খাদ্য নিরাপত্তার খুঁটিনাটি
আব্দুল বায়েস । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

খাদ্য নিরাপত্তা বলতে আমরা বুঝি সব সময়ে সব মানুষের স্বাস্থ্যসম্মত এবং উৎপাদনশীল জীবনের জন্য যথেষ্ট খাবারের লভ্যতা। খাদ্য নিরাপত্তার একটি দরকারি উপাদান হচ্ছে জাতীয় এবং খানা স্তরে পর্যাপ্ত খাদ্যের সরবরাহ। অন্য প্রয়োজনীয় শর্ত হলো জাতীয় এবং খানা স্তরে এই পর্যাপ্ত খাবারে প্রবেশগম্যতা বা অ্যাকসেস—অমর্ত্য সেনের ভাষায় ‘এনটাইটেলমেন্ট’। তবে প্রাপ্যতা এবং প্রবেশগম্যতা একটি স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য দরকারি, কিন্তু যথেষ্ট শর্ত নয়।
সুতরাং খাদ্য নিরাপত্তার নিরিখে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে খাদ্যের কার্যকর ব্যবহার, যা কিনা অনেক উপাদানের ওপর নির্ভরশীল; যেমন—চিকিৎস, পয়োনিষ্কাশন, পরিবেশ এবং সমাজের ঝুঁকিগ্রস্ত শ্রেণির পরিচর্যায় খানা বা সরকারের সামর্থ্য।
জাতীয় পর্যায়ে খাবার আসে তিনটি উৎস থেকে; যথা—অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, সরকারি ও বেসরকারি খাদ্য মজুদ, খাদ্য আমদানিসহ খাদ্য সাহায্য এবং খাদ্য রপ্তানি। বাণিজ্য উদারীকরণের যুগে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যের প্রবাহ জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তার নিয়ামক হয়ে ওঠে। খানা পর্যায়ে খাদ্য নিরাপত্তা নির্ভর করে নিজস্ব উৎপাদন, খানার খাদ্য মজুদ এবং স্থানীয় বাজারে খাদ্যের জোগান, যার অনুঘটক হিসেবে আছে বাজার ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো, তথ্যপ্রবাহ এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে মৌসুমি ওঠানামা ইত্যাদি বিষয়।
বৈশ্বিক পর্যায়ে একটি দেশের ফুড অ্যাকসেস বা ফুড এনটাইটেলমেন্ট নির্ভর করে রপ্তানি আয়, বিশ্ববাজারে দাম এবং ঋণ-সেবার ওপর। খানার অ্যাকসেস আসে খাদ্যের দাম, খানার আয় এবং সম্পদ-ভিতের ওপর। বর্ধিত আয় খানার অ্যাকসেস বৃদ্ধি করে এবং সম্পদ-ভিত যদি শক্ত থাকে, তখন স্বল্পকালীন ধাক্কায় খানার খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় না। কারণ সম্পদের একটি অংশ বিক্রি করে খাদ্যপ্রবাহ অটুট রাখা যায়।
দারিদ্র্য হচ্ছে চরম খাদ্য নিরাপত্তার অভাবের নমুনা। কারণ দরিদ্র তার আয় দিয়ে খাদ্যে অ্যাকসেস পায় না, এমনকি যখন স্থানীয় বাজারে চালের অভাব থাকে না, তখনো। তা ছাড়া দরিদ্র সব সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা শস্যহানির আঘাতে ঝুঁকিগ্রস্ত হয়ে সাময়িক খাদ্য ঘাটতির সম্মুখীন হয়। এবং সব শেষে খাদ্যের ঊর্ধ্বমুখী দাম প্রকৃত আয় হ্রাস করে নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় সাময়িক ব্যাঘাত ঘটায়।
শরীরে খাদ্যের ভূমিকা খাদ্য নিরাপত্তার অন্য এক অঙ্গ।
এর সঙ্গে পুষ্টির গভীর সম্পর্ক আছে। খাদ্যের জোগান এবং খাদ্য ক্রয়ক্ষমতা উন্নত হলে বুভুক্ষা বা ক্ষুধা কমতে পারে, কিন্তু অপুষ্টি না-ও কমতে পারে। কারণ এই দুটি উপাদান উন্নীত হলেও পুষ্টির উন্নয়নে বাধা হতে পারে খাদ্যবহির্ভূত কিছু অনুঘটকের কারণে। যেমন—স্বাস্থ্য পরিচর্যা সুযোগের মান, বিশেষত মায়ের শিক্ষা, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা, নিরাপদ পানি প্রভৃতি।
এবার খাদ্য নিরাপত্তার ওই তিন স্তম্ভের ভিত্তিতে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা জনিত কৃতিত্ব যাচাই করা যেতে পারে। প্রথমত, কৃষিজমির নিম্নমুখিতার মুখেও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন মারফত খাদ্য জোগানে বাংলাদেশ বেশ এগিয়ে রয়েছে। সার্বিক খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি জনসংখ্যা বৃদ্ধির চেয়ে অধিকতর হওয়ার সুবাদে সময়ের আবর্তনে মাথাপিছু খাদ্যলভ্যতা উঁচুতে অবস্থান করছে। উদাহরণস্বরূপ, সত্তরের দশকে সাড়ে সাত কোটি মানুষ নিয়ে খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলা করতে হয়েছে। এখন ১৭ কোটি মানুষ নিয়ে চাল উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতার কাছাকাছি বাংলাদেশ—গেল পাঁচ দশকে চার গুণ বৃদ্ধি। মূলত ‘সবুজ বিপ্লবের’ কল্যাণে ‘অঘটনঘটনপটীয়সী’ বাংলাদেশ। তবে সরকারি নীতিমালার ইতিবাচক পরিবর্তন প্রশংসার দাবি রাখে। যা হোক, মোট কৃষি উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ অবদান আসে চাল উৎপাদন থেকে। এখন চাল উৎপাদন প্রায় চার কোটি টন। তবে ঘাটতি আছে গম, ভুট্টা, পেঁয়াজ, ডাল, তেলবীজ উৎপাদনে যা আমদানি করে মেটানো হয়। মাঝেমধ্যে চালও আমদানি করা হয়, বৈরী বছর হলে। নিয়মিত এবং প্রচুর আমদানি করতে হয় সয়াবিন ও পাম তেল এবং গুঁড়া দুধ।
খাদ্যলভ্যতার উন্নতি ছাড়াও খাদ্যে প্রবেশগম্যতা বা অ্যাকসেসের ক্ষেত্রে উন্নতি লক্ষণীয়। বিশেষত ২০১৫-১৬ ও ২০২১-২২ নাগাদ প্রতিবছর প্রবৃদ্ধি সাড়ে ছয় শতাংশ, দারিদ্র্য হ্রাস ২৪ থেকে ১৯ শতাংশ এবং জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ১ শতাংশের বিপরীতে মাথাপিছু আয় প্রায় ৬ শতাংশ বৃদ্ধি এনটাইটেলমেন্ট/অ্যাকসেস বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে, যেমন রেখেছে প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধি। তবে করোনা এবং পরবর্তী সময়ে উঁচু মূল্যস্ফীতি স্বস্তি ছিনিয়ে নিলে খাদ্যে অ্যাকসেস বড় ধাক্কা খায় দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের খানায়। তার পরও শত সীমাবদ্ধতা নিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বাঁচোয়া।
পুষ্টির বেলায় প্রান্তিক উন্নতি উপেক্ষা করার নয়। ১৯৯৭ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ হ্রাস ঘটে কম ওজনের ও খর্বকায় শিশুর ক্ষেত্রে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও উন্নতি লক্ষণীয়। তবে যেমনটি আগেও বলেছি, খাদ্য নিরাপত্তার স্বস্তির সুবাতাস গত প্রায়। বর্তমানে খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি, জলবায়ু পরিবর্তন, নানা বাহানায় কৃষিজমি বেহাত, প্রযুক্তির শেষ সীমায় পৌঁছানো এবং অতি সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা, সিন্ডিকেটের কারসাজি এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি। মানুষের প্রকৃত আয় বৃদ্ধি করতে না পারলে খাদ্য নিরাপত্তা ভয়ংকর বিপদের সম্মুখীন হতে পারে।
দুই.
কৃষি উৎপাদনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে জমি। বিশেষত সত্তরের দশকে ভূমি বিতরণ বিন্যাস নিয়ে প্রচুর গবেষণা, আলোচনা এবং নীতিনির্ধারণী বক্তব্য শোনা যেত। কৃষিসংক্রান্ত আলোচনায় বাম বুদ্ধিজীবীদের শ্যেনদৃষ্টি পড়ত কৃষিজমির মালিকানাকাঠামোতে এই যুক্তিতে যে কৃষকের সব কল্যাণ নিহিত ভূমিবণ্টনে, যা বাংলাদেশে অসম আর তাই সবুজ বিপ্লব সুদূরপরাহত।
সাধারণ কথায় বলে, জোর যার মুলুক তার আর অর্থনীতির ভাষায়, জমি যার ক্ষমতা তার। ভূমিহীনতা হচ্ছে এমন এক অবস্থা, যখন ব্যক্তি বা খানার নিজস্ব কোনো জমি থাকে না—হোক সে কৃষি উৎপাদন কিংবা বসতির জন্য। এই ভূমিহীনতার কারণে জন্ম নেয় দারিদ্র্য, খাদ্যের অভাব কিংবা খাদ্য অনিশ্চয়তা এবং সামাজিক প্রান্তিকতা। গ্রামীণ বাংলাদেশে প্রায় ৬০ শতাংশ খানা ভূমিহীন, যাদের মালিকানায় বসতভিটা ছাড়া চাষযোগ্য জমি নেই। ভূমিহীনতার এই প্রকোপ খুলনা বিভাগের ৪৭ থেকে চট্টগ্রাম বিভাগে প্রায় ৭০ শতাংশ।
নিজ জমির মালিকানার ভিত্তিতে নিচের দিকের ২৫ শতাংশ খানা মোট চাষযোগ্য জমির মাত্র প্রায় ৪ শতাংশের মালিক, অন্যদিকে ওপরের ৫ শতাংশ খানার নিয়ন্ত্রণে ২৬ শতাংশ, ওপরের ১০ শতাংশ খানা মোট নিজ জমির প্রায় ৪০ শতাংশের মালিক। তবে নিজস্ব জমি না থাকলেও অন্যের জমি বর্গা নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা যায়, এমনকি যাদের নিজের অনেক জমিজমা, তারাও অন্যের জমি নিয়ে চাষ করে থাকে। নিজের জমি ও অন্যের জমি মিলে হয় খামার বা পরিচালিত হোল্ডিং এবং খামারের আয়তনে চারটি দল শনাক্ত করা যায়—বাংলাদেশে প্রান্তিক চাষি শতকরা ৪১ ভাগ (৫০ শতাংশের নিচে জমি), ক্ষুদ্র চাষি ৪২ ভাগ (০.৫-১.৪৯ একর), মধ্যম চাষি ১১ ভাগ (১.৫-২.৪৯ একর) এবং বড় চাষি ছয় ভাগ (২.৫ একরের বেশি জমি)। লক্ষণীয় যে বাংলাদেশের মোট কৃষকের সবচেয়ে বড় অংশটি—প্রায় ৮৫ ভাগ—প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষক, যাঁরা মোট পরিচালিত জমির ৫২ ভাগ পরিচালন করে থাকেন। অন্যদিকে মধ্যম ও বড় মিলে ১৬ ভাগের পরিচালনায় আছে বাকি জমি।
তিন.
এত কিছুর পরও কৃষিই ভরসা। দারিদ্র্য হ্রাসে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধির প্রভাব মূল্যায়ন করতে গেলে দারিদ্র্য হ্রাসে প্রবৃদ্ধির স্থিতিস্থাপকতা—ইলাস্টিসিটি অব গ্রোথ অন পভার্টি রিডাকশন পর্যালোচনা করার প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ গড় জাতীয় আয় যদি ১ শতাংশ বাড়ে, তাহলে দারিদ্র্যের হার কী পরিমাণ কমে সেই সম্পর্কটা দেখার প্রয়াস নেওয়া দরকার বলে গবেষকরা মনে করেন। এক গবেষণায় দেখা যায়, সাধারণত উন্নয়নশীল দেশে সহগটির মান গড়পড়তা মাইনাস ২ অর্থাৎ গড়পড়তা প্রকৃত মাথাপিছু আয় ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে দারিদ্র্যের হার কমবে ২০ শতাংশ।
ঐতিহাসিকভাবে উন্নয়নশীল দেশে দারিদ্র্য কমাতে কৃষি খাত একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। কৃষি থেকে জিডিপির যে হিস্যাটি আসে, তা সমাজের সবচেয়ে শুধু দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে তাৎপর্যপূর্ণ আয়ের সূত্রপাত ঘটায়। তা ছাড়া শুধু সরাসরি দারিদ্র্য হ্রাস নয়, পুরো অর্থনীতিতে শক্তিশালী লিংকেজ প্রভাব নিয়ে হাজির হয় কৃষি খাত। কৃষির পরোক্ষ অবদান আসে খামারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে; যেমন—সার, সেচযন্ত্র, কীটনাশক ও অন্যান্য উপকরণের চাহিদাসমেত ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ এবং প্যাকেজিং, পরিবহন, শিল্পজাত প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ এবং কৃষিপণ্যের বাজারসমেত ফরওয়ার্ড লিংকেজ গড়ার মাধ্যমে। এই কর্মকাণ্ডগুলো ব্যাপক প্রবৃদ্ধি ঘটায় খামারবহির্ভূত খাতে, যার মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয় বর্ধিত কর্মসংস্থান ও আয়। যা হোক, দেশ যতই সম্পদশালী হবে দারিদ্র্য হ্রাসে কৃষির প্রবৃদ্ধির ধার, খামারবহির্ভূত খাতের তুলনায় ততই কমবে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে।
মোটকথা, বাংলাদেশের ভূমির বিতরণ অত্যন্ত অসম। তবে বলা বাহুল্য যে নিজ জমির বিতরণবিন্যাস পরিচালিত জমির বিতরণবিন্যাসের চেয়ে অধিক অসম। এর কারণ একজন ভূমিহীন চাষিও অন্যের জমি বর্গা নিয়ে অলিখিত মালিক হতে পারেন এবং তাই খামারের হিসাবে বা পরিচালিত প্লটের হিসাবে অসমতা অপেক্ষাকৃত কম।
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের কৃষকদের শতকরা ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষি। আগামী দিনগুলোতে নীতিমালা এই গোষ্ঠীকেন্দ্রিক না হলে উৎপাদন ব্যাহত হয়ে খাদ্য নিরাপত্তায় বাধা হতে পারে। একদিকে উৎপাদন বাড়ানো, অন্যদিকে ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখাই মুখ্য চ্যালেঞ্জ।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়