কৌশল নির্ধারণ ও বাংলাদেশের লাভক্ষতি
সাইফুল ইসলাম শান্ত । সূত্র : প্রতিদিনের বাংলাদেশের, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে বাণিজ্যযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের পাশাপাশি কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন। যদিও পরে তা এক মাসের জন্য এই সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছেন। যে কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পণ্যের ওপর চীনও পাল্টা শুল্কারোপের ঘোষণা দেওয়ায় বৈশ্বিক মূলস্ফীতি বাড়বে। ইইউভুক্ত দেশগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর শুল্কারোপের হুমকি দিয়েছে। সব মিলে পাল্টাপাল্টি এ বাণিজ্যযুদ্ধে বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির গতি কমিয়ে বাড়াবে পণ্যের মূল্য। এসবের বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্র এখনও বিশ্বের একক বৃহত্তম আমদানিকারক দেশ। বৈশ্বিক পণ্য ও সেবার ১৮ শতাংশ আমদানি করে দেশটি। বিপরীতে রপ্তানি করে ১৪ শতাংশ। দেশটি বাংলাদেশসহ বহু দেশের প্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার তো বটেই, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) প্রধান জোগানদারও।
বৈদেশিক বাণিজ্যের তথ্যমতে, বাংলাদেশ প্রতি বছর গড়ে ৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি করছে। বিপরীতে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করছে সাড়ে ৬ হাজার কোটি ডলারের। ফলে রপ্তানিতে কিছুটা সুবিধা থাকলেও শুল্কারোপের ফলে বাড়তি মূল্যে পণ্য আমদানিতে ব্যয় বাড়বে। যা দেশের বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি আরও উস্কে দিতে পারে।
তবে বৈশ্বিক এ উত্তেজনার মধ্যেও বাংলাদেশের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলতে পারে। চীন যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন তেলের অন্যতম বড় ক্রেতা। যদি বেইজিং মার্কিন সয়াবিনের ওপর শুল্ক আরোপ করে, তাহলে ওই পণ্যের দাম কমে যাবে। এতে বাংলাদেশের আমদানিকারকদের জন্য সস্তায় সয়াবিন তেল সংগ্রহের একটা সুযোগ তৈরি হবে। একই পরিস্থিতি কানাডার গম, ভোজ্য তেল ও রাসায়নিক পণ্যের ক্ষেত্রেও হতে পারে, যা বাংলাদেশকে কম দামে এসব পণ্য আমদানির সুযোগ তৈরি করে দেবে। এছাড়া ইউরোপ থেকেও অনেক পণ্য কিছুটা কম দামে পেতে পারে বাংলাদেশ।
তবে সবচেয়ে বড় সুফল আসতে পারে তৈরি পোশাক খাতে। ১০ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধির ফলে চীনা পোশাকের দাম বাড়লে মার্কিন খুচরা ব্র্যান্ডগুলো বিকল্প হিসেবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকবে এটা মোটামুটি নিশ্চিত। এ সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবেন চীনের ব্যবসায়ীরাও। চীন থেকে সরিয়ে অনেক ব্যবসায়ী বাংলাদেশে কারখানা স্থাপন করতে পারেন। এর ফলে দেশে যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে তেমন বাড়বে রপ্তানি আয়ও। বাংলাদেশে বিনিয়োগের অনেক সেক্টর রয়েছে। যার মধ্যে জাহাজশিল্প, চামড়াজাত শিল্প, পেট্রোলিয়াম, সারকারখানা, বৈদ্যুতিক গাড়ি, কৃষিযন্ত্র, পরিবেশবান্ধব সোলার তৈরিসহ আরও অনেক সেক্টর। সেগুলো বিনিয়োগকারীদের সামনে তুলে ধরতে হবে।
ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেল (অটেক্সা)-এর হালনাগাদ তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর সময়ে যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে ১ হাজার ৫২২ কোটি, কানাডা ৪৭ কোটি ও মেক্সিকো ২৪১ কোটি ডলারের পোশাক আমদানি করেছে। এ বিশাল বাজার ধরতে দেশের বিদ্যমান জ্বালানি ও ব্যাংকিং সমস্যা সমাধানে সরকারকে আরও বেশি উদ্যোগী হতে হবে। রপ্তানিমুখী শিল্পে উপযুক্ত নীতিসহায়তা না দেওয়া হলে এ সম্ভাবনার পুরোটাই পাশের দেশ ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, কম্বোডিয়ার দখলে চলে যেতে পারে।
বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদে বাণিজ্যসুবিধা ভোগ করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করাটা অনেক বেশি প্রয়োজন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের চলতি মেয়াদেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করা যেতে পারে। কারণ চীন-মার্কিন অনিশ্চয়তা সামনে আরও বাড়তে পারে। আর এ সুযোগ আমাদের লুফে নিতে হবে। এদিকে ২০ জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাহী আদেশে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে বিভিন্ন প্রকল্প বন্ধ করার ঘোষণা দেওয়ার পর বাংলাদেশের হাজার হাজার উন্নয়নকর্মী অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন। যদিও আদেশে ৯০ দিনের পর্যালোচনা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, তবু অনেক কর্মী ইতোমধ্যে চাকরি হারিয়েছেন এবং প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।
নির্বাহী আদেশটি এমন সময়ে এসেছে যখন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং বৈদেশিক ঋণের উচ্চ পরিশোধের চাপ। এমন পরিস্থিতিতে তহবিল সংকোচন সংকট আরও গভীর করবে বলে মনে করছেন উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্যানুযায়ী, গত বছর যুক্তরাষ্ট্র ৯৬টি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ৪৫০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নের প্রকল্পগুলোয় আনুমানিক ২০ হাজার পেশাদার কাজ করেন। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা স্থগিত হলে বিক্রেতা, ডিলার এবং কয়েক মিলিয়ন সুবিধাভোগীর ওপর এর প্রভাব পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সহায়তা সংস্থা ইউএসএআইডি বন্ধের ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশসহ গোটা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের উন্নয়ন সহযোগিতা পরিকল্পনা বড় অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউএসএআইডির কার্যক্রম বন্ধ হলে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে এবং এ শূন্যস্থান চীন সহজেই পূরণ করতে পারে। এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব চীনের দখলে চলে যেতে পারে।
ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে বাংলাদেশ স্বল্পমেয়াদে কিছু সুবিধা পেলেও, অর্থনীতিবিদরা সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি নিয়ে সতর্ক করেছেন। তারা মনে করেন, যদি অন্যান্য দেশ স্বনির্ভরতা বাড়ানোর লক্ষ্যে আমদানি কমানোর মার্কিন নীতি অনুসরণ করে, তাহলে রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
আমাদের মনে রাখা দরকার, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত (২০১৭) হওয়ার পর তার বাণিজ্যনীতির আওতায় ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে এনেছিলেন। তবে বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা ফিরিয়ে দেননি কিংবা শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা প্রদান করেননি। ডব্লিউটিওর সিদ্ধান্ত থাকার পরও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, নেপাল ও কম্বোডিয়া আজও যুক্তরাষ্ট্রে বাজার সুবিধা পায়নি। আর ২০২৬ সাল শেষে বাংলাদেশ যেহেতু এলডিসির কাতার থেকে বেরিয়ে আসবে, সেহেতু এ বাজার সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ হয়ে গেছে। এখন চিন্তার বিষয় ট্রাম্পের বর্ধিত শুল্কের ধাক্কা বাংলাদেশের ওপর কতটা প্রভাব পড়বে।
বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত বাংলাদেশ ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতির কারণে স্বল্পমেয়াদে হয়তো কিছু সুবিধা পাবে; কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।পরিস্থিতি যেদিকে মোড় নিচ্ছে তা বিবেচনায় নিয়ে সরকারের কৌশল নির্ধারণের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। রপ্তানি বৃদ্ধিতে যেমন নীতিসহায়তা দিতে হবে, তেমন নিজেদের সুরক্ষার জন্য অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি রাখা দরকার।
- সাংবাদিক