কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

জুলাই বিপ্লব ও সেকেন্ড রিপাবলিকের ধারণা

শাসনব্যবস্থায় ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় স্বাধীন বিচার বিভাগ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাও নিশ্চিত করতে হবে। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টিও গুরুত্ব দিতে হবে। সর্বোপরি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার তিন মূলনীতি সাম্য, সামাজিক সুবিচার ও মানবিক মর্যাদা কায়েমে দ্বিতীয় রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার নাগরিক অভিপ্রায়কে বাস্তবে রূপদান করতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার তার সীমাবদ্ধতা নিয়ে দ্বিতীয় রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার কাজ কতটুকু করতে পারবে- ড. মিয়া মুহাম্মদ আইয়ুব। সূত্র : নয়া দিগন্ত, ০৮ মার্চ ২০২৫

জুলাই বিপ্লব ও সেকেন্ড রিপাবলিকের ধারণা

রাজধানী ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বিশাল জনসমাবেশ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতাদের উদ্যোগে গঠিত এ দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সমাবেশে নতুন দলের ঘোষণাপত্রে অনেক কথা বলেছেন। তবে এর মধ্যে একটি কথা নিয়ে আজ আলোচনা করতে চাই। তিনি বলেছেন, ‘আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি , জুলাই ২০২৪ গণ-অভ্যুত্থান শুধু একটি ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে বিজয় নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণেরও শপথ। চলুন আমরা এক সাথে হাতে হাত রেখে এমন এক বাংলাদেশ গড়ে তুলি যেখানে প্রতিটি নাগরিকের কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হবে, যেখানে ন্যায় প্রতিষ্ঠা, মানুষের অধিকারের সংগ্রামই হবে রাজনীতির অন্যতম লক্ষ্য।

 

 

যেখানে সাম্য ও মানবিক মর্যাদা হবে রাষ্ট্রের ভিত্তি। এখনই সময় নতুন স্বপ্ন দেখার, নতুন পথ চলার এবং একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার। এই নতুন বাংলাদেশ গড়ায় আমরা সবাই যার যার অবস্থান থেকে শপথ করি। ঐক্যবদ্ধ হই এবং আমাদের কাক্সিক্ষত সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে দৃঢ়চিত্তে এগিয়ে যাই।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে তরুণদের পক্ষ থেকে যখন সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়, তখন তার তাৎপর্য গভীরভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে। সেকেন্ড রিপাবলিক পরিভাষাটি নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। আমরা বিষয়টিকে অ্যাকাডেমিক্যালি বুঝার চেষ্টা করব। ল্যাটিন পরিভাষা ‘রেস পাবলিকা’ থেকে ‘রিপাবলিক’ শব্দটির উদ্ভব হয়েছে। এর শাব্দিক অর্থ ‘জনগণের বিষয়াদি’। রাজনৈতিক অর্থে এটা হচ্ছে সেই রাষ্ট্র যেখানে রাষ্ট্রক্ষমতা থাকে জনগণের কাছে।

 

 

 এর প্রয়োগ ঘটে জনগণের প্রতিনিধির মাধ্যমে। এ ব্যবস্থা হচ্ছে মূলতঃ স্বৈরতন্ত্র বা রাজতন্ত্রের বিপরীত, যেখানে রাষ্ট্রক্ষমতা রাজা বা রানীর হাতে নয়, জনগণের হাতে থাকে। রিপাবলিকের অর্থ থেকে এটা সহজে বোধগম্য যে, এরূপ রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচন হবে। জনপ্রতিনিধিরা রাষ্ট্র শাসন করবেন। কিন্তু বাস্তবে সবক্ষেত্রে তা ঘটেনি। যেমন- ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বে ১৫৯টি রাষ্ট্র রিপাবলিক বলে ঘোষিত হলেও সবদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হয়নি। বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক। একাত্তরে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ এবং নতুন সংবিধান অনুযায়ী ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ বলে ঘোষিত হয়। ইংরেজিতে যার নাম ‘দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’। কিন্তু বিগত পাঁচ দশকে সরকার পরিবর্তন কি সর্বদা জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী তথা সঠিক ভোটের মাধ্যমে হয়েছে? আবার উত্তর কোরিয়ার মতো কট্টর স্বৈরশাসকের দেশও নিজেদের ‘পিপলস রিপাবলিক’ বলে দাবি করে। একদল শাসিত কমিউনিস্ট চীনও নিজেদের রিপাবলিক বলে থাকে।

 

 

 এবারে ইতিহাসের দিকে একটু তাকাই, কারা কখন কীভাবে রিপাবলিক পরিভাষা ব্যবহার করেছে। গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর লিখিত বিখ্যাত গ্রন্থের নাম ছিল ‘রিপাবলিক’ (গ্রিক ভাষায় ‘পলিটিয়া’)। এতে তিনি রাষ্ট্রদর্শন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তার ছাত্র এরিস্টোটল লিখিত ‘পলিটিক্স’ গ্রন্থে বলেছেন, যখন নাগরিকরা বৃহত্তর পরিসরে জনসাধারণের কল্যাণে কাজ করে তাকে সরকার বলা যায়। পরবর্তীতে এ ধরনের সরকারকে ল্যাটিন ভাষায় ‘রিপাবলিক’ বলে আখ্যায়িত করা হতে থাকে। আরো পরে জনগণের সম্মতি বা অভিপ্রায় ঘটে সংবিধানের মাধ্যমে। ফলে সাংবিধানিকভাবে পরিচালিত রাষ্ট্রকে রিপাবলিক বলা হয়ে থাকে। ফরাসি দার্শনিক রুশো ও মন্তেস্কু রিপাবলিক তত্ত্বের প্রশংসা করেছেন। কারো মতে, প্রাচীন গ্রিসের মতো ছোট নগর রাষ্ট্রে শুধু রিপাবলিক যথার্থ অর্থে কার্যকর করা যেতে পারে। প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিককালের রিপাবলিকের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। আধুনিককালে এর বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। আমেরিকা ১৭৭৬ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভের সময় ব্রিটিশ রাজতন্ত্র বা ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন গণতান্ত্রিক রিপাবলিক ঘোষণা করে।

 

 

তাদের কাছে রিপাবলিক ও গণতন্ত্র অনেক সময় সমার্থক ব্যবহৃত হয়। ইংল্যান্ডে ১৬৪১ সালে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়। প্রথম রাজা চার্লসকে হত্যা করা হয়। এ সময় ইংল্যান্ডকে রিপাবলিক ঘোষণা করা হয়। অবশ্য সেটি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। স্বল্পকালের ব্যবধানে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ফরাসি বিপ্লব ছিল ইউরোপ তথা পাশ্চাত্য সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। ১৭৮৯ সাল থেকে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত বিপ্লবকালে ফ্রান্সে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটে। রিপাবলিক প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানে বিপ্লবের সফলতা সাথে সাথে আসেনি; লেগেছিল প্রায় দশ বছর। সেখানে সংস্কার করা হয়; এমনকি রোমান চার্চ সব গোঁড়ামি ত্যাগ করে নিজেদের সংস্কার করতে বাধ্য হয়। এবারে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন ও হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে বাংলার মুসলমানরা পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক নিপীড়ন ও অর্থনৈতিক শোষণে পূর্ব বাংলার জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করে।

 

 

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় জনগণের অভিপ্রায় ছিল সাম্য, সামাজিক সুবিচার ও মানবিক মর্যাদার ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্র গঠন। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে এর সঠিক প্রতিফলন ঘটেছিল। বলা বাহুল্য, আশা করা হয়েছিল, নতুন দেশের জন্য রচিত সংবিধানে জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায় প্রতিফলিত হবে। কিন্তু ১৯৭২ সালের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়, ‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যেসব মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও সব বীর শহীদকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।’ মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত তিন মূলনীতির সাথে সংবিধানের চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির কোনো মিল ছিল না। মূলত প্রতিবেশী ভারতের পরামর্শে এসব করা হয়েছে। এমনকি সংবিধান প্রণয়নের পরে কোনো গণভোটের মাধ্যমে জনগণ থেকে এর অনুমোদন নেয়া হয়নি। ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়া নিয়ে শুরুতে বিতর্ক দেখা দেয়।

 

 

 মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও তার দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন যুক্তি উপস্থাপন করে, গণপরিষদের সংবিধান প্রণয়নের কোনো বৈধতা নেই। কারণ গণপরিষদ সদস্যদের স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সংবিধান প্রণয়নের কোনো ম্যান্ডেট জনগণ দেয়নি। বরং ইয়াহিয়া খানের দেয়া শর্তানুযায়ী ‘লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের’ ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের জন্য সংবিধান প্রণয়নে তারা জনগণের ম্যান্ডেট পেয়েছিলেন। এমনকি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মেনিফেস্টো বা দলটির নির্বাচনী বক্তৃতায় কোথাও স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো ধারণা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জনগণকে দেয়া হয়নি। সুতরাং পাকিস্তানের জন্য নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যরা স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান তৈরির কোনো অধিকার রাখেন না। তারা দাবি করেন, সংবিধান প্রণয়ন ও গণভোটে তা অনুমোদিত হতে হবে। এ সময় মওলানা ভাসানী ছয়টি দলকে একত্রিত করে ‘সর্বদলীয় অ্যাকশন কমিটি’ গঠন করেন।

 

 

 সংবিধান প্রণীত হওয়ার পর ভাসানী বলেন, ‘একটা বাজে গণপরিষদ কর্তৃক জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া সংবিধান বাতিল করে সরকারের ভেতরের ও বাইরের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে নতুন খসড়া সংবিধান তৈরির জন্য সরকারের উদ্যোগ নেয়া উচিত। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এবং কৃষক-শ্রমিক সমাজবাদী দল অভিমত প্রকাশ করে, এ সংবিধানে জাতির আশা-আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হয়নি। বিরোধী দলগুলোর সমালোচনার জবাবে আওয়ামী লীগ দাবি করে, প্রণীত সংবিধান একটি উত্তম সংবিধান এবং গণপরিষদও বৈধ। তাদের মতে, পরাজিত দল নিয়ে সংবিধান প্রণয়নের প্রশ্নই ওঠে না। লক্ষণীয় বিষয় হলো, বিরোধী দলগুলোর আপত্তি ও সমালোচনা ছিল অত্যন্ত দুর্বল। তা মূলত পত্রিকার পাতায় সীমাবদ্ধ ছিল। বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মধ্য থেকে স্বল্প সংখ্যক সাংবিধানিক বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন।

 

 

 রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মুসলিম জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী দলগুলোর অনুপস্থিতিতে সংবিধান সম্পর্কে এদের কোনো অভিমত প্রকাশিত হয়নি। খসড়া সাংবিধানের ওপর জনমত গ্রহণ বা যাচাইয়ের তেমন কোনো সময় ও সুযোগ দেয়া হয়নি। সংবিধান প্রণয়ন কমিটি সংবিধানের ওপর পরামর্শ আহ্বান করেছিল। কিন্তু জনগণ তাতে তেমন সাড়া দেয়নি। কমিটি জনমত যাচাইয়ে কোনো প্রশ্নমালা জারি করেনি। সময় দিয়েছিল মাত্র তিন সপ্তাহ। আবার গণপরিষদে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যদেরও সংবিধানের ওপর আলোচনার তেমন সুযোগ দেয়া হয়নি। মোট ৪০৪ সদস্যের মধ্যে ১৭৫ জন আলোচনার জন্য নাম দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ৪৮ জনকে সুযোগ দেয়া হয়। এদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ ছিলেন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য। ৪৫ জনই আওয়ামী লীগের। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, ১৯৭২ সালের সংবিধানে জনআকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে সংবিধান কার্যকর করা হয়। ১৯৭৩ সালে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করা হয়।

 

 

ওই নির্বাচন এতটা বিতর্কিত হয় যে, সেটি নির্বাচনের নামে তামাশা ছাড়া কিছু ছিল না। জনগণ শুরুতে গণতন্ত্র চর্চা নিয়ে আশঙ্কায় পতিত হন। নির্বাচনের পরের বছর দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এতে হাজার হাজার মানুষ না খেয়ে মারা যান। বিরোধী দলগুলোর ওপর নির্যাতনের স্ট্রিম রোলার নেমে আসে। শাসকশ্রেণী রাজনৈতিক বিরোধীদের শায়েস্তা করতে রক্ষীবাহিনী নামে একটি বিশেষ বাহিনীর মাধ্যমে সাড়া দেশে জুলুম অত্যাচার শুরু করে। আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র নেতা শেখ মুজিব ও তার দল অবশেষে গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে অন্য সব দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় বাকশাল গঠন করে। ইসলামী দলগুলোকে শুরুতে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। দেশের জনগণ যে প্রত্যাশা নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন তথা একটি রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা শুরুতে একদল বিশ্বাসঘাতকের হাতে হোঁচট খায়। মানুষ যখন একদলীয় স্বৈরশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে দিশেহারা তখন অকস্মাৎ ঘটে ১৫ আগস্টের বিপ্লব।

