কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

জনপ্রশাসনসহ সাধারণ সেবা খাতে সংস্কার হয়নি, বেড়েছে সরকারের খরচ : জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে দৃশ্যমান পদক্ষেপ দরকার

[সূত্র : বণিক বার্তা, ১৮ মে ২০২৫]

জনপ্রশাসনসহ সাধারণ সেবা খাতে সংস্কার হয়নি, বেড়েছে সরকারের খরচ : জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে দৃশ্যমান পদক্ষেপ দরকার

কোনো রাষ্ট্রকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রতিষ্ঠান হলো রাজনৈতিক দল ও আমলাতন্ত্র। রাজনৈতিক নেতারা সৎ, শুদ্ধাচারী, জনবান্ধব, ন্যায়পরায়ণ ও দায়িত্বশীল হলে এবং আমলাতন্ত্রের সদস্যরা মেধাবী, দক্ষ, সৎ, কর্মযোগী, সাহসী, সেবাবান্ধব ও সিদ্ধান্ত প্রদানে চৌকস হলে রাষ্ট্র সামনে হাঁটে। রাজনীতিক এবং আমলাদের উদ্দেশ্য সৎ না হলে এবং জবাবদিহিতা না থাকলে রাষ্ট্রের পক্ষে সঠিক পথে হাঁটা সম্ভব হয় না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রের কোনোটাকেই সঠিক পথ দেখানো যায়নি। তখন আমাদের রাজনীতি হওয়ার কথা ছিল উদার গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং আমলাদের হওয়ার কথা ছিল প্রজ্ঞাসম্পন্ন, চৌকস, সেবাবান্ধব ও জবাবদিহিমূলক।

 

 

 

কিন্তু রাজনীতিকে এক ব্যক্তিবাদী এবং আমলাতন্ত্রকে মেধাবিরোধী ও বিশৃঙ্খল অবস্থায় ফেলে দেয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের রাজনীতিবিদরা আমলাতন্ত্রের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। এ সুযোগকে কিছু কিছু আমলা ব্যক্তিস্বার্থে কাজে লাগিয়েছে। আমলারাও রাজনীতিবিদের ব্যবহার করেছে। এ অবস্থা থেকে বের হতে হলে রাজনৈতিক শক্তিগুলোকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা আমলাদের ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করবে না এবং আমলাদের দক্ষ ও পেশাদার সেবক হিসেবে গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় পদেক্ষপ নেয়া হবে।

 

 

দেশের জনপ্রশাসন দীর্ঘদিন ধরেই নানা সংকটে জর্জরিত। বিশেষ করে বিগত সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে এর অতিমাত্রায় রাজনৈতিকীকরণের ফলে যে প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে উঠেছে, তাতে জনগণের সেবাদানে এর কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সেই সঙ্গে এ জনপ্রশাসনের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থার সংকট তীব্র হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে এ সরকারের একটি ব্রত হলো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে জনবান্ধব সংস্কার সাধন করা। এজন্য বিভিন্ন কমিশন গঠন করা হয়েছিল। এমন প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে অন্তর্বর্তী সরকার জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করে। প্রায় চার মাস নানা বিচার-বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে এ কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দেয় চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে দুই শতাধিক সুপারিশ রয়েছে। এতে অনেক ইতিবাচক সুপারিশও রয়েছে। আবার এমন কিছু সুপারিশও রয়েছে যেগুলো বাস্তবায়ন হলে রাষ্ট্রের সংকট আরো বাড়বে এবং আমরা পিছিয়ে পড়ব। তাই সরকারকে বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে তিন মাস আগে। যদিও এখনো সংস্কার কার্যক্রমে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের দেয়া প্রতিবেদন আদৌ বাস্তবায়ন হবে কিনা তা কারো জানা নেই। ফলে জনমনে তৈরি হয়েছে সন্দেহ। জনপ্রশাসনকে গতিশীল করতে সংস্কার কমিশনের দেয়া প্রতিবেদনের ইতিবাচক সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে দ্রুত দৃশ্যমান বা কার্যকর পদক্ষেপ দরকার।

 

 

সরকারের ব্যয় কমাতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিব ও সচিবের সংখ্যা কমিয়ে ৬০ করারও সুপারিশ ছিল। পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হয় কমিশনের প্রতিবেদনে। বিদ্যমান আটটি প্রশাসনিক বিভাগের পাশাপাশি নতুন করে ফরিদপুর ও কুমিল্লা বিভাগ গঠন ও মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা ৪৩টি থেকে কমিয়ে ২৫টি করাসহ দুই শতাধিক সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে। কিন্তু তিন মাস পেরিয়ে গেলেও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন সুপারিশ করলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। এমনকি সংস্কার কার্যক্রম শুরুরও কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এর জন্য দরকার বড় ধরনের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি। রাজনৈতিক দলগুলোর এমন ঐকমত্য দরকার যে যখন যারা ক্ষমতায় যাবে তারা কেউই রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে প্রশাসনকে ব্যবহার করবে না। এগুলো ছাড়া কোনোভাবেই বর্তমান প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন সম্ভব নয়।

 

 

 

অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সাধারণ সেবা খাতে ৪৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সরকার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ৩২ হাজার ৮৪ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে সাত মাসে সরকারের ব্যয় বেড়েছে ১৫ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শুধু বেতন-ভাতা বাবদ চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারের ব্যয় হয়েছে ৩৭ হাজার ৪৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে যেখানে ৩৬ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছিল। এছাড়া শৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তা খাতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে খরচ হয়েছে ১২ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময় পর্যন্ত এ খাতে সরকারের ব্যয় ছিল ১২ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা। ফলে এ খাতেও সরকারের ব্যয় বেড়েছে।

 

 

 

জনপ্রশাসনে পেশাদারিত্ব ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে দ্রুত সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে জোর দেয়া উচিত। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার বিগত সরকারের মতোই মাথাভারী প্রশাসন (যেখানে শীর্ষ পর্যায়ে অতিরিক্ত জনবল আর নিচের দিকের পদগুলোয় লোকবল ঘাটতি), পুরনো আমলাদের ওপর নির্ভরতা, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের আধিক্য ও সুপারিশের ভিত্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। এতে বিশৃঙ্খলা আরো বাড়ছে, কাজেও এক ধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে।

 

 

এমন পরিস্থিতিতেও জনপ্রশাসন সংস্কারের কাজে মনোযোগ না থাকা হতাশাজনক। জনপ্রশাসনের কার্যকারিতা শুধু রাষ্ট্রের ভিতকে মজবুত করে না, বরং নাগরিকদের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতাও নিশ্চিত করে। একটি দলীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত, পক্ষপাতদুষ্ট প্রশাসন কখনই জনগণের সেবা নিশ্চিত করতে পারে না, যা বিগত সরকারের শাসনামলে দেখা গেছে। তাই জনপ্রশাসন সংস্কার কেবল প্রশাসনিক কাঠামো সংস্কারের বিষয় নয়, এটি গণতন্ত্র ও সুশাসনের ভিতকেও মুজবুত করবে। গণতান্ত্রিক ধারার পুনরুদ্ধার ও সুশাসনের প্রতিশ্রুতিতে যে সরকার দায়িত্ব নিয়েছে সে সরকারের কাছে প্রত্যাশা, সংস্কার প্রক্রিয়ায় বিলম্ব না করে অন্তত স্বল্পমেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। ঐকমত্যের নামে সংস্কার আটকে রাখা যাবে না। জনপ্রশাসনের মতো জায়গায় যাচাই-বাছাই করে নিয়োগ দেয়া হবে, পদায়ন করা ও ভারসাম্য বজায় রাখা হবে—সেটিই কাম্য। সরকারকে এদিকে মনোযোগ দিতে হবে। জনপ্রশাসনের কার্যক্রমে গতি ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট থাকা প্রয়োজন।

 

 

 

যদিও জানা গেছে, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন নির্ভর করছে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ওপর। অর্থাৎ এ কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে একটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পর সংস্কার কার্যক্রম শুরু হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। সরকারের এ ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। রাজনৈতিক দলগুলো বরাবরই চাইবে জনপ্রশাসনকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে। সরকারের নিশ্চিত করতে হবে জনপ্রশাসন যেন দলীয়করণের বাইরে থাকে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে সরকার রাজনৈতিক দল বা সংশ্লিষ্টদের মতামত সংগ্রহ করছে, সেটি ইতিবাচক উদ্যোগ বটে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, যেসব কার্যক্রমে তারা একমত হবেন না, সেসব ক্ষেত্রে সংস্কার কি হবে না? এতে আবারো জনপ্রশাসন কি রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার বা দলীয়করণের শিকার হবে কিনা বা রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে জনপ্রশাসন সংস্কারের কার্যক্রম ঝুলে থাকবে? যদিও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভাষ্য, সংস্কার কমিশনগুলো যে প্রস্তাব করেছে তার মধ্য থেকে যেগুলো (১৬৬টি সংস্কার প্রস্তাব) নিয়ে আলাপ-আলোচনা করা দরকার সেগুলো রাজনৈতিক দলের কাছে উপস্থাপন করা ঐকমত্য কমিশনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

 

 

এর বাইরে বাকি সংস্কারগুলো সরকার চাইলে বাস্তবায়ন করতে পারে। এ জায়গা থেকে বলা যায়, সরকারের আন্তরিকতার ঘাটতিও প্রতিফলিত হচ্ছে জনপ্রশাসন সংস্কারে। অথচ রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগে সর্বাগ্রে থাকা উচিত জনপ্রশাসন সংস্কার। সংস্কার কমিশনের ইতিবাচক সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে প্রশাসনিক কার্যক্রমে জবাবদিহিতা, দক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতে সহায়ক হতে পারে, যা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য। এছাড়া বিশ্লেষকরাও বলে আসছেন, যেসব সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সংবেদনশীল নয়, তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার একদিকে যেমন প্রশাসনের দক্ষতা বাড়াতে পারবে, অন্যদিকে জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারবে। অথচ এ সহজ পথ বেছে না নিয়ে সরকার কালবিলম্ব করছে, যা কাম্য নয়।