খাদ্যনিরাপত্তা : কৃষির উন্নয়নে ২৫ বছরের পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে
ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান। সূত্র : বণিক বার্তা, ০৬ মে ২০২৫

স্বাধীনতা-উত্তর সার্বিক কৃষি ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন যে পর্যায়ে এসেছে তা অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। দেশে কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কৃষক-বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের অনেক অবদান রয়েছে। এখানে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা রয়েছেন যারা কৃষি নিয়ে ভাবেন, কৃষি নিয়ে ব্যবসা করছেন। তারা শুধু ব্যবসায়িক কারণেই ব্যবসা করছেন সেটা আমরা মনে করি না। তাদের নৈতিক দায়িত্ব মানুষকে সাহায্য করা। দেশকে সমৃদ্ধ করার জন্য এ কর্মকাণ্ডগুলো করছেন বলেই সেটি আমরা বিশ্বাস করি। এসব অবদানকে স্মরণ করে এবং স্বীকৃতি দিয়ে আমি দুটি কথা বলব। তার পরও আমার যেন কেন মনে হয়, আমরা আজকে যে পর্যায়ে পৌঁছেছি সেটি অবশ্যই আমাদের বড় অর্জন। কিন্তু আমার ধারণা, আমরা যদি পরিকল্পনামাফিক কাজ করতাম তাহলে এর চেয়েও আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারতাম। আমাদের আরো অনেক কিছু করার সুযোগ রয়েছে। এ পথ চলায় বেশকিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো রিডিজাইন বা রিস্ট্রাকচার বা রিঅর্গানাইজ করে করলে ফ্রেমিংটা আরো মজবুত, যথার্থ ও প্রশস্ত হতো।
আমাদের ডেল্টা প্ল্যান রয়েছে, সেখানে আমাদের কৃষিকে অঞ্চলভিত্তিক ছয়টি হটস্পটে ভাগ করা হয়েছে। ছয়টি হটস্পটকে আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ে পর্যালোচনা করে দেখেছি। যে নতুনত্বের কথা বলা হচ্ছে, মূল সংযোজন কীভাবে করা যায় এবং কীভাবে অগ্রসর হলে কৃষির সার্বিক উন্নয়ন হবে, সেটিকে আমরা নয়টি থিমেটিক এরিয়ায় শনাক্ত করেছি। নয়টি থিমেটিক এলাকায় ২৫টি উপখাত নিয়ে ভাবছি। যদি এগুলোকে বাস্তবায়ন করতে হয় তাহলে বিভিন্ন রকমের পরিকল্পনা ও প্রকল্পের প্রয়োজন। এজন্য সরকারি-বেসরকারি খাতের সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে। যদিও সেটা করতে গিয়ে আমাদের স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি নির্দিষ্ট কাঠামোগত পরিকল্পনা এখনো তৈরি করতে পারিনি। সেটি নিয়েই আমরা কাজ করছি। এখন আমরা ২৫ বছরের একটি দীর্ঘমেয়াদি কৃষি কৌশলগত পরিকল্পনা বা পারসপেক্টিভ প্ল্যানের উন্নয়ন ঘটাতে চাই। সেটি কী রকম করতে চাই? ২০৫০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর জনসংখ্যা কত বাড়ছে সেটি হিসাব করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো বা বিভাগগুলো মৌলিক খাদ্য নিশ্চিতের জন্য যে কাজগুলো করে থাকে তার আইটেমগুলো শনাক্ত করে সেগুলোর চাহিদাকে শনাক্ত করতে চাই।
সেটি হচ্ছে মানুষের খাদ্য চাহিদা (হিউম্যান কনজাম্পশন)। মানুষের খাদ্যের পাশাপাশি পশু-পাখির বা বন্যপ্রাণীর (নন হিউম্যান কনজাম্পশন) খাদ্যের চাহিদা রয়েছে। সেগুলোকেও আমাদের হিসাবে আনা উচিত এবং পশু-পাখি বা বন্যপ্রাণীর চাহিদা কম সেটিও শনাক্ত করা দরকার। পশুপাখির চাহিদাকে শনাক্ত করে মানুষের চাহিদার সঙ্গে একত্র করে এর নিট ও চাহিদাকে শনাক্ত করতে চাই। কৃষি থেকে সেই চাহিদাকে শনাক্ত করে আমাদের লক্ষ্য অর্জন করতে চাই। মানুষ ও পশু-পাখির চাহিদা শনাক্ত করে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাই। সেটি করতে গিয়ে আমরা ভাবছি, শুধু খাদ্যনিরাপত্তা দিলেই হবে না বরং নিরাপদ খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নিরাপদ খাদ্যের সঙ্গে খাদ্যটি পুষ্টিগুণসম্পন্ন হতে হবে যাতে আমাদের খাবার গুণগত মানসম্পন্ন হয়। অর্থাৎ মানুষ ও পশু-পাখির চাহিদার ভিত্তিতে আমরা নিরাপদ পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাদ্য নিশ্চিত করতে চাই। খাদ্যনিরাপত্তায় কাজ করছেন কৃষকরা। কৃষকদের সঙ্গে রয়েছেন অন্যরাও।
কৃষকদের অনেকেই বলছেন তারা তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান না। পোলট্রিতেও একই অবস্থা। তাই নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হলে কৃষকবান্ধব একটি পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। কৃষকবান্ধব পরিবেশ কীভাবে নিশ্চিত হবে? সেক্ষেত্রে বেসরকারি খাতসহ কৃষি খাতের সংশ্লিষ্টদের নিয়ে এগ্রো ইকোনমির বিকাশ ঘটাতে হবে। মানুষ ও পশু-পাখির চাহিদার ভিত্তিতে নিরাপদ পুষ্টিসম্পন্ন খাদ্য নিশ্চিত করতে কৃষকবান্ধক এগ্রো ইকোনমি গড়ে তুলতে আমরা কাজ করছি।
কৃষির স্বাস্থ্য হচ্ছে মাটি। মাটির গুণাগুণ বা উর্বরতা সঠিকভাবে আছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে। যদি সঠিকভাবে না থাকে তাহলে কেন নেই সেটিও খুঁজে বের করা এবং এর করণীয় বের করতে হবে। এসব নিয়েও আমরা কাজ করছি। খামারি অ্যাপস দিয়ে প্রাথমিকভাবে সে বিষয়টি শুরু করেছি। সারা দেশে জমির যতগুলো মৌজা রয়েছে সেগুলোর মধ্যে ৪৫০টি উপজেলার মৌজার মাটির অবস্থা সংগ্রহ করেছি। ওই মাটির অবস্থার ভিত্তিতে ওই জমিতে কৃষকের জন্য কোন মৌসুমে কী ধরনের ফসল উপযুক্ত হবে তা নিশ্চিত করতে একটি সহজলভ্য গাইডলাইন করা হবে।
উৎপাদনের জন্য বীজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বীজের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সেটি করতে হবে। আমি মনে করি, আমরা ৪০-৪৫ শতাংশ বীজ সরবরাহ করতে পারি। বাকি ৫৫-৬০ শতাংশ বীজ কৃষকরা নিজেদের পদ্ধতিতে সংগৃহীত বীজ সরবরাহ করে। আমরা যদি বীজের ২০ শতাংশ সরবরাহ বাড়াতে পারি তাহলে ফসলের উৎপাদন বাড়বে ১৫-২০ শতাংশ। আমাদের সেভাবেই এগোতে হবে।
সার বা কীটনাশক অতিরিক্ত ব্যবহার হচ্ছে। সেটির কিছুটা আমরা জেনে করছি কিংবা কিছুটা না জেনে করছি। না জানাটাই বেশি। অসচেতনতাকে সচেতনতার মধ্যে আনতে হবে। কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সব জিনিস সঠিকভাবে যেন যায় সেজন্য একটি রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক দিয়ে তা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসতে হবে। বিভিন্ন সামাজিক ও অন্যান্য যে বিষয় রয়েছে সেগুলোর বিষয়ে সচেতন করতে হবে।
৬৬-৬৮টি জেনেরিক কীটনাশকের আইটেম থেকে এরই মধ্যে প্রায় আমাদের দেশে প্রায় ৪ হাজার ৮০০ মতো আইটেম রয়েছে। একজন সাধারণ কৃষক বা মাঠপর্যায়ে কর্মরত এসও কিন্তু এসব বিষয়ে নিয়ে সচেতন নন। এসব বিষয়েও তাদের সচেতন করতে হবে। তবে ৬৮টি জেনেরিকের মধ্যে এতগুলো আইটেম দরকার আছে কিনা সে বিষয় বিবেচনার দাবি রাখে। ব্যবসায়ী ও বিজ্ঞানীদের সম্মিলিতভাবে এ বিষয়টিকে একটি নির্দিষ্ট আকারে নিয়ে আসা দরকার। এজন্য যে কীটনাশক বিধিমালা বা নীতিমালা রয়েছে তা রিভিউ করা দরকার। শিগগিরই এটিকে যুগোপযোগী ও আধুনিক করে কৃষক ও ব্যবসায়ীবান্ধব করতে প্রক্রিয়া শুরু করেছি। এরই মধ্যে ৪ হাজার ৮০০ কীটনাশকের আইটেম থাকা সত্ত্বেও আরো ১ হাজার ২০০ আইটেম বাজারে আনতে চান ব্যবসায়ীরা, যদিও সেগুলো আমি স্থগিত রেখেছি।
সত্যিকারের যেসব ব্যবসায়ী কীটনাশকের উপাদানগুলোর সঠিক মিশ্রণে কীটনাশক তৈরি করছেন, তাদের কাছ থেকে সাধারণ কৃষকরা প্রতারিত হওয়ার সুযোগ কম। অনেক ক্ষেত্রে মিশ্রণ সঠিক হয় না। আমরা ব্যবসা চাই কিন্তু সেটা যেন হয় সত্যিকার অর্থেই নীতি, নৈতিকতা ও কৃষিবান্ধব এবং আমাদের অর্থনীতির জন্য সঠিক হয়, সেদিকেও নজর রাখা দরকার।
সার আমাদের জন্য বড় ইস্যু। সরকার প্রতি বছর ২৯ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দেয়। ইউরিয়া সারের সঙ্গে ডিএপি সার মেশানো হলে ইউরিয়া ২০ শতাংশ কম দিলেও হয়। কৃষকের সচেতনতা নেই। তাদের সচেতন করা যায়নি। এটি আমাদের ব্যর্থতা। কৃষকরা মনে করে সার বেশি দিলেই ফসল বেশি হবে। এটি ভুল ধারণা। ভালো ফলন পেতে হলে পরিমাণমতো সার দিতে হবে। একসময় প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাসের আধিক্য ছিল। দিন দিন সেটি কমছে। এখন বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক সম্পদ হচ্ছে মাটি। এ প্রাকৃতিক সম্পদ মাটিকে যদি নষ্ট করে ফেলি তাহলে বাকি কোনো কিছুই আমাদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনতে পারবে না।
তাই মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট মাটির অবস্থাকে শনাক্ত করবে। মাটির অবস্থা জানলেই হবে না বরং প্রেসক্রিপশন দিতে হবে। কৃষি এমন একটি খাত যেখান থেকে সার্বিক উন্নয়ন দরকার। বেসরকারি অংশীজনরা কীভাবে সরকারের সঙ্গে কাজ করতে পারে তা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় নিয়ে আসতে চাই আমরা। আমাদের গবেষণা ইনস্টিটিউট রয়েছে, তাদের অনেক ভ্যারাইটিজ রয়েছে। কিন্তু ব্যবহারকারীর কাছে ভ্যারাইটিজগুলো পৌঁছেনি। আমাদের দেশে সীমাবদ্ধতা অনেক রয়েছে। বেসরকারি খাতের যে ল্যাব সুবিধা রয়েছে সেটিকে আমরা কাজে লাগাতে পারি। আমরা গবেষণা করছি, কিন্তু এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও বাজার বিশ্লেষণ করছি না। সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে ইন্ট্রা ডিপার্টমেন্ট, ইন্টার ডিপার্টমেন্ট এবং ইন্ট্রা মিনিস্ট্রি ও ইন্টার মিনিস্ট্রি কাজ করে সরকারি-বেসরকারি খাত মিলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কী হবে তা বিবেচনায় নিতে হবে।
আমাদের কৃষি ব্যবস্থাপনা ও কৃষি শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে হবে। আমরা রেমিট্যান্স পাচ্ছি। এগ্রি রেমিট্যান্স কীভাবে পাওয়া যায় সেগুলোকে ভাবনায় নিয়ে এসে একসঙ্গে মিলিয়ে একটি হলিস্টিক চিন্তা করতে হবে। এটি আমরা ২৫ বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে এগোতে চাই। কৃষি বা কৃষকবান্ধব অর্থনীতি শক্ত করে আমাদের অন্য শিল্পে যেতে হবে। কৃষি ছাড়া কর্মসংস্থানের অবস্থার উন্নতি সম্ভব নয়। আমাদের শিক্ষা ও দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে কৃষিকে নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান: সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়
[বণিক বার্তা আয়োজিত কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা ও প্রাণ-প্রকৃতি সম্মেলনের ‘খাদ্যনিরাপত্তা ও কৃষকের ন্যায্যতা’ বিষয়ক অধিবেশনে সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে]