কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

কেন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে টানতে চাচ্ছেন

সামি আল-আরিয়ান [সূত্র : যুগান্তর, ১৯ জুন ২০২৫]

কেন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে টানতে চাচ্ছেন

গত শুক্রবার ইরানের বিরুদ্ধে বিনা প্ররোচনায় সামরিক হামলা চালায় ইসরাইল, যেখানে ছিল ১০০টিরও বেশি লক্ষ্যবস্তু-সামরিক ঘাঁটি, পারমাণবিক স্থাপনা এবং সিনিয়র নেতৃত্বকে ধ্বংস করা হয়।

 

 

 

এ হামলা একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়িয়েছে। ইরানের সামরিক প্রধান, বিপ্লবী গার্ডের প্রধান এবং পারমাণবিক কর্মসূচির কয়েকজন সদস্যকে হত্যা করেছে ইসরাইল। এর ঠিক দুই দিন আগেই শুরু হতে যাচ্ছিল ষষ্ঠ দফা যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পারমাণবিক আলোচনা। জানা যায়, হামলা শুরুর পর থেকে মোট ১৪ জন পরমাণু বিজ্ঞানীকে বিমান এবং গাড়ি বোমার সাহায্যে হত্যা করা হয়েছে।

 

 

ইরান পারমাণবিক বিস্তার রোধ চুক্তির (এনপিটি) অধীনে তার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করার জন্য কাজ করছিল, যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) তত্ত্বাবধানে শান্তিপূর্ণ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সম্ভব হচ্ছিল।

 

তবে ইসরাইল দীর্ঘদিন ধরে শুধু সম্ভাব্য অস্ত্রায়ন নয়, বরং ইরানের যে কোনো ধরনের পারমাণবিক উন্নয়নের বিরোধিতা করে আসছে। ইরানকে পারমাণবিক শক্তি থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করার লক্ষ্যে ইসরাইল পুরোপুরি ওই কর্মসূচি নস্যাৎ করার চেষ্টা করছে, যদিও দেশটি নিজেই ১৯৬০-এর দশকের শেষ থেকে পারমাণবিক অস্ত্র ধারণ করে এসেছে। তারা এনপিটির বাইরে রয়েছে এবং কখনো নিজের অস্ত্রের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেনি। সাম্প্রতিক হামলার আগে ইরানে বছরের পর বছর ধরে ইসরাইল অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে; গোপন স্যাবোটাজ, হত্যাকাণ্ড এবং ইরানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়েছে-যেসব ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নীরব ভূমিকা পালন করেছে।

 

 

যুক্তরাষ্ট্র আগে থেকেই এ হামলার কথা জানত। হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা সরাসরি অংশগ্রহণের কথা অস্বীকার করলেও সিনিয়র কংগ্রেস নেতারা আগেই ব্রিফিং পেয়েছিলেন এবং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই হামলাগুলোকে ‘সফল’ হিসাবে প্রশংসা করেছেন এবং বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ‘অপারেশন সম্পর্কে সবকিছু জানত।’

 

 

দীর্ঘদিন ধরে একটি ব্যাপক মাত্রার সংঘর্ষের উসকানি দিয়ে আসা ইসরাইল এখন গাজায় তার গণহত্যামূলক যুদ্ধে এবং বিস্তৃত আঞ্চলিক আগ্রাসনে পশ্চিমা শক্তিগুলোর দেওয়া ক্ষমতালিপ্সার সুযোগ নিয়ে তার সহিংস অভিযান আরও বাড়াচ্ছে।

 

 

সিরিয়ায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের স্বীকৃতি দাবি করা ইসরাইলি কর্মকর্তারা এখন প্রকাশ্যে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে এবং ইরানের সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা করছে। কিন্তু ইরানের সুরক্ষিত পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস এবং তার নেতৃত্ব উৎখাত করতে ইসরাইলের প্রয়োজন পূর্ণাঙ্গ মার্কিন সামরিক সমর্থন। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর কৌশল হলো একটি বৃহত্তর সংঘর্ষ উসকে দেওয়া, যা ওয়াশিংটনকে সরাসরি ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে বাধ্য করবে।

 

 

ইসরাইলের আধিপত্যবাদী আকাঙ্ক্ষা দ্বারা পরিচালিত এই কূটচাল-যাতে তারা অঞ্চলের একমাত্র পারমাণবিক শক্তি হিসাবে টিকে থাকে-ব্যর্থ হতে পারে, এবং যুক্তরাষ্ট্র আবারও মধ্যপ্রাচ্যে একটি ব্যয়বহুল ও অজেয় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে।

 

 

১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানকে একটি প্রধান হুমকি বিবেচনা করতে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য এবং ইসরাইলি প্রভাব বিস্তারে বাধা হিসাবে ইরানকে মনে করা হতে থাকে। এ প্রেক্ষাপটেই ১৯৮০ সালে ইরানে ইরাকের হামলাকে যুক্তরাষ্ট্র পরোক্ষভাবে সমর্থন করে। আবার সাদ্দাম হোসেন যখন ১৯৯০ সালে কুয়েত আক্রমণ করেন, তখন ইরান ও ইরাক উভয়কেই টার্গেট করে যুক্তরাষ্ট্র।

 

 

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র একক বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলে থাকা ইসরাইলপন্থি রাজনৈতিক শক্তিগুলো একে মার্কিন শ্রেষ্ঠত্ব সম্প্রসারণের সোনালি সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করে। আর তা ইসরাইলের আঞ্চলিক আধিপত্য আরও জোরদার করে।

 

 

নেতানিয়াহু ১৯৯৬ সালের মে মাসে যখন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, তখন ইতোমধ্যেই ক্লিনটন প্রশাসনের মধ্যে ইসরাইলপন্থি নীতিনির্ধারকরা ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে। আফগানিস্তানে তালেবানকে উৎখাত করার পর সাতটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে-ইরাক, লেবানন, সিরিয়া, লিবিয়া, সুদান, সোমালিয়া এবং সবশেষে ইরানে হামলা এবং সরকার পতনের পরিকল্পনা করা হয়। এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল এ অঞ্চলে তাদের স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এমন যে কোনো সরকারকে দুর্বল বা অপসারণ করার জন্য কাজ করতে থাকে।

 

 

এদিকে নেতানিয়াহু ২৫ বছর ধরে বিরামহীনভাবে বলে আসছেন, পরমাণু বোমা তৈরি থেকে ইরান মাত্র ‘কয়েক সপ্তাহ’ দূরে রয়েছে। কিন্তু আইএইএসহ গোয়েন্দা সূত্রগুলো এ ব্যাপারে কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র, নিরাপত্তা পরিষদের অন্যান্য স্থায়ী সদস্য এবং জার্মানি মিলে ইরানের সঙ্গে একটি পরমাণু চুক্তি করে। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প তা বাতিল করে দেন। জো বাইডেন তা আর ফিরিয়ে আনেননি। ট্রাম্প গত জানুয়ারিতে ক্ষমতায় এসেই ইরানের পরমাণু ক্ষমতা নস্যাৎ করে একটি চুক্তির জন্য চাপ দিতে থাকেন। তিনি ইরানকে বিভ্রান্ত্র করার জন্য আলোচনার প্রস্তাব করেন।

 

 এই সুযোগে অপ্রত্যাশিতভাবে ১৩ জুন ইরানে হামলা করে বসে ইসরাইল। কেবল ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ভণ্ডুল করার জন্য নয়, সেই সঙ্গে সরকার পরিবর্তনও লক্ষ্য হিসাবে নির্ধারণ করে ইসরাইল। প্রথম দিনেই ২০ জনের বেশি সিনিয়র ইরানি সামরিক ব্যক্তিত্বকে হত্যা করে বেশ খুশি হন নেতানিয়াহু। নেতানিয়াহুর কৃতিত্বে অবশ্য ভাগ বসান ট্রাম্প। অনেক বিশ্লেষক ইরানের মৃত্যু পরোয়ানার কথাও ঘোষণা করে ফেলেন। তবে ইতিহাস আমাদের শেখায় যে প্রথম গুলিকারী নয়, বরং শেষ গুলিটি যে করে, তিনিই জয়ী হন। ইরান-ইরাক যুদ্ধ, ১৯৮২ সালে লেবাননে ইসরাইলি অভিযান, ২০০১ সালে আফগানিস্তানে আমেরিকার অভিযানের সব ভবিষ্যদ্বাণী বিফলে গিয়েছিল। ফলাফল হয়েছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।

 

 

ইরান কিন্তু ভালোভাবেই জবাব দিয়েছে। এই জবাবে ইসরাইল কেঁপে উঠেছে। লাখ লাখ ইহুদি বাংকারে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। আয়রন ডোম প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কাজ করছে না। ইসরাইল এখন বুঝতে পারছে, তারা নিজেদের শক্তিতে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস করতে পারবে না। তারা সরকারও ফেলতে পারবে না। আর এ কারণেই যুদ্ধে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে টেনে আনতে চাইছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি এই যুদ্ধে জড়িয়ে যায়, তবে পুরো মাত্রায় আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। কোনো কোনো বিশ্লেষক তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কার কথাও বলেছেন। আবার যুক্তরাষ্ট্রকে যদি যুদ্ধে না আনতে পারে এবং ইসরাইল নিজে ইরানের পরমাণু সক্ষমতা ধ্বংস করতে না পরে, তবে ইসরাইলের ভয় দেখানোর শক্তি স্থায়ীভাবে শেষ হয়ে যাবে। ভ্লাদিমির লেনিন একবার বলেছিলেন, অনেক সময় কয়েক দশকেও কিছু ঘটে না। আবার অনেক সময় কয়েক সপ্তাহে কয়েক দশকের ঘটনা ঘটে। আগামী দিনগুলোতে সম্ভবত এমন কিছুই দেখা যাবে এ অঞ্চলে।

 

 

মিডলইস্ট আই থেকে অনূদিত

সামি আল-এরিয়ান : পরিচালক, সেন্টার ফর ইসলাম অ্যান্ড গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স, ইস্তান্বুল জাইম ইউনিভার্সিটি