জুলাই ২০২৪ স্বপ্নের কী পরিণতি হবে?
লে. জেনা, (অব.) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান, পিএইচডি [সূত্র : ইত্তেফাক, ৩ জুলাই ২০২৫]

'নি ও প্যাট্রিমনিয়ালিজম' রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একটি শাসনব্যবস্থা, যা গণতন্ত্রকে অসৎভাবে নিয়ন্ত্রণ করে একটি গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক দল দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকে। সেই ক্ষমতায় থাকার জন্য তারা খদ্দেরকদী রাজনীতির (Clicntist Politics) আশ্রয় নেয় তাদের দলের লোক বা অনুগতদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বসিয়ে শাসনব্যবস্থা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে একদিকে যেমন প্রতিষ্ঠানগুলি মেধাশূন্য করে, অন্যদিকে সেগুলি ধ্বংস করে ফেলে। এসবের একটাই উদ্দেশ্য ক্ষমতা ধরে রাখা। আফ্রিকাতে একটা গবেষণাতে দেখা গেছে সেখানে 'নিও প্যাট্রিমনিয়াল' শাসনব্যবস্থার জীবন গড়ে ২৫-৩৫ বছর। এরপর সেখানে একটা রেভুল্যুশন হয়। তবে সেই রিভল্যুশনারি সরকার মানুষের আশা-আকাঙ্কা দলীয় আদলে গড়া প্রতিষ্ঠানগুলি সেই সরকারকে সহায়তা করতে ব্যর্থ হয়। নতুন সরকার শুধু পূর্বের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়াকে প্রধান এজেন্ডা হিসেবে দেশ চালাতে চেষ্টা করে।
এরকম একটা পরিস্থিতিতে মানুষ আবার অতিষ্ঠ হয়ে যায়। ফলে রিডুল্যুশনারি সরকারকে দুই/তিন বছরের মধ্যে বিদায় নিতে হয়। এরপর গণতান্ত্রিকভাবে মোটামুটি একটা নির্বাচন হয়। আর একটা নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে। তবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের সব প্রতিষ্ঠানগুলি দুর্বল ও অকার্যকর হওয়ার কারণে (Checks and Balance-এর অভাবে) নির্বাচিত দলটি পর্যায়ক্রমে Clientist Politics, ভিন্নমতকে দমন, প্রতিষ্ঠানগুলিকে আবার নিয়ন্ত্রণে নেওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে পুনরায় নিও প্যাট্রিমনিয়ালিজমের দিকে ধাবিত হয়। মোটাদাগে ফরমেট এটাই, তবে সব জায়গাতে হুবহু এভাবেই যে হবে, সেটা না-ও হতে পারে। আপাতত আমি পাঠকদের নিও প্যাট্রিমনিয়ালিজমের ফরমেটটা মনে রাখার জন্য বলছি, যাতে বাংলাদেশের পরিস্থিতির সঙ্গে মেলাতে সুবিধা হয়।
কোনো রিভল্যুশান সফল হয় না, যদি তাদের সঙ্গে সরকারের কোনো না কোনো এক বা একাধিক প্রতিষ্ঠান প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যোগদান না করে। এ বিষয়ে 'আরব বসন্তের (Arab Spring) উদাহরণ দেখা যাক। তিউনিশিয়াতে সবমি সবজি বিক্রেতা বুয়া আজিজি নিজের গায়ে আগুন জ্বালিয়ে আত্মহত্যার মাধ্যমে আরব বসন্তের সূচনা করে। যা প্রেসিডেন্ট কেন আলিকে ২৩ বছর পর ক্ষমতা ছেড়ে যেতে বাধ্য করে। আন্দোলন দমনে কেন আলি রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান নিয়োজিত করে কিন্তু সেনাবাহিনী প্রধান আমর রশিদ জনগণের ওপর গুলি চালাতে অপারগতা প্রকাশ করে। ফলে জনগণ সেনাদের মৌন সমর্থন পেয়ে অন্দোলন আরো বেগবান করে, যাতে করে কেন আলি দেশ ছেড়ে সৌদি আরব পালিয়ে যায়। একইভাবে মিশরে তাহিরী স্কয়ারের আন্দোলন হোসনী মোবারকের ৩০ বছরের শাসনের অবসান ঘটতে পারত না, যদি না সশস্ত্র বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডের প্রধান ফিল্ড মার্শপ হোসেন তানতউই তাহিরী স্কয়ারে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালতে অস্বীকার না করত। অর্থাৎ রুলিং এলিটদের মধ্যে ভাঙন না হলে 'নিও প্যাট্রিমনিয়াল বা ফ্যাসিবাদী বা একনায়ক বা রাজা। আমির'দের উৎখাত করা যায় না। অবশ্য লিবিয়ার ক্ষেত্রে এলিটদের মধ্যে ভাঙন ধরিয়েছিল ন্যাটের সরাসরি আক্রমণ, যা লিবিয়ায় গাদ্দাফির অনুগত বাহিনীকে মিলিশিয়াদের বিপক্ষে ধরাশায়ী করে দেন্ড, অর্থাৎ এলিটদের মধ্যে বহিঃশক্তি দ্বারা ভাঙন ধরানো হয়।
পক্ষান্তরে, বাহরাইন বা সৌদি আরবে রুলিং এলিটদের মধ্যে আন্দোলন ভাঙন ধরাতে ব্যর্থ হয়, সুতরাং বাহরাইনে আন্দোলন বেগবান হলেও সরকার তা শক্ত হাতে দমন করতে সমর্থ
জুলাই ২০২৪ স্বপ্নের কী পরিণতি হবে?
দুবছর সময় ছিল রাজনৈতিক দল ও দেশের প্রতিষ্ঠানগুলির সংস্কারের কিন্তু মাইনাস-প্লাসের চক্করে আবার জাতি লক্ষচ্যুত হলো। তবে উত্তম সুযোগ এসেছিল ২০০৯ সালে স্বপ্নপূরণের। সেই স্বপ্ন সবচে বড় দুঃস্বপ্নে রূপান্তরিত হয়। শেখ হাসিনা ১৬ বছর ক্ষমতায় ছিলেন, লিকোয়ান ইউ হতে পারতেন। পরিশেষে, জুলাই ২০২৪ সাল আর একটা সুযোগ এনে দিয়েছে। জাতীয় জীবনে এভাবে সুযোগ বার বার আসে না, সেদিক থেকে আমরা জাতি হিসেবে ভাগ্যবান যে, প্রকৃতি আমাদের ঠিক হওয়ার জন্য বার বার সুযোগ দিচ্ছে আর সেগুলিকে আমরা আক্ষেপে রূপান্তর করছি হয়। অন্যদিকে সিরিয়াতে বহিঃশক্তির মদদে সিয়া-সুন্নি 'ফন্ট লাইনে' বিভক্তি ঘটালেও সশস্ত্র বাহিনীর ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বড় একটা অংশ বাশার আল আসাদের পক্ষে থেকে যায়, ফলে সেখানে গৃহযুদ্ধ (Civil War) রূপ নেয় বিন্তু কশার আল আসাদকে তখন ক্ষমতাচ্যুত কর। যায়নি।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শুরু থেকে জুলাই ২০২৪ অভ্যুত্থানে স্পোকাহিনীর সিংহভাগ জনগণের ওপর কঠোর হওয়ার বিপক্ষে ছিল। সেনাবাহিনী প্রজার পরিচয় দিয়ে বাহিনীর Sentiment এবং জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়ে, জনগণের চাওয়া-প'ওয়ার প্রতি সম্মান জানিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করার পাশাপাশি তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রকৃত পক্ষে সেনবাহিনী বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা নীতি অনুযায়ী তাদের দায়িত্ব পালন করেছে, যেখানে
জনগণের নিরাপত্তা বিধানের নির্দেশনা আছে। দেখা যাক আরব বসন্তের আন্দোলনের দেশগুলোর বর্তমান অবস্থা।
মিশর: আন্দোলনের পর সেখানে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়। প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মেরসির নেতৃত্বে ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতায় আসে। ফ্রিডম ও জাস্টিস পার্টি নতুন ছিল তাদের দেশ পরিচালনা ক রাজনীতি পরিচালনার অভিজ্ঞতার অভাব ছিল। মানুষের কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, স্থিতিশীলতা আনয়নে ব্যর্থ হয়। তারা যেটা ভালো পারত, সেদিকে জের দেয় অর্থাৎ ইসলামি দেশে ড্রেস কোড কেমন হবে, নারীদের অবস্থান রাষ্ট্রীয় জীবনে কেমন হবে, শরিয়া আইন প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার অভাবে গাজাতে ফিলিস্তিনিদের (হামাসের) সহায়তা শুরু করে, যা ইজরাইল ও আমেরিকাকে হতাশ করে অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলির আমির/রাজাগণ মুসলিম ব্রাদারহুডকে তাদের জন্য হুমকি মনে করতে থাকে। মোটকথা তারা দেশের মানুষের স্বপ্নপূরণে ব্যর্থ হয় ও ভূরাজনীতি ম্যানেজ করতেও ভুল করে। ফলে মাত্র এক বছরের মাথায় মানুষ সেনাপ্রধান আল-সিসি ক্ষমতা দখল করে নেন।
মিশর এখন আবার সেই সৈরশাসনের অধিনে গত একযুগ ধরে আছে। এ যেন দ্বিতীয় হোসনী মোবারকের আগমন ঘটেছে।
অন্যদিকে সবছি ভেবেছিল তিউনিশিয়া হয়তো আরব বসন্ত তথা গণতন্ত্রের একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে চলেছে। ২০১১ সাল থেকে একনায়কতন্ত্রের অবসান হলেও তিউনিশিয়া তাদের রাজনৈতিক, আর্থিক, সামাজিক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানকে সঠিকভাবে শক্তিশালী করতে ব্যর্থ হয়েছে ধীরে ধীরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বর্তমান রাষ্ট্রপতি কায়েস সাঈদ (২০১৯ সাল থেকে ক্ষমতায় আছেন) রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি করে জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ও প্রধানমন্ত্রীকে উৎখাত করেছেন। বিচারব্যবস্থা করায়ও ও রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনপীড়ন করে চলেছেন। সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর থেকে তিনি Presidential Decree-এর দ্বারা দেশ পরিচালনা করছেন। শাসনতন্ত্রে পরিবর্তন এনেছেন। ২০২৪ সালে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতায় এসেছেন। তিউনিশিয়াতে ২০১১ সালে আরব বসন্তের পর সাত/আট বছরে শাসনব্যবস্থার যে Checks and Balance সৃষ্টি করা হয়েছিল, কায়েস সাঈদ ২০১৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর পর তা সর্বল বা ধ্বংস করেছেন। আমার ধারণা সেখানে সামাজিক ও গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলি শক্তিশালীভাবে গড়ে ওঠার আগেই কায়েস সাঈদ সেগুলিকে অকার্যকর করার সুযোগ নিয়েছে, অন্যদিকে ডিউনিশিয়াতে Credible Civil Society গড়ে ওঠেনি, যার কারণে কায়েস
সাঈদ, কেন আলির পথে হাঁটার সুযোগ পেয়েছে। ফ্যাসিস্ট চলে যাওয়া মানে দেশ ঠিক হয়ে যাবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই, সেটা আমরা সবাই অনুধাবন করছি। মোদনী মোবারক চলে যাওয়ার পর মিশর মনে করেছিল দেশে জনগণের শাসন এসে গেছে। সে চিন্তায় ছাই
পড়েছে। বাংলাদেশের কী হবে?
মিলিটারি একাডেমিক হিসাবে আমরা শুধু বিশ্লেষণ করি, প্রস্তাবনা বা ভবিষ্যদ্বাণী করি না। সেই আঙ্গিকে বাংলাদেশ কেস একটা চমৎকার গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে। প্রথমে দেখা
যাক, আমরা জাতীয় জীবনে কতবার সুযোগ হারিয়েছি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা স্বাধীন দেশ পেলাম। নিজেদের দেশকে নিজেদের মতো করে গড়ে তোলার সুযোগ এলো। '৭২ সালে সেই সময়ে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান দেশের ক্ষমতা নিলেন, তবে অল্প সময়ের মধ্যে গণতন্ত্র হারিয়ে স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন হয়ে গেল। এরপর ১৯৭৫ সাল এলো, ক্ষমতা পালটানো হলো কিন্তু দুঃস্বপ্ন যেন যায় না। এরশাদ ক্ষমতায় নয় বছর ছিলেন, মাহাথির হতে পারতেন। কিন্তু অন্য পথে হাঁটলেন। ১৯৯১ সংল স্বৈরাচারী এরশাদ পতনের পর দেশবাসী আর এক বার স্বপ্ন দেখল গণতন্ত্র, সুশাসন, সামাজিক নিরপ্রেক্ষতা ও নিরাপত্তর। এরপর পঁচ বছরের পালা বদলের রিলে রেস শুরু হয় অর মেশ দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নে রেকর্ড করতে থাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে ভোটে সরকার পরিবর্তন হয় কিন্তু খদ্দেরবাদী রাজনীতি (Chentist Politics) জারি থাকে।
এভাবে আর একবার সুযোগ আসে ১/১১ মাধ্যমে ২০০৭-এ দুবছর সময় ছিল রাজনৈতিক দল ও দেশের প্রতিষ্ঠানগুলির সংস্কারের বিন্তু মাইনাস-প্লাসের চক্করে আবার জাতি লক্ষচ্যুত হলো। তবে উত্তম সুযোগ এসেছিল ২০০৯ সালে স্বপ্নপূরণের। সেই স্বপ্ন সবচে বড় দুঃস্বপ্নে রূপান্তরিত হয় শেখ হাসিনা ১৬ বছর ক্ষমতায় ছিলেন, লিকোয়ান ইউ হতে পারতেন। পরিশেষে, জুলই ২০২৪ সাল আর একটা সুযোগ এনে দিয়েছে জাতীয় জীবনে এভাবে সুযোগ বার বার আসে না, সেদিক থেকে আমরা জাতি হিসেবে ভাগ্যবান যে, প্রকৃতি আমাদের ঠিক হওয়ার জন্য বার বার সুযোগ দিচ্ছে আর সেগুলিকে আমরা আক্ষেপে রূপান্তর করছি।
পরিতাপের বিষয়, সংস্কারের চেয়ে নির্বাচনের প্রতি আমাদের অগ্রহ বেশি। প্রতিষ্ঠানগুলি ঠিক কর'র চেয়ে ক্ষমতার আগ্রহ বেশি। এসবের কারণ হলো আমাদের জাতীয় জীবনে ব্যক্তির স্বর্থ গোষ্ঠী/দলের চেয়ে বড়। আর গোষ্ঠী/দলের স্বার্থ দেশের চেয়ে বড়।
আমরা যেভাবে চলছি এতে করে সুযোগ হারানোর ওস্তাদ জাতি হিসেবে আমরা বর্তমান সুযোগটাও হাতছাড়া করব। আমার মনে হচ্ছে, আমাদের জন্য Worst Case Scenario, মিশর আর Best Case Scenario তিউনিশিয়া। তবে বংলাদেশ সামরিক বাহিনীর ক্ষমতার প্রতি অনাগ্রহ (Distaste for Power) মিশর ও তিউনিশিয়া মিলিয়ে একটা হাইব্রিড/ সংমিশ্রণ হতে পারে। পরিশেষে আমি প্রার্থনা করছি, আমার বিশ্লেষণ যেন ভুল হয়। জুলাই ২৪-এর আহত ও শহিদের প্রতি সম্মান জানিয়ে এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ন্যূনতম সিংগাপুর হওয়ার পথে
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা