জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও নির্বাচনী বিতর্ক
নতুন নতুন বিপ্লব আসবে মানুষ জীবন দেবেন, রক্ত দেবেন- এ সুযোগে নতুন কেউ আসবেন, টানাটানি করবেন মসনদের হাতল ধরে। কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাগ্য রয়ে যাবে সেই তিমিরে। মো: হারুন-অর-রশিদ [সূত্র : নয়াদিগন্ত, ২৩ জুন ২০২৫]

দুনিয়াতে আজ পর্যন্ত যত আন্দোলন বা বিপ্লব হয়েছে তার প্রতিটিরই একেকটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল। উপমহাদেশেও অনেক আন্দোলন হয়েছে। তার মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ছিল সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি। এ আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি এবং স্বাধীনতা অর্জন। এ আন্দোলন কোন একক ব্যক্তি বা দলের ছিল না, বরং বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ অংশ নেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মূলে ছিল শোষণমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং দেশের সম্পদে জনগণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা; ব্রিটিশদের সৃষ্ট বৈষম্য ও সামাজিক অবিচারের অবসান ঘটানো এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। ভিনদেশী সংস্কৃতির পরিবর্তে নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষা করা এবং বিকাশ ঘটানো। নিজেদের ভাগ্য নিজেরা নির্ধারণ করার অধিকার অর্জন করা। জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত করা এবং দেশকে স্বাধীন করতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে উৎসাহিত করা। এ উদ্দেশ্যগুলো অর্জনে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন, বিদ্রোহ ও সংগ্রাম সংগঠিত হয়েছিল। এর মধ্যে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, সিপাহি বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন, ভারত ছাড়ো আন্দোলন উল্লেখযোগ্য।
ফরাসি বিপ্লবের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখতে পাই, সেই আন্দোলনের মূল স্লোগান ছিল- ‘স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব’। ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্সে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটে এবং সেখানে স্থান করে নেয় প্রজাতান্ত্রিক আদর্শ। অভিজাততন্ত্রের পরিবর্তে স্থান করে নেয় নাগরিকতন্ত্র এবং ধর্মতন্ত্র তার সব গোঁড়ামি পরিহার করে নিজেকে পুনর্গঠন করতে বাধ্য হয়। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বৃদ্ধি; শিক্ষিত সমাজ-উদ্ভূত নতুন রাজনৈতিক ধারণা, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, নিয়ন্ত্রণহীন জাতীয় ঋণ, রাজা ষষ্ঠদশ লুইয়ের রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনা সব কিছু বিপ্লবের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সুনির্দিষ্ট কিছু অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক কারণ বিপ্লবের নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। ফরাসি বিপ্লবকে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ইতিহাসের একটি জটিল সন্ধিক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সত্যিকার অর্থে এ বিপ্লবের মাধ্যমে পশ্চিমা সভ্যতা নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্রে উত্তীর্ণ হয়। বৃহত্তর অর্থে ফরাসি বিপ্লব মানব ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
আজকের আলোচনায় এ দু’টি আন্দোলন বা বিপ্লবের কথা কেন উত্থাপন করলাম তা পরিষ্কার করা দরকার। সব বিপ্লব এবং আন্দোলনের মূল ইস্যু হলো পরিবর্তন অথবা মুক্তি। বিগত সাড়ে ১৫ বছরের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর রাজপথের আন্দোলন এবং বিসর্জনের মূলেও ছিল মুক্তির আন্দোলন। এ দিক থেকে দেখলে বলা যায়, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ফরাসি বিপ্লব বা আমাদের জুলাই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটও ছিল বৈষম্যহীম সমাজব্যবস্থা গঠনের লক্ষ্যে এক পরিবর্তিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করা।
রাজনীতির জটিল সমীকরণে বেশির ভাগ স্বপ্ন হারিয়ে যায় নিমিষে। সামনে এসে দাঁড়ায় স্বার্থ আর ভাগাভাগির হিসাব। দুর্নীতি, দখলবাজি আর ক্ষমতার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে আগের মতো। নতুন নতুন বিপ্লব আসবে মানুষ জীবন দেবেন, রক্ত দেবেন- এ সুযোগে নতুন কেউ আসবেন, টানাটানি করবেন মসনদের হাতল ধরে। কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাগ্য রয়ে যাবে সেই তিমিরে। তাহলে পরিবর্তনটা কিভাবে হবে? আজকে সরকারের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তা আর কোনোভাবে বাড়তে দেয়া উচিত হবে না। ফাটল সঙ্কুচিত করতে না পারলে শুধু ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এবং তাদের দোসররা লাভবান হবে না, জুলাই আন্দোলনের চেতনা ম্লান ও ফিকে হয়ে আসবে
শেখ হাসিনা সরকার ২০০৮ সালে একটি ষড়যন্ত্রের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ধ্বংস করে ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী জমানায় মানুষের ভোটের অধিকার, স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার কেড়ে নেয়াসহ রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে তছনছ করে দেয়া হয়েছিল। সমাজে বিভক্তি সৃষ্টির মাধ্যমে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। ভয়ভীতি, গুম, খুন, জেল-জুলুমের মাধ্যমে মানুষকে অসহায় করে ফেলা হয়। দুর্নীতির এক মহারাজ্য তৈরি করেছিল হাসিনা সরকার। পুলিশ আর র্যাব বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়েছিল মানুষ হত্যার মেশিনে। এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া ছিল খুব জরুরি। অবশ্য বিগত সাড়ে ১৫ বছর বিরোধী রাজনৈতিক দল ফ্যাসিবাদী হাসিনার হাত থেকে দেশ মুক্ত করতে রাজপথে থেকে আন্দোলন করেছে। বিপুল রক্ত এবং জীবন দিতে হয়েছে হাসিনাবিরোধীদের। জেল-জুলুম এবং গুমের ঘটনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। দিনকে দিন শেখ হাসিনা আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠছিলেন। এই দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে উদ্ধারে জুলাই আন্দোলন ছিল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যদিও জুলাই আন্দোলন শুরুতে কোটা আন্দোলন ঘিরে সংগঠিত হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের বৈষম্য, নিপীড়ন আর সামাজিক বিভক্তির বিপরীতে দাঁড়িয়ে এ আন্দোলনের গতি বেগবান হয় সব শ্রেণিপেশার মানুষের অংশগ্রহণে।
জুলাই আন্দোলনে ফ্যাসিবাদী জমানার অবসানের পর আন্দোলনের ফল হয়ে দাঁড়ায় সুদূরপ্রসারী। মানুষ মুক্তি চেয়েছিলেন সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নিপীড়নের হাত থেকে। বৈষম্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের লক্ষ্যে তরুণদের মনে যে স্পৃহা জন্ম নিয়েছে; তা থেকে শুরু হয়েছে সংস্কার আন্দোলন। এখন বাংলাদেশে সংস্কার এবং নির্বাচনের বিতর্ক চলছে। কম সংস্কার নাকি বেশি সংস্কার। সংস্কারের আগে নির্বাচন নাকি নির্বাচনের পরে সংস্কার। এ বিতর্কে রাজনৈতিক দলগুলো যেমন অংশ নিয়েছে; তেমনি তরুণদের সমন্বয়ে গঠিত এনসিপি বা জাতীয় নাগরিক পার্টি। নির্মোহ জায়গা থেকে আলোচনা করলে বলতে হয় সংস্কার যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রতিটি সংস্কারের সাথে জনগণের সম্পৃক্ততা থাকা প্রয়োজন।
এখন প্রশ্ন এসে দাঁড়িয়েছে, আজকে যে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে; তা কী জুলাই বিপ্লবের পরে শুরু হয়েছে নাকি এরও আগে। লক্ষণীয়, বিএনপির ৩১ দফা রাষ্ট্র মেরামতের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে। রাষ্ট্র মেরামতের এই ৩১ দফা ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই ঘোষণা করা হয়েছিল।
প্রকৃত বাস্তবতায় বাংলাদেশের জনগণ গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিলেন; পতিত শেখ হাসিনা সরকার বিগত সাড়ে ১৫ বছরে তা ভেঙে চুরমার করে ফেলেছে। সব রাজনৈতিক দল এবং জনগণের অংশগ্রহণে এই রাষ্ট্র মেরামত ও পুনর্গঠন করতে হবে। এ লক্ষ্য পূরণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন।
তবে মনে রাখা আবশ্যক, রাজনৈতিক বিভক্তি সংস্কার, ভোট ও রাষ্ট্র মেরামতের কাজে বাধা তৈরি করতে পারে। এ সুযোগে ফ্যাসিবাদী শক্তি আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভারতের ইন্ধন আরো বেশি বিপজ্জনক করে তুলতে পারে। কাজেই দাবি এবং মতামতের ভিন্নতা থাকলেও রাজনৈতিক ঐক্যে ফাটল ধরানো যাবে না। এখানে মূল্যায়নের জায়গাটা পরিষ্কার থাকলে বিভাজনের জায়গাটা সঙ্কুচিত হয়ে আসবে।
জুলাই আন্দোলন একদিনে সংগঠিত কোনো আন্দোলন নয়। এ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরির পেছনের ইতিহাস ১৭ বছরের। বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির অবদান যেমন বেশি ছিল। ঠিক তেমনিভাবে জামায়াতকেও অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। তেমনিভাবে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অবদানকেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। শেষ সময়ে ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণ শেখ হাসিনার পতনের দিনক্ষণ নির্ধারিত করে দেয়। কাজেই এ আন্দোলনের বিজয় কোনো একক গোষ্ঠীর অর্জিত ফল নয়। মোটা দাগে বলতে গেলে, মানুষের অংশগ্রহণের মূল কারণ ছিল ফ্যাসিবাদ তাড়িয়ে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের জন-অভিপ্রায় বাস্তবায়ন।
স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতনের পর যে নির্ভেজাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন এ দেশের মানুষের মনে দানা বেঁধেছে সেই বাংলাদেশ কী আদৌ গড়া সম্ভব হবে? বাস্তবতা হলো- এটি একটি কষ্টসাধ্য কাজ। কারণ রাজনীতির জটিল সমীকরণে বেশির ভাগ স্বপ্ন হারিয়ে যায় নিমিষে। সামনে এসে দাঁড়ায় স্বার্থ আর ভাগাভাগির হিসাব। দুর্নীতি, দখলবাজি আর ক্ষমতার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে আগের মতো। নতুন নতুন বিপ্লব আসবে মানুষ জীবন দেবেন, রক্ত দেবেনÑ এ সুযোগে নতুন কেউ আসবেন, টানাটানি করবেন মসনদের হাতল ধরে। কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাগ্য রয়ে যাবে সেই তিমিরে। তাহলে পরিবর্তনটা কিভাবে হবে? আজকে সরকারের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তা আর কোনোভাবে বাড়তে দেয়া উচিত হবে না। ফাটল সঙ্কুচিত করতে না পারলে শুধু ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এবং তাদের দোসররা লাভবান হবে না, জুলাই আন্দোলনের চেতনা ম্লান ও ফিকে হয়ে আসবে।
লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট