কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

কাশ্মীরের যত কথা

কাশ্মীর- হিমালয়ের কোলে অবস্থিত এক অতুলনীয় ভূখণ্ড, যাকে অনেকে ‘পৃথিবীর স্বর্গ’ বলে অভিহিত করেন। এ অঞ্চল শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে বিখ্যাত নয়, এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় একটি অতি সংবেদনশীল কেন্দ্রবিন্দুও। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্বের অন্যতম কারণ এই ভূখণ্ড। আজ কাশ্মীর নামটি শুনলেই আমাদের মনে পড়ে রক্তাক্ত ইতিহাস, অশ্রু, দীর্ঘশ্বাস, আর একই সঙ্গে এক অপার সৌন্দর্যপূর্ণ স্বপ্নভূমি। ইন্টারনেট থেকে তথ্য নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন আজহারুল ইসলাম অভি [সূত্র : আমাদের সময়, ১২ মে ২০২৫]

কাশ্মীরের যত কথা

কাশ্মীরের ভৌগোলিক অবস্থান ও অঞ্চল

কাশ্মীরের ভৌগোলিক অবস্থান এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। হিমালয়ের উপত্যকায় বিস্তৃত এই অঞ্চলটি একসময় ‘জম্মু ও কাশ্মীর’ নামে একটি একক রাজ্য ছিল, যার আয়তন ছিল প্রায় ২,২২,২৩৬ বর্গকিলোমিটার। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগের পর থেকে কাশ্মীর এখন তিনটি প্রধান অংশে বিভক্ত-

 

 

ভারত-শাসিত জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ

ভারত-শাসিত জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখের মোট আয়তন প্রায় ৫৫,৫৩৮ বর্গকিমি। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা তুলে নেয়। সেই সঙ্গে রাজ্যটিকে দুটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়Ñ জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ। জম্মু ও কাশ্মীরের রাজধানী হলো শ্রীনগর (গ্রীষ্মকালীন) এবং জম্মু (শীতকালীন)। লাদাখের প্রশাসনিক সদর দপ্তর হলো লেহ। জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চলে হিমালয়ের উপত্যকা ছাড়াও রয়েছে ঘন বনভূমি, নদী, হ্রদ এবং বিশাল চাষাবাদযোগ্য ভূমি। এখানকার জনসংখ্যার প্রায় ৬৮ শতাংশ মুসলিম, ২৮ শতাংশ হিন্দু, বাকিরা শিখ ও বৌদ্ধ। অন্যদিকে লাদাখ একটি শুষ্ক পার্বত্য মরুভূমি অঞ্চল, যেখানে মূলত তিব্বতি বৌদ্ধ এবং শিয়া মুসলমানরা বসবাস করে। এই অঞ্চলটি কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি চীন ও পাকিস্তান উভয়ের সীমানা ঘেঁষে অবস্থিত। কার্গিল যুদ্ধ এবং গালওয়ান উপত্যকার সাম্প্রতিক সংঘর্ষ লাদাখ অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে তুলেছে। সরকার বলছে, বিশেষ মর্যাদা বাতিলের ফলে উন্নয়নের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল এবং পরিবহন ব্যবস্থায় অগ্রগতি হয়েছে। তবে সমালোচকরা বলেন, কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের কারণে গণতান্ত্রিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং কাশ্মীরিদের বিশ্বাসহীনতা বেড়েছে।

 

 

পাকিস্তান-শাসিত আজাদ জম্মু ও কাশ্মীর (AJK)

আজাদ জম্মু ও কাশ্মীর, সংক্ষেপে AJK, পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের একটি অংশ, যার আয়তন প্রায় ১৩,২৯৭ বর্গকিমি। এখানকার রাজধানী মুজাফফরাবাদ। পাকিস্তান একে একটি ‘আধা-স্বায়ত্তশাসিত’ অঞ্চল হিসেবে পরিচালনা করে। এই অঞ্চলে রয়েছে নিজস্ব এক সরকার, আইনসভা ও প্রধানমন্ত্রী। তবে পররাষ্ট্রনীতি, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ অবকাঠামো পুরোপুরি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে। আজাদ কাশ্মীরকে অনেকে ‘মডেল অঞ্চল’ হিসেবে তুলে ধরেন, কারণ এখানে তুলনামূলক কম সংঘর্ষ এবং অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ রয়েছে। তবে বাস্তবে এই অঞ্চলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত এবং পাকিস্তানবিরোধী মতামত দমন করা হয় বলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো অভিযোগ করে। AJK-এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। নিলাম ভ্যালি, রাওয়ালকোট এবং লেওতা দেশের ভ্রমণপিপাসুদের জন্য জনপ্রিয় গন্তব্য। সেখানকার মানুষ সাধারণত পহাড়ি এবং কাশ্মীরিভাষী। তবে AJK এখনও মৌলিক অধিকার এবং উন্নয়ন খাতে অনেকটাই পিছিয়ে। অনেক এলাকাতেই নেই পর্যাপ্ত স্কুল, হাসপাতাল বা রাস্তাঘাট। পাকিস্তান এই অঞ্চলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গণভোটের দাবি জানালেও বাস্তবে এখানে অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রিত ও সীমাবদ্ধ।

 

 

গিলগিট-বালতিস্তান (আগে উত্তরাঞ্চল)

গিলগিট-বালতিস্তান, যাকে আগে উত্তরাঞ্চল এলাকা (Northern Areas) নামে ডাকা হতো, পাকিস্তানের একটি বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল। এর আয়তন প্রায় ৭২,৯৭১ বর্গকিমি, যা কাশ্মীর অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বড়। এখানে রয়েছে হিমালয় ও কারাকোরাম পর্বতমালার বিস্তৃতি এবং বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ K2। এই অঞ্চলটি পাকিস্তানের সংবিধানে সরাসরি যুক্ত নয়, ফলে এখানকার জনগণের সাংবিধানিক অধিকার অনেকটাই অস্পষ্ট। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তান সরকার গিলগিট-বালতিস্তানকে প্রাদেশিক মর্যাদা দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে, যদিও ভারত একে আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘন বলে অভিহিত করে। গিলগিট-বালতিস্তানের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যও উল্লেখযোগ্য। এখানে বালতি, শিনা, বুরুশাসকি, ওয়াখি ও খোয়ার ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর বসবাস। জনসংখ্যা প্রায় ২০ লাখের কাছাকাছি। অঞ্চলটির অর্থনীতি মূলত কৃষি, পশুপালন এবং পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। তবে সবচেয়ে বড় উন্নয়ন ঘটেছে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (CPEC) প্রকল্পের মাধ্যমে, যার একটি প্রধান অংশ এ অঞ্চল দিয়েই গেছে। এখানে রাজনৈতিক অধিকার ও প্রতিনিধি নির্বাচনে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বহুবার এ অঞ্চলে গণতান্ত্রিক ঘাটতির কথা বলেছে। গিলগিট-বালতিস্তানের জনগণ তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও সম্পূর্ণ অধিকার পেতে বহু বছর ধরে আন্দোলন করে আসছে।

 

 

এর বাইরে চীন ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে ‘শাকসগাম ভ্যালি’ নামে একটি অঞ্চল গ্রহণ করে এবং ১৯৬২ সালে ভারতের কাছ থেকে আকসাই চিন দখল করে নেয়।

 

 

যেভাবে বিভক্ত হলো কাশ্মীর

কাশ্মীরের ইতিহাস বহু শতাব্দী পুরনো। প্রাচীনকাল থেকে এটি হিন্দু, বৌদ্ধ এবং পরে ইসলামি সংস্কৃতির এক মিলনস্থল ছিল। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর কাশ্মীর সম্পর্কে বলেছিলেন- ‘যদি পৃথিবীতে কোথাও স্বর্গ থেকে থাকে, তা কাশ্মীরেই আছে, কাশ্মীরেই আছে, কাশ্মীরেই আছে।’

 

১৮৪৬ সালে ব্রিটিশরা কাশ্মীর রাজ্যটি ডোগরা রাজবংশের হরি সিংহের কাছে বিক্রি করে দেয় ‘অমৃতসর চুক্তি’ অনুযায়ী। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ রাজত্বের অবসানে কাশ্মীর ছিল একটি স্বাধীন দেশীয় রাজ্য।

 

মহারাজা হরি সিং পাকিস্তান কিংবা ভারতের সঙ্গে যোগ না দিয়ে স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান সমর্থিত উপজাতীয় বাহিনীর হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে তিনি ভারতের সহায়তা চান। এর বদলে ভারত তাকে ‘ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশনে (Instrument of Accession)’ স্বাক্ষরের শর্ত দেয়, যার মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীর আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের অংশ হয়ে যায়। এই ঘটনাই কাশ্মীর সমস্যার সূচনাবিন্দু।

 

 

যুদ্ধ ও বিভাজন

কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তান তিনটি বড় যুদ্ধ করেছে- ১৯৪৭, ১৯৬৫ এবং ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধ। প্রতিবার যুদ্ধ শেষে সীমান্তরেখা নির্ধারিত হলেও সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়নি। ১৯৪৯ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় নির্ধারিত হয় ‘নিয়ন্ত্রণরেখা’ বা Line of Control (LoC), যা আজও ভারত ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরকে বিভক্ত করে রেখেছে। ভারত কাশ্মীরকে তার অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে দেখে এবং বলেছে- এটি ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। পাকিস্তান একে বিতর্কিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে, যেখানে গণভোট হওয়া প্রয়োজন বলে তারা দাবি করে। দুই দেশের এই বৈপরীত্যের কারণে কাশ্মীর আজও একটি নিরাপত্তাহীন, অস্থির ভূখণ্ড।

 

 

দুই কাশ্মীরের প্রশাসনিক কাঠামো

ভারতীয় কাশ্মীর আগে ছিল একটি বিশেষ রাজ্য, যেটি সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫এ ধারায় বিশেষ মর্যাদা পেত। ২০১৯ সালের আগস্টে ভারত সরকার এই ধারা বাতিল করে অঞ্চলটিকে দুটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করে- জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ। কেন্দ্রীয় শাসন জারির ফলে উন্নয়নের সুযোগ বাড়লেও রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব বেড়েছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরে একটি আঞ্চলিক সরকার রয়েছে, যার নিজস্ব সংসদ ও প্রধানমন্ত্রী আছে। তবে পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিরক্ষা পুরোপুরি পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে। গিলগিট-বালতিস্তান প্রশাসনিকভাবে পৃথক হলেও সাংবিধানিকভাবে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত নয়। এখানকার অধিবাসীরা বহুদিন ধরেই সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও অধিকার দাবি করে আসছে।

 

 

সাধারণ কাশ্মীরিদের জীবনযাপন ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য

কাশ্মীরের মানুষ অত্যন্ত চমৎকার। তারা শান্তিপ্রিয়, শিল্পপ্রিয় এবং ধর্মভীরু। দুটি কাশ্মীরেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম হলেও ভারতীয় অংশের জম্মু অঞ্চলে হিন্দুদের উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ। পাহাড়, নদী, ফলের বাগান, পশমশিল্প, কাঠের কারুশিল্প, চর্ম ও বস্ত্র শিল্প- কাশ্মীরি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে সাধারণ কাশ্মীরিদের জীবন রোজকার নিরাপত্তা তল্লাশি, কারফিউ, সংঘর্ষ, কিংবা জঙ্গি কার্যকলাপের আতঙ্কে অতিবাহিত হয়। পাকিস্তানি অংশে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো দুর্বল এবং ভারতীয় অংশেও উন্নয়নের পথে বড় বাধা হচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা।

 

 

কাশ্মীরিদের স্বপ্ন

কাশ্মীর শুধু ভূখণ্ড নয়, একটি জীবন্ত ইতিহাস, একটি সংগ্রামী জনপদ। এ অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে শান্তিপূর্ণ সংলাপ, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং কাশ্মীরিদের মতামতের ওপর। ভারত-পাকিস্তান যদি আন্তরিকভাবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে চায়, তবে কাশ্মীর সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব। কাশ্মীরের মানুষ চায় নিরাপদ জীবন, স্বাধীনভাবে চলাফেরা, শিক্ষার সুযোগ, কর্মসংস্থান, আর সম্মানের সঙ্গে বাঁচার অধিকার। এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলে হয়তো একদিন সত্যি সত্যিই কাশ্মীর হতে পারে সেই ‘স্বর্গ’, যেটি আজ রূপকথার মতো শোনায়।