কানেক্টিভিটি ও টেকসই উন্নয়ন
ড. মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন । সূত্র : দেশ রূপান্তর, ০৭ এপ্রিল ২০২৫

বর্তমান বিশ্বাায়নের (এষড়নধষরুধঃরড়হ) যুগে পৃথিবী ক্রমে একটি আন্তঃসংযুক্ত পরিকাঠামোর দিকে এগিয়ে চলেছে। যেখানে কানেক্টিভিটি বা সংযোগ উন্নয়নের অন্যতম মূল চাবিকাঠি। কানেক্টিভিটি বলতে অবকাঠামো (সড়ক, বন্দর, বিমান চলাচল), ডিজিটাল নেটওয়ার্ক (ইন্টারনেট, টেলিযোগাযোগ) এবং মানব সম্পর্ক (অভিবাসন, সাংস্কৃতিক বিনিময়) উন্নয়নকে বোঝায়। উদাহরণস্বরূপ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য যেমন সমুদ্র ও বিমান চলাচল অপরিহার্য তেমনিভাবে, দ্রুত তথ্য আদান-প্রদানের জন্য ইন্টারনেট ও সংস্কৃতির বিনিময়ের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কানেক্টিভিটি ব্যবস্থা শুধু একটি দেশের ভৌত অবকাঠামোর প্রসার ঘটানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক উন্নয়ন এবং সামগ্রিক মানবকল্যাণে তথা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যগুলো (ঝঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ এড়ধষং-ঝউএং) অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কানেক্টিভিটি যত বিস্তৃত হবে, টেকসই উন্নয়নের সম্ভাবনাও তত বাড়বে। ব্যবসা-বাণিজ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, পরিবহন ব্যবস্থা এবং ডিজিটাল নেটওয়ার্ক এসবই উন্নত কানেক্টিভিটির মাধ্যমে বিশ্বকে আরও কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।
কানেক্টিভিটি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি : কানেক্টিভিটি কোনো জাতির অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে বড় ভূমিকা পালন করে। একে কেন্দ্র করে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে, নতুন বিনিয়োগ আসে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত হয়, ফলে কৃষিপণ্য থেকে শুরু করে শিল্পোৎপাদিত সামগ্রীর বাজারজাত সহজ হয়, যা প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করে। বিশ্বায়নের এ যুগে যদি কোনো দেশ বা অঞ্চল উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে চায়, তাহলে তাকে অবশ্যই উন্নত কানেক্টিভিটি নিশ্চিত করতে হবে। যেসব অঞ্চল যোগাযোগের বিচ্ছিন্নতার কারণে পিছিয়ে আছে, তারা অর্থনৈতিক গতিশীলতায় পিছিয়ে পড়ছে। তাই, কানেক্টিভিটি উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত।
সামাজিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি : উন্নত কানেক্টিভিটি শুধু অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয়, এটি সামাজিক উন্নয়নেও অনন্য ভূমিকা রাখে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পর্যটন ও প্রযুক্তির প্রসারে কানেক্টিভিটি ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কানেক্টিভিটির অভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অনেক মানুষ আধুনিক চিকিৎসাসেবার নাগাল পাচ্ছে না। উন্নত কানেক্টিভিটি এই সমস্যাগুলো সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
আন্তর্জাতিক কানেক্টিভিটির সম্ভাবনা : কানেক্টিভিটি কেবল একটি দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের জন্য নয়, বরং এটি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর জন্যও নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করতে পারে । বাংলাদেশ তার সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে নেপাল, ভুটান এবং অন্যান্য স্থলবেষ্টিত দেশগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট হাব হতে পারে। এ ধরনের আন্তর্জাতিক কানেক্টিভিটি শুধু অর্থনৈতিক লেনদেনই নয়, বরং সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
কানেক্টিভিটি ও টেকসই উন্নয়ন : যেকোনো উন্নয়ন পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সমতা নিশ্চিত করা। কানেক্টিভিটি যদি নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর জন্যই সুবিধা বয়ে আনে, তাহলে সেটি প্রকৃত অর্থে টেকসই উন্নয়ন (ঝঁংঃধরহধনষব ফবাবষড়ঢ়সবহঃ) হবে না। কানেক্টিভিটি সবার জন্য ইকুইটিফুল বেনিফিট বয়ে নিয়ে আসে। এটি কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণি বা গোষ্ঠীর জন্য নয়, বরং সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। অর্থাৎ শক্তিশালী কানেক্টিভিটি বিশ্বকে আরও সংযুক্ত করে, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করে এবং উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। ডিজিটাল নেটওয়ার্ক, পরিবহন ব্যবস্থা, তথ্যপ্রযুক্তি ও কূটনৈতিক সংযোগের মাধ্যমে কানেক্টিভিটি টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
উপসংহার : বিশ্ব আজ প্রযুক্তি ও উন্নত যোগাযোগের যুগে প্রবেশ করেছে। উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে কানেক্টিভিটি একটি অপরিহার্য নিয়ামক। এই সংযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য নতুন দিগন্তের উন্মোচন করতে পারে। কানেক্টিভিটি হলো শক্তি, যা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগানো সম্ভব। এটি বাণিজ্য সম্প্রসারণ, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং সামাজিক সংহতি নিশ্চিত করতে সহায়ক। বৈশি^ক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে প্রতিটি দেশকে কানেক্টিভিটির সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। বিশ্ব যখন আরও সংযুক্ত হয়ে উঠছে, তখন কানেক্টিভিটি শুধু একটি প্রয়োজন নয়, বরং এটি শক্তির প্রতীক। সর্বোপরি, কানেক্টিভিটি এমন একটি হাতিয়ার, যা সঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে, সব শ্রেণির মানুষ সমানভাবে উপকৃত হবে এবং একটি টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি গড়ে উঠবে। পরিশেষে বলা যায়, ভারতের রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের উচিত ড. ইউনূসের মন্তব্যকে ভুল ব্যাখ্যা না করে কানেক্টিভিটিকে কাজে লাগিয়ে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা। আধুনিক বিশ্বে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সহযোগিতা ছাড়া দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন সম্ভব নয় । কানেক্টিভিটি কেবল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিই আনে না, বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ভারতসহ এ অঞ্চলের দেশগুলোর উচিত পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা, যাতে বাণিজ্য, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও পরিবহন খাতে সমৃদ্ধি অর্জন করা যায়। সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করে, পারস্পরিক সংযোগ বৃদ্ধি করলেই একটি শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (ইউএসটিসি)