 

 

সামরিক বাহিনীর একদল সদস্য শেখ মুজিব ও তার পরিবারের বহু সদস্যকে হত্যা করেন। তারা এক নতুন বাংলাদেশ গঠনের ঘোষণা দেন। মজার বিষয় ছিল, খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা বিপ্লবী সরকার গঠন করেন। কিছু দিনের মধ্যে প্রতি বিপ্লব ঘটানোর প্রচেষ্টা চলে, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। কয়েক মাসের ব্যবধানে ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সৈনিক-জনতার মিলিত আরেকটি অভ্যুত্থানে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান দেশের নেতৃত্বে চলে আসেন। তিনি রাষ্ট্রব্যবস্থায় বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনেন। প্রথমত বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করেন, যার ফলে দেশ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসে। দ্বিতীয়ত সংবিধানকে জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী সংশোধনের উদ্যোগ নেন। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনেন।

 

 

তার এ পরিবর্তনের পক্ষে তিনি গণভোটের আয়োজন করেন। তিনি বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন। সমাজতন্ত্রের উগ্রবাদী নীতি থেকে সরে এসে মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু করেন। রাষ্ট্রের বহুক্ষেত্রে অনেক সংস্কার সাধন করেন। তিনি বিএনপি নামে নতুন একটি দল গঠন করে গণতান্ত্রিক ধারায় নিজেকে যুক্ত করেন। এর মাধ্যমে তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যান। জিয়াউর রহমান দ্বিতীয় রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার কাজটি অনেক এগিয়ে নিয়েছিলেন; কিন্তু শেষ করে যেতে পারেননি। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাকে ১৯৮১ সালে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ফলে জনগণের বিপ্লবী অভিপ্রায় থেমে যায়। এরপরে আসে ৯ বছরের সামরিক শাসন। জনগণ আবার প্রতারিত হন। তবে বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন।

 

 

গণ-অভ্যুত্থানে জেনারেল এরশাদকে বিদায় নিতে হয়। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশ আবার গণতন্ত্রের ধারায় ফিরে আসে। এরপর ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে তিনটি জাতীয় নির্বাচন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। সংসদীয় গণতন্ত্রের একটি আবহ সৃষ্টি হয়। আবার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে দেশকে অস্থিতিশীল করা হয়। নেমে আসে সামরিক বাহিনী সমর্থিত এক-এগারোর একটি মতলববাজি সরকার। এই সরকার দু’বছর এক ধরনের ত্রাস চালিয়ে অবশেষে ভারত ও গণতন্ত্র হত্যাকারী আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাত করে দেশকে তাঁবেদার সরকারের কাছে ছেড়ে দেয়।

 

 

এরপর ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি ফ্যাসিবাদী সরকার দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। এ সময় স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা জনগণের বিরুদ্ধে ভয়াবহ মানবতাবিরোধী ও গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ড করেন; যা বিশ্ববাসীকে হতবাক করে। এই সময়ের একটি চিত্র ফুটে উঠেছে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্কের মন্তব্যে। জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশনের ৫৮তম অধিবেশনে জুলাই-আগস্টে সঙ্ঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনবিষয়ক তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন উত্থাপনের সময় বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি বিগত সরকারের কর্মকর্তা, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য এবং তৎকালীন সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট সহিংস গ্রুপগুলো পদ্ধতিগতভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। এর মধ্যে ছিল শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচার আটক ও গ্রেফতার, নির্যাতন এবং নারী ও শিশুর ওপর সহিংসতা।

 

 

রাজনৈতিক নেতারা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারে এবং নির্দেশনায় বিক্ষোভ দমন করে বিগত সরকারকে ক্ষমতায় রাখার উদ্দেশ্যেই এসব কর্মকাণ্ড চালানো হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় বিক্ষোভকারী ও তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সঙ্ঘটিত হয়েছে।’ একটি সরকার যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে তার নাগরিকদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ করে তখন তাকে আর রিপাবলিক বা জনগণের সরকার বলার সুযোগ থাকে না। জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদনের পরে এ বিষয়ে আর কোনো সাক্ষ্য প্রমাণের দরকার পড়ে না। স্মরণযোগ্য যে, এ প্রতিবেদনে জুলাই-আগস্টের পূর্বে বিগত প্রায় ১৬ বছরে সরকারের সঙ্ঘটিত অপরাধের পুরোচিত্র তুলে ধরা হয়নি। যেমন গুম-খুনের ঘটনা।

 

 

গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রধান বিচারপতি মইনুল ইসলাম বলেছেন, ‘দেশে গত ১৫-১৬ বছরে গুমের প্রতিটি ঘটনা শেখ হাসিনার নির্দেশেই ঘটেছে।’ তিনি জানান যে, গুম কমিশনে আজ পর্যন্ত ১৭৫২টি অভিযোগ জমা পড়েছে। আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছু নৃশংসতার বিষয়টিও কারো নজর এড়ায়নি। যেমন শাপলা চত্বরে আলেমদের ওপর নির্বিচার গুলিবর্ষণ করে হত্যা, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুক্তির দাবিতে আন্দোলনরত কয়েক শ’ লোক হত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে বিরোধীদলীয় নেতাদের হত্যা ইত্যাদি। অন্যদিকে, শেখ হাসিনার সরকার বিচার বিভাগকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। নির্বাচনব্যবস্থাকে নাটক ও প্রহসনের বিষয় বানিয়েছিল। সংবিধানকে ব্যক্তিগত খেয়ালখুশি মতো পরিবর্তন করে দলীয় মেনিফেস্টোতে পরিণত করেছিল। তার শাসনামলে দুর্নীতি এত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল, দেশের অর্থনীতি ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছিল।

 

 

এক কথায় বাংলাদেশ সুশাসনের পরিবর্তে একটি নিষ্ঠুর ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। সুতরাং জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পরে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকে সংস্কার করে একটি গণতান্ত্রিক রিপাবলিক গঠন করা হচ্ছে জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায়। ১৯৭২-৭৫ সময়কালে আওয়ামী দুঃশাসন, ১৯৮২-৯০ সময়কালে সামরিক শাসন, ২০০৯-২০২৪ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদী ও মাফিয়া শাসন আমাদের কাক্সিক্ষত প্রথম রিপাবলিকের প্রত্যাশা চুরমার করে দিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নতুন দল এনসিপি দ্বিতীয় রিপাবলিক গঠনের দাবি জানিয়েছে। দ্বিতীয় রিপাবলিক গঠনের প্রধান লক্ষ্য হবে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে একটি নতুন সংবিধান রচনা করা। সংবিধান সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ সরকারের কাছে দাখিল করেছে। কিন্তু ব্যাপকমাত্রায় সংবিধান সংশোধন করে জোড়াতালি না দিয়ে একটি নতুন সংবিধান রচনা করা প্রয়োজন। সংবিধান সংশোধন করতে সংসদ দরকার, সেটি এখন নেই। নতুন নির্বাচন করে আরেকটি সংসদ গঠিত না হওয়া পর্যন্ত সংবিধান সংশোধন করা যাবে না। নির্বাচনে বিজয়ী দল যে, সংবিধানের কতটুকু পরিবর্তন আনবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

 

 

সুতরাং উত্তম হচ্ছে আগে একটি গণপরিষদ গঠন করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা। তাই নতুন দলের দাবিটি যুক্তিসঙ্গত। এরপরে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার করাও অত্যন্ত জরুরি। জনপ্রশাসন সংস্কার ছাড়া নির্বাচনকালীন আমলাতন্ত্রকে সঠিক দায়িত্ব পালনের উপযোগী করা যাবে না। এখন দরকার একটি ভারসাম্যপূর্ণ নির্বাহী বিভাগ, যেখানে এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার সুযোগ থাকবে না। দরকার সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন যারা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারবে। শাসনব্যবস্থায় ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় স্বাধীন বিচার বিভাগ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাও নিশ্চিত করতে হবে। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টিও গুরুত্ব দিতে হবে। সর্বোপরি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার তিন মূলনীতি সাম্য, সামাজিক সুবিচার ও মানবিক মর্যাদা কায়েমে দ্বিতীয় রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার নাগরিক অভিপ্রায়কে বাস্তবে রূপদান করতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার তার সীমাবদ্ধতা নিয়ে দ্বিতীয় রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার কাজ কতটুকু করতে পারবে?



লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব