জনসংখ্যার চাপে বাড়ছে খাদ্যের চাহিদা
ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম । সূত্র : জনসংখ্যা, ০৬ মার্চ ২০২৫

প্রথমেই বলে নেই, খাদ্যের উৎপাদন, চাহিদা ও কৃষিজমি নিয়ে নানা ধরনের বিভ্রান্তি রয়েছে। সরকারের কৃষি বিভাগ, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৪ এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মত, একটির সঙ্গে অপরটির মিল নেই। দেশে দানাদার (চাল ও গম) খাদ্য সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। বাড়ছে জনসংখ্যা, কমছে আবাদি জমি। যার ফলে খাদ্য আমদানি নির্ভরতা বাড়ছেই। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রায় ৫০ লাখ টন খাদ্য আমদানি করা হয়, যার মধ্যে বেসরকারিভাবে আমদানি হয়েছে প্রায় ৪০ লাখ টন। সরকারিভাবে আমদানি করা হয়েছিল (চাল ও গম) ২২ লাখ টন।-সূত্র খাদ্য অধিদপ্তরের। অপরদিকে উৎপাদন দেখানো হয় ৫ কোটি ১৩ লাখ ৪৫ হাজার টন, যার মধ্যে চালের পরিমাণ ৪ কোটি ৩৪ লাখ ২২ হাজার টন। -সূত্র : কৃষি বিভাগ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, দেশে মাথাপিছু দৈনিক চাল গ্রহণের পরিমাণ ৩২৮ দশমিক ৯ গ্রাম হয়েছে। শহরাঞ্চলে মাথাপিছু চাল গ্রহণের পরিমাণ ২৮৪ দশমিক ৭ গ্রাম, যা জাতীয় গড় থেকে ১৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ কম। ১৭ কোটি মানুষের প্রতিদিনের হিসাব ধরে বছরে প্রয়োজন হয় প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ টন চাল। তবে বর্তমানে জনসংখ্যা কত?- এই প্রশ্নের কোনো উত্তর কারও কাছে নেই। কারণ, বিবিএস ইতোপূর্বে নানা ধরনের তথ্য দিয়েছে। ২০২৪ সালে বলেছিল বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪০ লাখ। পরে বলেছে একই বছরে ১৭ কোটির ওপরে। ধারণা করা হচ্ছে যে, বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি।
২০২৪ সালের মার্চ মাসে কৃষি বিভাগ জানিয়ে ছিল, বাংলাদেশে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ কোটি ৭৭ লাখ টন। এর বিপরীতে চালের উৎপাদন ছিল ৪ কোটি ১৩ লাখ টন। কৃষি বিভাগ বলছে, এভাবে ২০১৮ সাল থেকেই বাংলাদেশে চাহিদার চেয়ে বেশি পরিমাণ চাল উৎপাদন হচ্ছে। ২০২৪ বছরে উৎপাদনের এই ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়েছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) পলিসি গবেষণার প্রজেকশন অনুযায়ী, ২০৩০ সালে বাংলাদেশে ৪ কোটি ৬৯ লাখ টন, ২০৪১ সালে ৫ কোটি ৪১ লাখ টন এবং ২০৫০ সালে ৬ কোটি ৯ লাখ টন চালের প্রয়োজন হবে। ব্রির মহাপরিচালক ড. শাহজাহান কবীর এক তথ্যে দেখিয়েছেন, ২০৩০ সালে ৪২ লাখ টন, ২০৪০ সালে ৫৩ লাখ টন এবং ২০৫০ সালে ৬৫ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। এই বাড়তি উৎপাদন আমাদের যে কোনো ঝুঁকি মোকাবিলায় বাফার স্টক হিসেবে কাজ করবে। তিনি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য উল্লেখ করে বলেন, দেশে মাথাপিছু দৈনিক চাল গ্রহণের পরিমাণ ৩২৮ দশমিক ৯ গ্রাম হয়েছে। শহরাঞ্চলে মাথাপিছু চাল গ্রহণের পরিমাণ ২৮৪ দশমিক ৭ গ্রাম, যা জাতীয় গড় থেকে ১৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ কম। ১৭ কোটির মানুষের প্রতিদিনের হিসাব ধরে বছরে প্রয়োজন হয় প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ টন চাল। শুধু ভাত হিসেবে এ চাল মানুষ গ্রহণ করে। এর বাইরে বিভিন্ন পোল্ট্রি ফিড, বীজসহ অন্যান্য প্রয়োজনে চাল ব্যবহার হয় ১ কোটি টন। সবমিলিয়ে প্রয়োজন ৩ কোটি ৬০ লাখ টন। কিন্তু গত ২০২৪ উৎপাদন হয়েছে ৪ কোটি ১৩ লাখ টন।
এদিকে ব্রির কর্মকর্তারা বলেছেন, ব্রি ইতোমধ্যে রাইস ভিশন ২০৫০ প্রণয়ন করেছে। যাতে ২০৩০, ২০৪১ এবং ২০৫০ সালে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বিপরীতে চালের উৎপাদন প্রক্ষেপণ করা হয়েছে এবং তা অর্জনে ব্রি স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। ২০৩০ সালের মধ্যে উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করার লক্ষ্যে কৌশলপত্র প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রায় দ্বিগুণের বেশি হারে ধান উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। যা নিশ্চিত করে যে আমরা খাদ্যে উদ্বৃত্ত।
গম আমাদের দেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য। মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের ফলে গমের বহুবিধ ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। তবে চাহিদা বাড়লেও সে অনুপাতে এর উৎপাদন বাড়েনি। দেশে উৎপাদন কম হওয়ায় চাহিদার প্রায় পুরোটাই পূরণ করতে হয় আমদানির মাধ্যমে। দেশে বর্তমানে গমের চাহিদা ৫০ লাখ ৪৫ হাজার টন। এই চাহিদার বিপরীতে দেশে উৎপাদন হয়েছে মাত্র ১১ লাখ ৭০ হাজার টন। বাকিটা আমদানি করতে হচ্ছে- (সূত্র: খাদ্য অধিদপ্তর)।
২০২২ সালের ২৮ জুলাই ওই বছরের জনশুমারির প্রকাশিত এক প্রতিবেদন সূত্রে বিবিসি বাংলা জানায়, দেশে জন্মহার কমেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৩০ বছর ধরে বাংলাদেশে জন্মহার ধারাবাহিকভাবে কমছে। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের জন্মহার ছিল ২ দশমিক ১৭ শতাংশ, যেটি ২০০১ সালে নেমে আসে এক দশমিক ৫৮ শতাংশে। এরপর ২০১১ সালে আদমশুমারির প্রতিবেদনে দেখা যায়, জন্মহার আরও কমে ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ হয়েছে। সর্বশেষ, ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই হার ১ দশমিক ২২ শতাংশ। জন্মহার কমলেও বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যা অনেকটাই বেড়েছে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বিবিসি বাংলা বলেছে, জন্মহার কমলেও ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে ২০ কোটি ৪০ লাখ। ২০৫৭ সালে জনসংখ্যা হবে ২০ কোটি ৭০ লাখ। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনেও ২০২৩ সালের দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ২৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩১৯ জন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
গত ২০২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি বলা হলেও জাতিসংঘের প্রক্ষেপণ মডেল অনুযায়ী এই সংখ্যা আরও বেশি। জাতিসংঘের প্রক্ষেপণ মডেল অনুযায়ী, বাংলাদেশে মধ্যম মেয়াদি প্রক্ষেপণ ধরা হয় এবং সে অনুযায়ী, এখন থেকে ২৭ বছর পর ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে ২০ কোটি ৪০ লাখ। বর্তমানে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে তা আরও ৩৪ বছর অব্যাহত থাকবে। ২০৫৭ সালে জনসংখ্যা হবে ২০ কোটি ৭০ লাখ। আবার কথিত ‘বিশ্ব জরিপ সংস্থা’র বিবৃতি সূত্রে সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে, ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি বলে ঘোষণা দেয়। এই ১ কোটি কিভাবে হলো, কি করে হলো, আওয়ামী লীগ সরকারই জানে।
দিন দিন দেশের কৃষিজমি চলে যাচ্ছে অকৃষি খাতে। যেসব কারণে কৃষিজমি অন্য খাতে চলে যাচ্ছে, এর মধ্যে রয়েছে নতুন বসতভিটা স্থাপন, অবকাঠামো নির্মাণ, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে পেশার পরিবর্তন, মানবসৃষ্ট কারণে নদীভাঙন, রাস্তাঘাট ও ইটভাঁটি নির্মাণ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্প-কারখানা স্থাপন, উপকূলে লবণাক্ততা এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কৃষিশুমারির তথ্য মতে, গত এক দশকে গড়ে প্রতিবছর কৃষিজমি কমছে শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ। দেশের কৃষিজমি যেমন অন্য খাতে যাচ্ছে, কৃষির ওপর নির্ভরশীল পরিবারও বাড়ছে। এতে জনপ্রতি কৃষিজমির প্রাপ্যতা কমছে। দেশের একজন মানুষের এখন কৃষিজমি মাত্র ১০ শতাংশ, যদিও দেশের ৫৩ শতাংশ পরিবার এখন কৃষিনির্ভর। গত এক দশকে কৃষিনির্ভর পরিবার থেকে জমি কমে গেছে প্রায় পাঁচ লাখ ৩০ হাজার একর।
বাংলাদেশের প্রকৃত জনসংখ্যা, খাদ্যের চাহিদা ও আবাদি জমি নিয়ে সঠিক জরিপ করা প্রয়োজন। কারণ, যতই দিন যাচ্ছে, ততই খাদ্যের সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে, বাড়ছে খাদ্যের চাহিদা আর সেই সঙ্গে দাম তো বাড়ছেই। কাজেই খাদ্য উৎপাদন, চাহিদা ও জনসংখ্যার মধ্যে সমন্বয় আনতে হবে। তা নাহলে অদূর ভবিষতে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করতে পারে।
লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন