ্ডল, নদী ও তৃতীয় মেরুতে অবস্থিত। এটি এমন একটি অঞ্চল যেখানে ক্ষুধা ও আশা অস্থিরভাবে সহাবস্থান করে; শান্তি কেবল একটি রাজনৈতিক অবস্থান নয় বরং বেঁচে থাকার কৌশল। এই অস্তিত্বগত হুমকি পারমাণবিক অস্ত্রের চেয়েও ভয়াবহ। এটি লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করতে এবং পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যৎকে অচল করে দিতে পারে।
সময় এসেছে রাজনৈতিক আলোচনা পুনর্বিন্যাস করার এবং প্রকৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে ভবিষ্যৎ দেখার। এখন পর্যন্ত পাকিস্তান এবং ভারত বিতর্কিত এজেন্ডাগুলোকে তাদের উদ্দেশ্যের মূল ভিত্তি হিসেবে রেখে একটি নিষ্ফল খেলায় মেতে রয়েছে। এর পরিবর্তন প্রয়োজন। অর্থাৎ জনগণের বেঁচে থাকা ও কল্যাণকে মূল লক্ষ্য ধরে বিরোধগুলোকে বাধা হিসেবে দেখতে হবে। ধারণার এই পরিবর্তন এবং একটি সমন্বিত আলোচনার কৌশল উদ্দেশ্যমূলক বিতরণধর্মী কিছু নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করতে পারে। এতে প্রতিটি দেশ প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নের জন্য উচ্চতর সম্ভাবনার সন্ধান পেতে পারে।
প্রকৃত অর্থে এশিয়া তখনই মনোযোগের কেন্দ্র হতে পারে যদি দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশ জলবায়ু সংকটকে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা হিসেবে সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করতে সম্মত হয়। একটি আঞ্চলিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের অনেক সুবিধা রয়েছে, যা পেতে হলে দেশগুলোর মধ্যে আলোচনার চালিকাশক্তি হতে হবে বাস্তববাদিতা; আবেগ নয়। সংযুক্ত ভৌগোলিক অঞ্চলগুলো সবুজ করিডোর হিসেবে কাজ করে এবং জলবায়ু সংকট দক্ষিণ এশিয়ার জন্য নিজস্ব ‘আঞ্চলিক জলবায়ু কাঠামো চুক্তি’ তৈরি প্রয়োজনীয় করে তোলে। বর্তমান উত্তেজনা সত্ত্বেও জলবায়ু সহযোগিতাকে পরিবেশগত উদ্বেগের বিষয় হিসেবে নয়, বরং একটি মূল নিরাপত্তা সমস্যা হিসেবে পুনর্বিবেচনা করার যুক্তিসংগত কারণ ও প্রয়োজনীয়তা এখনও রয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার দুটি সমান্তরাল ভবিষ্যৎ রয়েছে; একটি হলো গতানুগতিক ব্যবসা-বাণিজ্য যা আমাদের দারিদ্র্যের মধ্যে আটকে রাখবে; সংঘাত বাড়িয়ে ঝুঁকি আরও তীব্র করবে। একটি ভিন্ন পথ শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার যুগের সূচনা করতে পারে। তরুণদের ভবিষ্যৎকে ভয়াবহ করে তোলা উচিত নয়। তাদের একটি নতুন ভবিষ্যৎ তৈরি করতে হবে; তা তেমনই হবে যেখানে তারা যেতে চায়।
এ অবস্থান পরিবর্তনে প্রয়োজন সাহসের সঙ্গে বিদ্যমান বাস্তবতাকে চ্যালেঞ্জ করা এবং স্পষ্ট উপলব্ধি যে, বেঁচে থাকা নির্ভর করে প্রতিযোগিতা নয়; দায়িত্ব ভাগাভাগির ওপর। এটি কোনো ইউটোপিয়ান চিন্তা নয় বরং একটি কৌশলগত বাধ্যবাধকতা। যুদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে না। তবে এর পরিণাম হবে ক্ষুধা, স্থানচ্যুতি ও ভবিষ্যৎ হারানো।
আয়শা খান: সিভিল সোসাইটি কোয়ালিশন ফর ক্লাইমেট চেঞ্জের প্রধান নির্বাহী; পাকিস্তানের দৈনিক ডন থেকে ভাষান্তর সাইফুর রহমান তপন